সন্দেহ নেই, আমরা একটা বারুদের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। এই বারুদের স্তূপে সামান্য স্ফুলিঙ্গ লাগলেই বিস্ফোরণ হবে, দাবানলের সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে, দেশব্যাপী সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সামনে নির্বাচন। তার আগেই শুরু হয়ে গেছে হম্বিতম্বি। শান্তিপ্রিয় ও সাধারণ নাগরিক সবাই আতঙ্কিত। মানুষ ধৈর্য হারাচ্ছে, মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। নিত্যদিনের জীবন সংগ্রামে সাধারণ জনগণ চরম পেরেশানির মধ্যে আছে, হাঁপিয়ে উঠছে। হতাশা আর অনিশ্চয়তায় দিশাহারা হয়ে পড়ছে। রাজনীতিবিদেরা অহরহ বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এই বচনের মধ্যেও লুকিয়ে আছে মহা ফাপর ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠার টোন।
ক্ষমতাসীন দলের মধ্য থেকে ‘খেলা হবে’ শব্দটি আসছে অনেক আগে থেকেই। আরও একটি কথা বলা হচ্ছে, প্রতিপক্ষ কেউ নেই। যারা এসব বলে তারা কীভাবে বলে, ‘খেলা হবে’? কারণ, মাঠে দুই দল সমান না হলে খেলাই হয় না। বিনোদন এটাই যে, খেলা হবে বলে তারা বার্তা দিচ্ছে, প্রতিপক্ষ সমান শক্তিশালী, তাই ‘খেলা হবে’। অথচ তারাই দিন রাত বলে বিএনপির শক্তি সাহস, জনসমর্থন কিছুই নেই।
বিএনপির ৭ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করলে কিছুই যায় আসে না বলে মন্তব্য করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। গণতন্ত্র যখন পালিয়ে গেছে, তাতেই কিছু হয়নি। আর এরা পদত্যাগ করলেও তাদের কিছুই যায়-আসে না; কিন্তু গণতন্ত্রের অনেক যায় আসে। বিএনপির পদত্যাগে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাসীনদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়েনি; বরং কমেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নামক ‘বাঘের পিঠে’ উঠে বসে আছে অনেকদিন হলো। এর থেকে নামবার উপায় অতো সহজ নয়! সে বাঘ এখন বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, অশান্ত। নামলে, না-জানি বাঘের গ্রাসে পড়তে হয়! বিএনপিও কমবেশি একই কায়দায় ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিল। শেষ রক্ষা হয়নি। বিএনপিকে ওই বাঘের পেটেই যেতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগও একই কাজ করে যাচ্ছে। সবদলই খেলে! খেলায় জয়ী হয়, ক্ষতি হয় শুধু এই হতভাগ্য দেশের। না খেয়ে মরে গরিব জনগণ। এতো চার লেন-ছয় লেন, রূপপুর, পায়রা, মাতারবাড়ী, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল হয়ে গেল। তারপরও কেন ক্ষমতাসীনরা জনগণের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না?
অনেকে মনে করেন, এক টেবিলে বসেই খেলার সমাধান হতে পারে। কিন্তু এরকমটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই মুখে যে যাই বলুক আসলে এ খেলা ‘অন্য খেলা’। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য রাজপথে গুলিতে তরুণের প্রাণ হারানোর ঘটনা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। রাজনীতির মাঠের ‘খেলা হবে’ ভাইরাল সেøাগানটি মহান সংসদে নিয়ে আসা জনগণের জন্য হতাশার এবং চরম দুর্ভাবনার। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই এখন খেলাকে সামনে আনছে। খেলা হবে, এ ঘোষণায় অবশ্য দেশের আমজনতার মাথায় দুঃচিন্তার অন্ত নেই। দুই দলের নেতাদের হুমকি জনমনে ভীতি সঞ্চার করে। নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা জাগায়। অবশ্য এতে রাজনীতিকদের কিছু আসে যায় না। কারণ, তাদের খাওয়া-পরার চিন্তা নেই, গাঁটে টাকার অভাব নেই, তারা অনেকেই আছেন খোশমেজাজে। দুর্নীতিতে বিএনপি পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, বেগম পাড়ায় তাদের অংশীদারিত্ব বহাল তবিয়তে আছে। বর্তমানে দেশে দূর্নীতি, ডলার সঙ্কট, অর্থপাচার এসব আর কি বলার আছে। হাজার টাকায় চাল ও আটার কেজি, পাঁচশ টাকায় সোয়াবিন তেলের লিটার হলেও অনেকের চৌদ্দগোষ্ঠী হাজার বছর দুধে-ভাতে থাকতে পারবে। দেশে গÐগোল লাগলে সেখান থেকেও ফায়দা লোটার ফিকির করবে তারা। সাধারণ মানুষ এসব খেলার মধ্যে নেই। প্রাত্যহিক রোজনামচায় জীবনযাপনের লড়াইয়ের পাশাপাশি চারদিকে এত নেতিবাচকতা, এর ওপর সামনে আরও কী হবে, তা ভেবেই পেরেশান শান্তিপ্রিয় মানুষ।
আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষায় বিএনপির আন্দোলন করার মুরোদ নেই। ১৩ বছরে নাকি তারা ১৩ মিনিটের জন্যও রাজপথ দখলে রাখতে পারেনি। এই মুরোদহীন বিএনপি যেখানে সমাবেশ ডাকে, সেখানে বাস, ট্রেন, লঞ্চ বন্ধ রাখার কী যুক্তি থাকতে পারে? দেশের সাধারণ মানুষ এমন রাজনৈতিক খেলা দেখতে চায়, যে খেলায় তারা জয়ী হবে, জনদূর্ভোগ হবে না, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে, সাধারণ জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। এমন খেলা দেখতে চায় না, যে রাজনৈতিক খেলায় কোন টগবগে তরুণ রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে মায়ের বুক খালি করবে, জনদূর্ভোগ বাড়বে, দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকবে, সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। তাই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি গণদাবি, তারা যেন শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করেন। তা নাহলে ভবিষ্যত প্রজš§ তাদের কখনো ক্ষমা করবে না।
এমনিতেই দেশের মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তদের নাভিশ্বাস অবস্থা। নিত্যপণ্যের দামের কষাঘাতে তারা জর্জরিত। অনেক পরিবারে দুবেলা চুলোয় ভাতের হাঁড়ি চড়ছে না। চাল-ডাল, তরিতরকারি কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছে। খিদে পেটে অনেক শিশু ঘুমাতে যায়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জরিপ বলছে, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ অবস্থায় রাজনীতি যদি বেসামাল হয়ে উঠে তাহলে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। এমনিতেই আগামী বছর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়, তখন চারদিকে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসতে বাধ্য। এ থেকে মুক্তি দিতে পারেন কেবলমাত্র রাজনীতিবিদরাই।
সম্ভবত ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন হবে। আশঙ্কা হচ্ছে, নির্বাচন আদৌ হবে কি না। সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে নির্বাচন না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। আমরা সবাই ১০০ ভাগ গণতন্ত্রী, কিন্তু তালগাছটা আমার, মনে এই ধান্দা থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হবে? নির্বাচন কমিশন ব্যস্ত ইভিএম নিয়ে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন কমছে। সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ইভিএমের জন্য গরিব মানুষের টাকায় মেশিনপত্র কেনার এই নবাবি বিলাসিতা কেন? গাইবান্ধায় ইভিএম দিয়ে নির্বাচন করাতে গিয়ে কী হলো? মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হলো।
সরকার যেহেতু নিজে ক্ষমতায় থেকে আরেকটি নির্বাচন করতে চায়, তাই দেশের জনগণ বা আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে আওয়ামী লীগের বোঝানো উচিত যে তাদের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি রয়েছে, বিরোধীদের সভা-সমাবেশের অধিকার রয়েছে এবং সরকার দমন-পীড়নের নীতি থেকে সরে এসেছে, এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকে আফসোসের ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে এসেও ভোটের দিনের জালিয়াতি এখনো গণতন্ত্রের প্রধান সমস্যা। সরকারি দল ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। সেটা তারা করতেই পারে, কিন্তু বিরোধী দলকে হামলা, হামলা, গৃহবন্দী করে সরকার নির্বাচনী পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে কীভাবে? একটি রাজনৈতিক সমাবেশ ঠেকাতে সরকার যে কতটা মরিয়া, তার প্রমাণ দেখা গেছে গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির আহুত সমাবেশকে ঘিরে। জনসভার একদিন আগে মাঝরাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আটক এবং পরে পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা ও উসকানি দেওয়ার অভিযোগে কারাগারে পাঠানোর মধ্য দিয়ে। একেবারে কোণঠাসা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় মরিয়া বিএনপির কাছে ১০ ডিসেম্বরের জনসভায় তেমন কোনো বাধাই মনে হয়নি। বরং সবরকম বাধা কাটিয়ে সমাবেশ আয়োজন করতে পেরে দল হিসেবে বিএনপি বেশ উজ্জীবিত।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন