এখন শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, বিশে^র অনেক মানুষ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন পথে যাবে তার ওপর নজর রাখছেন। এটি বাংলাদেশের জন্যও বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। সৌভাগ্য এই কারণে যে, বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেজন্যই আমরা দেখতে পাই, আমেরিকা বাংলাদেশকে সব সময় কাছে টানার চেষ্টা করছে। আরো দেখতে পাই, আমেরিকার সাথে সাথে পশ্চিমা বিশ^ ও মার্কিনপন্থী রাষ্ট্রগুলোও বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী। চীনও বাংলাদেশের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে চীন কতখানি নাক গলায় সেটি সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্যমান নয়। তবে চীন প্রভাব বিস্তার করে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে। অর্থনৈতিক সাহায্যের বিবেচনায় আমেরিকা এবং জাপান যেমন বাংলাদেশকে বিপুল অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়, তেমনি চীনও সাহায্য দেয়। তবে সাহায্যের ক্ষেত্রে চীন এখন বড় পার্টনার হলেও আমেরিকা এবং জাপানের চেয়ে পিছিয়ে আছে।
ভারত একটি বড় দেশ। দেশটির ভৌগোলিক আয়তনে অনেক বড় এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে উদীয়মান হলেও আমেরিকা, জাপান ও চীনের তুলনায় অনেক পেছনে। তারপরেও ভারত মনে হয় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। কারণ, বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারতের সীমান্ত। বাংলাদেশের পূর্ব দিকে সামান্য এলাকায় মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল বঙ্গপোসাগরের নীল জলরাশি দ্বারা বেষ্টিত। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমাতেও ভারত এবং বাংলাদেশের ভাগাভাগি রয়েছে। এসব কারণে আমেরকা, চীন ও জাপানের মতো ভারত তত বড় অর্থনৈতিক শক্তি না হওয়া সত্বেও ভারত বাংলাদেশের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি কারণ হলো, ভারতের সামরিক বাহিনী পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম। সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে ভারত অতি সহজেই পরাস্ত করতে পেরেছিল। সেই ৭১ সালের পর ৫১ বছর পার হয়ে গেছে। ভারতের জনসংখ্যা এখন ১৪০ কোটি। সামরিক শক্তিতে ভারত এখন চীনকে মোকাবেলা করার জন্য রাশিয়া এবং আমেরিকা উভয় বিশ^শক্তির নিকট থেকে দুই হাতে সমরাস্ত্র কিনছে। প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে পাকিস্তান এখন আর ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। তবে ড. এ পি জে আব্দুল কালাম যেমন ভারতকে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত করেছেন, তেমনি ড. আব্দুল কাদের খান পাকিস্তানকে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত করেছেন। ১৯৬৪ সালে চীন পারমাণবিক অস্ত্রে বিস্ফোরণ ঘটালে ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এর জবাবে ভারত ১৯৭৪ সালে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়।
তবে চীন কাশ্মীরের আকসাই চীন দখল করে। কিন্তু অরুণাচলের মতো সেই এলাকাটি ছেড়ে যায়নি। সেটি আজ চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। ভারত বলে যে সমগ্র কাশ্মীর তাদের অঞ্চল। এই দাবির মাধ্যমে সে বলতে চায়, যে অংশটি সে দখল করে আছে সেই অংশটি তো বটেই, এছাড়া পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আজাদ কাশ্মীর, গিলগিট ও বাল্টিস্তান এবং চীন অধিকৃত আকসাই চীনও তার অংশ। মুখে বলে যে কাশ্মীরের এই সমস্ত এলাকা তারা পুনরুদ্ধার করবে। তবে আকসাই চীন দখল করতে গেলে গণচীনের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে হবে। আবার পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত এলাকা দখল করতে হলে পাকিস্তানের সাথে পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িত হতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় কাশ্মীরের বর্তমান নিয়ন্ত্রণ রেখা ডিফ্যাক্টো আন্তর্জাতিক সীমানা হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
এসব কথা আমরা একারণে উল্লেখ করছি, বাংলাদেশকে নিয়ে এক অর্থে এই তিনটি বড় শক্তির রশি টানাটানি শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, ৭১ সালের পর সোভিয়েট ইউনিয়ন বাংলাদেশের ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ প্রদর্শন করেনি। বলতে গেলে দেশটি তার তৎকালীন ঘনিষ্ঠতম মিত্র ভারতের ওপর বাংলাদেশকে ছেড়ে দিয়েছিল। এছাড়া ১৯৯০ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গে ১৫ টি রাষ্ট্র হওয়ার পর রাশিয়া পরাশক্তির মর্যাদা হারায়। তার পরবর্তী দীর্ঘকাল ধরে ভেঙ্গে যাওয়া সোভিয়েট ইউনিয়নের বৃহত্তম উত্তরাধিকারী হিসাবে রাশিয়া অর্থনৈতিক উন্নয়ণ এবং হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত থাকে। গত ৩/৪ বছর হলো রাশিয়ার একচ্ছত্র নেতা ভøাদিমির পুতিন মনে করেন, রাশিয়া সোভিয়েট ইউনিয়নের মর্যাদা ও শক্তি অনেকখানি পুনরুদ্ধার করেছে। তাই দেখা যায়, সিরিয়াতে আমেরিকার পাল্টা রাশিয়াও বিমান হামলা করে। বস্তুত সিরিয়ায় রুশ হস্তক্ষেপের পরেই পতনোন্মুখ বাশার আল আসাদের সরকার টিকে যায় এবং আজও ঐ সরকার বহাল তবিয়তেই আছে। তারপর থেকেই দেখা যাচ্ছে, সুযোগ পেলেই রাশিয়া আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
॥দুই॥
ইউক্রেন যুদ্ধের পর সমগ্র বিশে^র দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। বরং আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা দু বছর আগে সরে যাওয়ার পর থেকেই বিশ^ রাজনীতিতে ৩৬০ ডিগ্রি পরিবর্তনের সূচনা হয়। আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়ায় আগের চেয়ে অনেক বেশি করে ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়ে। ভারতের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক মাখামাখি পর্যন্ত গেলেও জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর এই মাখামাখি কিছুটা কমেছে বলে মনে হয়। ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতীয় ভূমিকার পর আমেরিকা মনে করে, ভারত রাশিয়ার সাথে তার ৭৫ বছরের সম্পর্কে ফাটল ধরতে দেবে না। এইখানে ভারত ‘দুধও খাবো, তামাকও খাবো’, অর্থাৎ ‘গাছেরটাও খাবো আবার তলারটাও কুড়াবো’- এই নীতিতে দুই নৌকায় চড়ে থাকতে চায়। মনে হয়, আমেরিকা সেটি ধরে ফেলেছ। একটু আগেই বলেছি, আমেরিকা তার সমগ্র পররাষ্ট্র নীতির ফোকাস এশিয়াতে স্থানান্তর করেছে। আর এশিয়াতে সে চীনকে মোকাবেলা করার চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশকে কাছে পেতে চায়।
পাকিস্তানে আমেরিকার পথের কাঁটা ছিলেন ইমরান খান। পাক সেনাবাহিনী এবং মুসলিম লীগ ও পিপিপির সহযোগিতায় সে ইমরান খানকে হটাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে আমেরিকা তার পন্থী সরকার চায়। অন্তর্নিহিত কারণ যাই থাক না কেন, বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে, জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই দূরত্ব দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। চীনের নড়াচড়া এবং কথাবার্তায় দেখা যাচ্ছে সে এই সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এমন একটি পটভূমিকায় হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়া বাংলাদেশের ব্যাপারে কথা বলছে। ঢাকস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের শাহিনবাগ বাসায় গমনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার সম্পর্কে যখন টানাপোড়েন চলছে, যখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী পর্যায় পর্যন্ত মার্কিন বিরোধী কথাবার্তা বলা শুরু হয়েছে তখন হঠাৎ করে ঐ বিষয় নিয়ে রাশিয়া কথা বলেছে। ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে রুশ-মার্কিন বাক বিতন্ডার সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের শাহিনবাগ বাসায় গমন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। আমেরিকা পাল্টা জবাব দিয়েছে। বলেছে, ইউক্রেনে রাশিয়া যে হস্তক্ষেপ করেছে পিটার হাসের শাহিনবাগ গমন নিশ্চয়ই সেরকম হস্তক্ষেপ নয়। রাশিয়া বিগত বহু বছর ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে কথা বলেনি। কিন্তু এবার বলে উঠলো। তাহলে মেরুকরণটি কিভাবে হচ্ছে? রাশিয়া স্পষ্টতই বাংলাদেশকে সমর্থন করছে। চীন ঐভাবে সমর্থন না করলেও ভাবে সাবে এই সরকারের পেছনে তার সমর্থন আছে বলে বোঝা যায়। আর ভারত? ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক তো বহু পুরানো। ’৬২ সাল এবং পরবর্তী সময়ে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের কথা এখন আওয়ামী লীগ পন্থী অনেক বুদ্ধিজীবি তাদের পুস্তকে বা নিবন্ধে লিখে যাচ্ছেন। ভারতের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবি এবং সংবাদপত্র ঐ একই ধরণের কথা লিখে যাচ্ছেন।
॥তিন॥
ওপরে যা কিছু বলা হলো সেই আলোকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের ২০২৪ সালের জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন এবার শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক রাডারেও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আর সেই পটভূমিতেই বিএনপি এবং সমমনা দল ও জোটের ভূমিকা যেমন সেই রাডারে আসছে তেমনি আওয়ামী লীগের হার্ড লাইনও সেই একই রাডারে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
এই অবস্থায় বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল আগামী এক বছরে কী করবে? ১০ ডিসেম্বরের ঢাকার গণসমাবেশ এবং ৩০ ডিসেম্বরের গণমিছিলের পর আগামী ১১ জানুয়ারি বিএনপির গণঅবস্থানের কর্মসূচিতে মনে হয়, দলটি সরকারের পতন বা অপসারণের জন্য যে প্রবল দুর্বার আন্দোলনের প্রয়োজন হবে সেই ধরনের আন্দোলনে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। বরং দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালের পর ৩০ ডিসেম্বর মাঠে নামার সাথে সাথেই যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর সাথে পুলিশের বেশ কয়েক জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে। আর ঐ দিকে ৩০ ডিসেম্বরের গণমিছিলের সমাপ্তি ঘোষণার সময় বিএনপির অন্যতম নেতা আমানুল্লাহ আমান বলেছেন, আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যান। পথে কেউ কোনো ঝামেলা করবেন না।
আমানুল্লাহ আমানের এই বক্তব্যের সাথে কয়েক দিন আগে দেওয়া গয়েশ^র রায়ের বক্তব্য মিলে যায়। তিনি সেদিন বলেছিলেন, বিএনপি ধাপে ধাপে আন্দোলন করবে। এই ধাপে ধাপে আন্দোলন কত মাস চলবে সে সম্পর্কে কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। এমন আভাসও পাওয়া যায়নি, কত মাস পর বিএনপি কঠোর কর্মসূচী দেবে। বেগম খালেদা জিয়াকে যখন জেলে নেওয়া হচ্ছিল তখনও বলা হয়েছিল, নেতাকর্মীরা যেন শান্ত থাকে। নেতাকর্মীরা বিগত ৩ বছর হলো শান্তই আছে। এর ফলে বেগম জিয়ার কারাদণ্ডের কোনো হেরফের হয়নি। তার অসুখের চিকিৎসার জন্যও বিদেশ যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। তবে হ্যাঁ, কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে তিনি নিজ গৃহে বাস করার সুযোগ পাচ্ছেন। শর্ত হলো, স্পিকটি নট। এখনো তাই চলছে। বিএনপির ভূমিকা হলো, এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না এবং একটি কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে। আর সেই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে গেলে এই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। এপর্যন্ত বিএনপি যতগুলো সভা করেছে এবং যে গণমিছিল করেছে তার মাধ্যমে বিএনপি এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, জনসমর্থন তার পেছনে রয়েছে। কিন্তু তারপর? দেখা যায়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় কিছু ঘটার পর বড় বড় নেতা এবং বড় বড় মিডিয়া প্রশ্ন করেছে ডযধঃ হবীঃ? অর্থাৎ এরপর কী? বিএনপির ১১ জানুয়ারির গণঅবস্থানের কর্মসূচী শোনার পর অভিজ্ঞ রাজনৈতিক মহল প্রশ্ন করছেন, ডযধঃ হবীঃ? অর্থাৎ এরপর কী?
এটি একটি বিরাট প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ মহলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সচেতন রাজনৈতিক মহলেও একই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সময় খুব দূরে নয়, যখন বিএনপিকে এই প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন