আর একটি খ্রিস্টীয় নতুন বছর শুরু হয়েছে আজ। বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ এ দিনটিকে সাদরে গ্রহণ করে জাঁকজমকভাবে। তবে, এ দিনে সর্বাধিক আনন্দ-উল্লাস হয় পশ্চিমা দেশগুলোতে। তারা অতীতের সব কিছু পেছনে ফেলে নববর্ষকে আলিঙ্গন করে ভবিষ্যতের সুখ-শান্তির আকাক্সক্ষায়। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ দিন বিশেষ বাণী দেন। এবার নতুন বছরে শান্তি পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। বাংলাদেশিরাও এ দিন জাঁকজমকভাবে উদযাপন করে। অনেকে এ উপলক্ষে জ্যোতিষীর কাছে ভিড় করে ভাগ্যলিপি জানার জন্য। এ বছরও হয়তো এর ব্যতিক্রম হবে না। এটাই সত্য, শত চেষ্টা করেও অতীতকে মুছে ফেলা যায় না। অতীতের প্রভাব সব কিছুতে থাকবেই। বিদায়ী বছরের স্মৃতি আমাদের সুখকর নয়। যেমন: পণ্যমূল্য আকাশচুম্বী, ভয়াবহ বেকারত্ব, দেশের কল্পনাতীত ঋণ, মারাত্মক দূষণ, টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন, ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি, চরম জ্বালানি সংকট, রেমিটেন্স হ্রাস, বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খাদ্য, ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদিতে সংকট। এসব সহজে দূর হবে না। তাই চলতি বছর এসব সংকট আরো বাড়বে। রিজার্ভ সংকট মোকাবেলার লক্ষ্যে সরকার আইএমএফ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার আবেদন করেছে। সংস্থাটিও তা দিতে রাজী হয়েছে কিছু শর্তে। যেমন: কর জিডিপির হার বাড়ানোর জন্য কর রেয়াত বন্ধ, ভর্তুকি হ্রাস ও ডলারের সাথে টাকার বিনিময় মুক্ত করা ইত্যাদি। এসব করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করেছে। এতে জীবন যাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষের কষ্ট ও দারিদ্র বাড়বে। আইএমএফ’র শর্ত মেনে দেশের প্রকৃত ঋণের হিসাব প্রকাশ করার কাজ চলছে, যা প্রকাশিত হলে মানুষ শিহরিত হয়ে উঠবে। ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশিত হলে দেখা যাবে, ১৯৭৩ সালে রিলিপের কম্বল যেমন লুটপাট হয়েছে, তেমনি অনেক দিন ধরে ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লুটপাট হয়েছে। বহু ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে, যা বহুদিন অব্যাহত থাকবে। বড় ঋণ খেলাপিরা নাকি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তাই তাদের ঋণ আদায় অনিশ্চিত! নতুন বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি। কর্মসংস্থান তেমন সৃষ্টি হচ্ছে না। বিদেশেও কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। বেসরকারি খাতও সংকুচিত হচ্ছে। ফলে এ বছরও বেকারত্ব আরো বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে। খাদ্য সংকটও বাড়বে। কারণ, এ বছর আমন ধানের চাষ ২৫% কম হয়েছে। ফলে বাম্পার ফলনের পরও চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ লাখ মে.টন উৎপাদন কম হয়েছে। চাল, গমসহ সব খাদ্যপণ্যের বেশিরভাগই আমদানি নির্ভর। তাই সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী ভারতে গিয়ে কিছু খাদ্যপণ্যের রফতানির কোটা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা চেয়েছেন। তাতে দেশটি সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য যে, এ বছর ভারতের কাছে মে.টন হিসাবে চাল ৯ লাখ, গম ৪৫ লাখ, পিঁয়াজ ৭ লাখ ও চিনি ১৫ লাখের কোটা চেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভারত উক্ত যাচিত পণ্যগুলো দেবে কি-না সন্দেহ রয়েছে। কারণ, দেশটি চুক্তি অনুযায়ী পণ্য দেয় না ঠিকমত। সেক্ষেত্রে মৌখিক আশ্বাসের কোনো বিশ্বাস নেই! দ্বিতীয়ত: ভারতের কাছে যাচিত পণ্যাদি পাওয়া গেলেও বিভিন্ন দেশ থেকে আরো বিপুল খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হবে, যা পাওয়া কঠিন। পেলেও খুবই ব্যয় বহুল হবে। তাই সব মিলে এ বছরও খাদ্যপণ্যের সংকট ও মূল্য বাড়বে! অন্যদিকে, করোনার নতুন ধরন-বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা সর্বাধিক। তাই এতে আক্রান্তের হার ব্যাপক বাড়ছে। ইতোমধ্যে চীন ও জাপানের অবস্থা ভয়াবহ, যার রেশ পড়েছে ভারতে। এর প্রভাব এ দেশেও পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
২০২৩ সাল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধাকারী দলগুলোর আন্দোলন চূড়ান্ত করার বছর। কারণ, নিয়ম মতে, জাতীয় নির্বাচন হবে এ বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের প্রথম মাসে। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তার রেজাল্ট কী হবে তা সকলেই জানে। তাই বিএনপি ঘোষিত ও সমমনা দলগুলোর সমর্থিত রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফার অন্যতম হচ্ছে: অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। তারা দাবিসমূহ আদায়ের জন্য পূর্ব ঘোষণা মতে, যুগপৎ গণমিছিল করেছে গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা ও রংপুর ছাড়া সারা দেশে। এর পর গত ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা ও রংপুরে করেছে। এতে ৩৩টি দল অংশ নিয়েছে। তাদের পরবর্তী কর্মসূচি ১১ জানুয়ারি ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহরে গণ-অবস্থান। আন্দোলন সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে পরিচালনার জন্য তারা লিঁয়াজো কমিটি গঠন করেছে। যুগপৎ গণমিছিলগুলোতে বহু মানুষ অংশ নিয়েছে। ২৭ দফা বাস্তবায়িত হলে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র, সুশাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাড়াও দেশের আমূল পরিবর্তন হয়ে ব্যাপক স্থায়ী কল্যাণ হবে। তাই দেশের অধিকাংশ মানুষ উক্ত রূপরেখাকে সমর্থন করেছে। এখন তা বাস্তবায়নের সিডিউল ঘোষণা করা দরকার। সেটা হলে মানুষের আস্থা আরো বাড়বে। ফলে অগনিত মানুষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে। সরকার ২৭ দফা মানতে আগ্রহী নয়। তাই এ সম্পর্কে নানা কটুক্তি করছে। ২৭ দফার অন্যতম হচ্ছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। সেটা হলে, বিশ্লেষকদের মতে, আ’লীগের অবস্থা হবে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মেয়র প্রার্থীর মতো। গত ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত উক্ত নির্বাচনে আ’লীগের মেয়র প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন! এটা আ’লীগও বোঝে। তাই নিজ দলীয় সরকারের অধীনে গণতন্ত্রপন্থী দলগুলোকে বাদ দিয়ে শুধু ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে আগামী নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি করে পুনরায় ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে। এখনই বিএনপির পদত্যাগ করা আসনে ভাগাভাগির দেন দরবার চলছে। উপরন্তু বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে হামলা, মামলা, গুলি, হত্যা, গণগ্রেফতার বৃদ্ধি করা হয়েছে। দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যার অন্যতম হচ্ছে, পুলিশ ও দুদক। সর্বোপরি সরকার কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে সকলের স্বাধীন মতকে দমন করে রেখেছে। যা’হোক, ব্যাপক দমন-পীড়ন সত্ত্বেও গণতন্ত্রপন্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে হবে। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে পারলেই তা সফল হবে। সরকারও ক্ষমতা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। তাই দেশে ব্যাপক সহিংসতা বাঁধার আশংকা দেখা দিয়েছে। জেএসডির প্রধান আ স ম রব সম্প্রতি বলেছেন, সরকার দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর চেষ্টা করছে। সেটা হলে শান্তি ও উন্নতি ব্যাহত হবে।
দেশে হঠাৎ করে নতুন আর একটি বড় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশ নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব। স্বাধীনতাত্তোর কালে এ দেশে ভারত একাই খেলছে! এতে যে বাধা দিয়েছে, তাকেই সাইজ করেছে। এ অবস্থায় সম্প্রতি আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করার পরামর্শ দিচ্ছে। উপরন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে জাতিসংঘ ও আমেরিকা খুবই সরব হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আমেরিকা র্যাব ও তার ৭ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত এক গুম হওয়া ব্যক্তির বোনের বাড়িতে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলেন। সে সময় মায়ের ডাক নামে এক সংগঠনের কিছু লোক সেখানে উপস্থিত হয়ে রাষ্ট্রদূতকে স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করেছে পূর্বানুমতি ছাড়াই। তাতে রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে সোজা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের কাছে গিয়ে নালিশ করেন। উপরন্তু মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টও উক্ত ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে দূতাবাসের লোকদের পূর্ণ নিরাপত্তার দাবি জানায়। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আকস্মিকভাবে মার্কিন দূতাবাসকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর জন্য সতর্ক করেছে। এর প্রতিত্তোরে জার্মান দূতাবাস পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ নিয়ে পরাশক্তিগুলো ব্যাপক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। তৎপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেছেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকা ও রাশিয়ার নাক গলানোর দরকার নেই। আমাদের বিষয় দেখভাল করার জন্য আমরাই যথেষ্ট। তাঁর এই বক্তব্য সঠিক। কারণ, আমাদের নীতি হচ্ছে, সকলের সাথেই বন্ধুত্ব, কারো সাথেই শত্রুতা নয়। তবুও কথা থাকে, সেটা হচ্ছে, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করার জন্য চীনের সাথে সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু ভারতের প্রবল বাধার কারণে সেটা বাতিল করে মহেশখালীতে করা হচ্ছে! ব্যাপক প্রচেষ্টার পরও ভারত আন্তর্জাতিক তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি করছে না। ফলে প্রয়োজনীয় পানির অভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তাই তিস্তা পাড়ের লোকদের কল্যাণের লক্ষ্যে চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করার এবং এর সমুদয় ব্যয় ঋণ হিসেবে প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে অনেক দিন আগে। তবুও সেটি আটকে আছে ভারতের আপত্তির কারণে। পরিকল্পনামন্ত্রী গত ২৮ ডিসেম্বর বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারতের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। তিস্তা নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে অবশ্যই ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করা হবে। কিন্তু উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করার বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবুও সেটা নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা কেন? ভারতে কি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করে? দুই দেশের অনেক অভিন্ন নদীতে ভারত অসংখ্য বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে এ দেশের সর্বনাশ করছে। সেটা কি আমাদের সাথে আলোচনা করে করেছে? কোনটিই না। তবুও আমরা অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা করছি। কিছুদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমি ভারতে গিয়ে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন আ’লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে যা যা করা দরকার তা করে। সম্প্রতি আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা রাশিয়ার একটি জাহাজে রূপপুর পরমাণু কেন্দ্রের মাল আনা হচ্ছিল। মার্কিন অনুরোধে সেটাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শেষাবধি জাহাজটির পণ্য ভারতের কোনো বন্দরে খালাস করে পরে তা অন্য জাহাজে বাংলাদেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এসবই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের নামান্তর, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
sardarsiraj1955@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন