অধিক মুনাফার জন্য এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী দেশের কোটি কোটি মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। খাদ্যে রাসায়নিক বিষক্রিয়া বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। মানহীন ও ভেজাল খাদ্য বিস্তার রোধে সংশ্লিষ্ট দফতরকে সজাগ হতে হবে। খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক বিষক্রিয়া প্রয়োগের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। মানহীন খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাদের নিত্যনতুন কৌশল আর অধিক মুনাফার জন্য ভেজাল ও মানহীন পণ্য দেশজুড়ে বিস্তার করছে। মাঝে মাঝে ভোক্তা অধিকার সংস্থা, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমে খাদ্যে বিষক্রিয়ার বিষয়টি বন্ধে জোরালো আবেদন হলেও, বলতে গেলে এক প্রকার উদাসীন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলশ্রুতিতে জনগুরুত্বপূর্ণ এ সেক্টরের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে পারছেন না কেউই।
মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে খাদ্যকে মৌলিক উপকরণ ও ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে খাদ্যকে জীবনের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাতে কি? কে রাখে কার কথা। বাংলাদেশ স্বাধীনতার রজতজয়ন্ত্রী পালন করলেও খাদ্যে ভেজাল থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ আজও বের করতে পারেননি সরকারের সর্বোচ্চ মহল। খাদ্যে ভেজালের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে, কী দোকন, কী বাজার, কী মার্কেট আর রেস্তেরাঁ, হোটেল, মোটেল সবখানেই যেন নৈরাজ্যের ঘনঘটা। তৈরি করা অথবা কাঁচা খাদ্য, কোনোটির ওপরই সাধারণ মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না।
যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো খাদ্যে ভেজালরোধে সরব। নিজ নিজ দেশের জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্যের জন্য সোচ্চার তারা। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা যায়, মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানান প্রাণঘাতী রোগের মূল কারণ ভেজাল খাদ্য। ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে মানবদেহে বাসা বাঁধে বিভিন্ন অনিরাময়যোগ্য রোগ। এসব জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন কোমলমতি শিশু, বৃদ্ধ ও যুবকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকারক ইথোফেন, কার্বাইড, রাইপেন ও অন্যান্য রাসায়নিক বোতলের গায়ে লেখা রয়েছে ফল পাকানোর কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ। অথচ মৌসুমি ফল, আম, জাম, কলা, কাঠালসহ অন্যান্য ফলমূল পাকানোর কাজে দেদারসে ফলের আড়তগুলোতে এসব ব্যবহার করছেন মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। ইথোফেন, কার্বাইড, রাইপেনসহ আরও কিছু রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে দ্রবণ তৈরি করে স্প্রে করে আম ও কলা পাকানো হচ্ছে। স্প্রে দেওয়ার দু’একদিনের মধ্যেই ফল পুরোপুরি হলুদ বর্ণ ধারণ করে, পেকে যায়। অন্যদিকে সবজিতে মেশানো হচ্ছে ডাইমেটওয়েট, এসিপামিপ্রিড ও মেথালিক্সিন জাতীয় কীটনাশক। বাজারের খোলা হলুদ-মরিচের গুড়ায় মেশানো হচ্ছে ক্লোরেপাইরিফিস ও আলফাটক্সিন। দুনিয়াজুড়ে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও নানা রকম শুঁটকিতে মেশানো হচ্ছে ডিডিটি ও অ্যালড্রিন। দেশের সর্বত্রই নিরাপদ খাদ্য শতভাগ নিশ্চিত করতে সরকারের বেঁধে দেওয়া আইন কঠোর হলে ভেজাল, মানহীন খাবার উৎপাদন কমে আসবে বলে ধারণা সচেতন মহলের। তবে তার বাস্তবরূপ কবে দেখতে পাবে সাধারণ মানুষ, সেই প্রতিক্ষায় আছি আমরা। গেল এক দশকে খাদ্যে ভেজালের হার কমেনি, বরং ভিন্ন-অভিন্ন কৌশলে ভেজাল কারবারীরা খাদ্যে বিষক্রিয়া আগের চেয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে। আইন থাকলেও প্রয়োগ না হওয়া, খাদ্য উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের মানের সুষ্ঠু তদারকি না থাকায় পণ্য উৎপাদক ও বিক্রেতারা শাস্তির তোয়াক্কা করছেন না। ফলে মানহীন ও ভেজাল খাদ্যে সয়লাব হয়েগেছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া; রুপসা থেকে পাথুরিয়া, এক কথায় পুরো বাংলাদেশে।
একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী মানুষের কারণেই দিনে দিনে আমরা মৃত্যু ঝুঁকির দিকে ধাবিত হচ্ছি। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, সরকারের জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দৈনন্দিন খাদ্যদ্রব্যে মারাত্মক রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সারাদেশ থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যে কেমিক্যাল ও কীটনাশকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। তাই নিরাপদ খাদ্যের অধিকার ভোক্তাদের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন থেকেই নিরাপদ খাদ্য সকলের জন্য নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে মানবদেহে রোগ-ব্যাধি আক্রান্তের হার ভবিষ্যতে আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে মানুষের মৃত্যুর ৭০ শতাংশ কারণ হয়ে দাঁড়াবে শুধুমাত্র ভেজাল খাদ্য। বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় ৫৯.৮৪% লোকের এবং শহর এলাকায় ১০.৮১% লোকের কৃষিখামার রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৯.১% এবং কৃষিখাতের মাধ্যমে ৪৮.১% মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। বলা যায়, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের বেশির ভাগ খাদ্যদ্রব্যই আমরা উৎপাদন করে থাকি। বিশেষ কিছু খাদ্যদ্রব্য আমাদের আমদানি করতে হয় দেশের বাইরে থেকে। নিজস্ব ও আমদানিকৃত কোনো খাদ্যদ্রব্যই ভেজালের আওতামুক্ত নয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শতকরা নব্বই ভাগ মৌসুমি ফল ও শাক-সবজিতে বিষ মেশানো হচ্ছে। একইভাবে মাছ, গুঁড়া মসলা, শিশু খাদ্য, এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
সম্প্রতি রাজধানীর টঙ্গিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ভেজাল বিরোধী অভিযানে কয়েকটি ফ্রুট ড্রিঙ্কস উৎপাদনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অনুমোদনহীনতা, মানহীনতা এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি থাকায় কারখানাটিকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। ফ্রুটড্রিঙ্কসের নামে ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশ্রিত এসব পানীয় মূলত শিশুখাদ্য হিসেবেই বিক্রি হয়ে থাকে। না জেনে না বুঝে শিশুরা এসব ড্রিঙ্কস পান করে নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হচ্ছে। তাছাড়া মাছ-মাংস, ফল, সব্জি, চাল-ডাল, তেল, আটা-ময়দা, পাউডার দুধ, কেক-পেস্ট্রি, আইসক্রিম, মিষ্টান্ন, দধি থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বাজারে বিক্রি হওয়া এমন কোনো পণ্য নেই, যা ভেজাল ও নকলের শিকার হচ্ছে না। আঠার কোটি মানুষের বাংলাদেশের বসবাসকারী মানুষেরা শুধুমাত্র ভেজাল খাদ্যের জন্য নতুন নতুন নিরবঘাতক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মানহীন ভেজাল, নকল, অননুমোদিত ও ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যপণ্যের ব্যবসা দেশে একটি মহামারি আকার ধারণ করেছে, যার ফলে কোটি কোটি মানুষ প্রতিনিয়তই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। ফর্মালিন, কার্বাইড, ডিডিটিসহ ক্ষতিকর ক্যামিকেল ও রং মিশ্রিত খাদ্যপণ্যের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিসহ ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করা এখন সময়ের দাবি।
ভেজাল প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অসৎ, অসাধু ব্যবসায়ীদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া উচিত নয়। কেবল জেল-জরিমানা নয়, এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা এখন সময়ের দাবি। অপরাধীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে এর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভেজালের বিরুদ্ধে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তবে একথা চিরন্তন সত্য, যতদিন পর্যন্ত মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন না হবে ততদিন এ প্রবণতা বাড়বেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন