বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

ফুটবলকেই সুন্দর করে তুলেছিলেন স্পোর্টিং আইকন পেলে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২, ৮:৩৯ পিএম

ববি চার্লটন বলেছিলেন ফুটবল হয়তো আবিষ্কারই হয়েছে তার জন্য এবং নিশ্চিতভাবেই বেশির ভাগ ভাষ্যকার তার প্রশংসা করেন এভাবে যে তিনিই চমৎকার এ খেলাটির সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। গোলের সামনে গিয়ে তার দক্ষতা আর বিদ্যুৎগতির নিখুঁত মিশ্রণ ঘটতো। নিজের দেশ ব্রাজিলের একজন নায়ক পরে হয়ে ওঠলেন বৈশ্বিক স্পোর্টিং আইকন। আর মাঠের বাইরে তিনি বরাবরই কাজ করেছেন সমাজের বঞ্চিত মানুষের জীবনমানের উন্নতির জন্য।

এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো জন্মেছিলেন ব্রাজিলের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় শহর ট্রেস কোরাকোসে ১৯৪০ সালের ২৩শে অক্টোবর। তবে তার জন্ম সনদে তার জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২১শে অক্টোবর। তবে পেলে বলেছেন এটি সত্যি নয়। “ব্রাজিলে একেবারে নিখুঁত থাকা নিয়ে আমরা ততটা ব্যস্ত নই”। তার নাম রাখা হয় বিখ্যাত আবিষ্কারক থমাস আলভা এডিসনের নাম। পেলের মতে এটি হয়েছে কারণ তার জন্মের কয়েকদিন আগে তার বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযুক্ত হয়েছিলো। পরে অবশ্য তার নাম থেকে ‘আই’ অক্ষরটি বাদ দিয়ে দেন বাবা মা।

বাউরো শহরে কিছুটা দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি বড় হন। লোকাল ক্যাফেতে কাজ করে তিনি পরিবারের আয়ে সহায়তা করতেন। বাবার কাছেই ফুটবল শিখেছেন তিনি। কিন্তু পরিবারের বল কেনার সামর্থ্য ছিলো না। সুতরাং তরুণ পেলেকে মাঝে মাঝেই কাপড়ের দলা পেঁচিয়ে বল বানিয়ে রাস্তায় খেলতে দেখা যেতো। স্কুলে এসে বন্ধুদের কাছে তার নাম হয় পেলে। যদিও তিনি নিজে বা তার বন্ধুরা কেউ জানতেন না যে এর অর্থ কী। তিনি তার এই ডাক নামটা কখনোই পছন্দ করেননি। কারণ তার মনে হতো এটা পর্তুগীজ ভাষায় “শিশুদের কথার’ মতো।

কিশোর বয়সেই স্থানীয় কয়েকটি সৌখিন দলের সদস্য হয়ে খেলা শুরু করেন। ওই সময় সেখানে ইনডোর ফুটবল মাত্রই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলো। তরুণ পেলে এর স্বাদ নেয়া শুরু করলেন। ‘আমি এটাকে পানি থেকে মাছ ধরার মতো একটি ব্যাপার হিসেবে নিয়েছিলাম’। পরে আবার বলেছেন, ‘মাঠের ফুটবলের চেয়ে এটা ছিলো আরও দ্রুতগতির- আপনাকে দ্রুত চিন্তা করতে হতো’। তিনি বাউরু অ্যাথলেটিক ক্লাব জুনিয়রকে নেতৃত্ব দিয়ে তিন বার রাজ্য যুব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন এবং এর মাধ্যমে নিজেকে উজ্জ্বল প্রতিভা হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন।

১৯৫৬ সালে তার কোচ ভালদেমার ডি ব্রিতো তাকে সান্তোষে নিয়ে যায় পেশাদার দল সান্তোষ এফসিতে চেষ্টা করার জন্য। ডি ব্রিতো এর মধ্যেই ক্লাব কর্তাদের রাজি করাতে পেরেছিলেন যে পেলেই একদিন বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হবে। ১৯৫৬ সালে জুনে ক্লাব তাকে চুক্তি অফার করে আর তখন তার বয়স মাত্র পনের। এক বছরের মধ্যেই সান্তোষের সিনিয়র টিমের জন্য নির্বাচিত হন তিনি এবং প্রথম ম্যাচেই গোল করেন তিনি। তিনি দ্রুতই দলে জায়গা পাকা করে ফেলেন এবং প্রথম বছরেই লীগের শীর্ষ গোলদাতা হন।

পেশাদার চুক্তির মাত্র দশ মাসের মাথায় ব্রাজিলের জাতীয় দলে ডাক পান তিনি। মারাকানায় আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয় তার এবং ওই ম্যাচে তার দল ২-১ গোলে হেরে যায়। একমাত্র গোলটি করেছিলেন ১৬ বছর বয়সী পেলে এবং এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফুটবলে কনিষ্ঠ গোলদাতা হন তিনি। কিন্তু হাঁটুর ইনজুরির কারণে ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছিলো। এর মধ্যেই দলের অন্য খেলোয়াড়দের চাপে কর্তৃপক্ষ তাকেও দলে রাখে এবং বিশ্বকাপে তার অভিষেক হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে।

বিশ্বকাপে কনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে গোল করেন তিনি এবং কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসকে হারিয়ে দেন। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ব্রাজিল ২-১ গোলে এগিয়ে ছিলো কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে পেলে হ্যাট্রিক করে ম্যাচকে নিজের করে নেন। আর ফাইনালে সুইডেনের বিরুদ্ধে তার গোল ছিলো দুটি এবং ব্রাজিল জিতে ৫-২ গোলে। ব্রাজিলে ফিরে পেলে সান্তোষকে সাও পাওলোর শীর্ষ লীগ জিততে সহায়তা করেন এবং ওই মৌসুমের শীর্ষ গোলদাতা হন।

১৯৬২ সালে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন বেনফিকার বিরুদ্ধে বিখ্যাত জয় পান। লিসবনে পর্তুগীজ দলটি বিরুদ্ধে তার হ্যাট্রিক শুধু দলকেই জেতায়নি, সাথে অর্জন করে নেন প্রতিপক্ষ গোলকিপারের শ্রদ্ধাও। ‘আমি এসেছিলাম একজন মহান ব্যক্তিকে থামাতে। কিন্তু আমি পরে বুঝেছি যে এমন একজনের বিরুদ্ধে আমার কিছু করার ছিলো না যিনি এই গ্রহের আমাদের অন্যদের মতো নন’।

১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে ইনজুরির কারণে সাইড লাইনে চলে যেতে হয় পেলেকে কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা রেয়াল মাদ্রিদের মতো ধনী ক্লাবগুলোকে সেটি থামাতে পারেনি। এসব ক্লাবগুলো তাকে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো কারণ এর মধ্যেই গ্রেটেস্ট ফুটবলার হবার সব ইঙ্গিত তিনি দিচ্ছিলেন। কিন্তু নিজেদের তারকা হারানোর ভয়ে ব্রাজিলের সরকার তাকে ‘জাতীয় সম্পদ’ ঘোষণা করে তার ট্রান্সফার ঠেকানোর জন্য।

১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ ছিলো পেলে ও ব্রাজিলের জন্য হতাশার। পেলে ছিলেন সবার লক্ষ্যবস্তু। আক্রমণ ও ফাউল সয়েছেন অনেক। ফলে তার সেরা খেলাটাই খেলার সুযোগ পাননি তিনি। বাড়ি ফিরে আবার সান্তোষের জন্য কাজ শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে পেলে তখন ত্রিশের দোরগোড়ায়। ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে খেলার বিষয়ে কিছুটায় দ্বিধায় ছিলেন। দেশের সামরিক স্বৈরাচার এ সময় তার বিরুদ্ধে একটি তদন্তও করছিলো। অভিযোগ ছিলো তিনি বামপন্থীদের প্রতি সদয়।

শেষ পর্যন্ত ওই বিশ্বকাপে চার গোল করলেন আর তাতেই ইতিহাসের সেরা দল হয়ে গেলো ব্রাজিল। সবচেয়ে বিখ্যাত মূহুর্তটি ছিলো ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। তার হেড থেকে বল যখন নেটে ঢুকছিলো তখনি গর্ডন ব্যাংক তার বলটি ঠেকিয়ে দেন এবং সেটিই পরে খ্যাতি পায় ‘দ্যা সেইভ অফ দ্যা সেঞ্চুরি’ হিসেবে। এ সত্ত্বেও ফাইনালে ইটালির বিরুদ্ধে ৪-১ গোলে জয় জুলে রিমে ট্রফির স্থায়ী গন্তব্যে পরিণত করে ব্রাজিলকে। পেলে অবশ্যই গোল করেছিলেন।

ব্রাজিলের জন্য তার শেষ খেলা ছিলো ১৯৭১ সালের ১৮ই জুলাই। রিওতে যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে। আর ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফুটবল থেকে তিনি অবসর নেন ১৯৭৪ সালে। দু বছর পর তিনি নিউইয়র্ক কসমসের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন এবং সেখানে তার নামই ফুটবলের ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়।

১৯৭৭ সালে পেলের পুরনো দল তার অবসরকে সম্মানিত করতে কসমসের সাথে খেলার আয়োজন করে। তিনি খেলা দু অংশে দুই দলের হয়ে খেলেন। এর মধ্যেই তিনি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ আয় করা খেলোয়াড়। অবসরের পরেও অর্থ আয় তার অব্যাহতই থাকে। একটি চলচ্চিত্রেও অংশ নিয়েছেন ১৯৮১ সালে। তার ছিলো অনেক স্পন্সরশীপ চুক্তি। ১৯৯২ সারে তাকে জাতিসংঘ পরিবেশ বিষয়ক দূত নিয়োগ করে আর পরে হন ইউনেস্কোর গুডউইল অ্যাম্বাসেডর।

১৯৯৫ সালে ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রী হয়ে ফুটবল থেকে দুর্নীতি দূর করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যদিও দুর্নীতির অভিযোগেই ইউনেস্কো থেকে সরে যেতে হয় তাকে যদিও এর কোনো প্রমাণ ছিলো না। ২০০৫ সালে তিনি বিবিসির স্পোর্টস পারসোনালিটি অফ দ্যা ইয়ার মনোনীত হয়েছিলেন।

১৯৬৬ সালে পেলে বিয়ে করেছিলেন রোজমেরি ডোস রেইস ছলবিকে। এই দম্পতির দুই কন্যা আর এক পুত্র ছিলো। ১৯৮২ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন গায়িকা আসিরিয়া লেমোস সেইক্সাসকে। যমজ সন্তান বাবা মা ছিলেন তারা। তাদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ২০১৬ সালে তিনি জাপানি-ব্রাজিলিয়ান ব্যবসায়ী মার্সিয়া সিবেলে আওকিকে বিয়ে করেন। এই নারীর সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিলো ১৯৮০ সালে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি প্রায়শই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সার্জারি করে টিউমার অপসারণ করা হয় কোলন থেকে।

ফুটবলে যাদের আগ্রহ ছিলো না বা নেই তাদের কাছেও পেলে সুপরিচিত। এমনকি একসময় কৌতুক হয়ে দাঁড়ায় যে বিশ্বে সত্যিকার অর্থেই তিনটি ব্রান্ড – যিশু, কোকা কোলা এবং পেলে। তিনি ছিলেন বিশ্বের বিরল ব্যক্তিদের একজন যিনি তার খেলার মাধ্যমে সারাবিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন। সূত্র: বিবিসি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন