অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া উত্তরের জীবন যাত্রা। দীর্ঘদিন থেকে উত্তরাঞ্চলের জনগণের আশার আলো নিভু নিভু। খরা, বন্যা ও দারিদ্রতার যাতাকলে নিস্পেষিত জনপদ। বিদ্যুতের লোডশেডিং আর লো-ভোল্টেজে অতিষ্ট। এই মহাযন্ত্রণা থেকে উত্তরণের জন্য বেক্সিমকো কোম্পানি লিমিটেডের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন যুগোপযুগি হিসেবে আশার আলো ছড়াতে যাচ্ছে। যেখানে বর্ষার পানিতে ডুবে থাকতো চরের জমি। গ্রীস্মের রোদে বাতাসে উড়ে যেতো বালু। দেখতে যেন শুধু ধবধবে সাদা বালুর আবরণ। এ বালু চরের আকার প্রতি বছর পরিবর্তন হতো বন্যায়। বেশিরভাগ সময়েই পতিত পড়ে থাকতো এই চরাঞ্চল। সেই চরাঞ্চলে কোনো আশার প্রদীপ জালানো ছিলো স্বপ্নের মতো অবাস্তব। সেই অবাস্তবকে বাস্তবে রুপ দিয়েছে বেক্সিমকো কোম্পানি লিমিটেড। সেই চরে উম্মোচিত হচ্ছে অন্ধকারে আশার আলো ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার দ্বার। উদ্বোধন হতে যাচ্ছে প্রতিদিন ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম দেশের সর্ব বৃহৎ সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র। উত্তরাঞ্চলের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণসহ নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়নের খোর্দ্দা ও লাটশালার চর গ্রামে বেক্সিমকো কোম্পানি লিমিটেডের অর্থায়নে “তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ লিমিটেড” নামে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। গত ৩০ নভেম্বর থেকে এ প্রকল্পের উৎপাদিত বিদ্যুৎ পরিক্ষামূলকভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে রংপুর গ্রিড সাবস্টেশনে। রংপুর গ্রিড সাবস্টেশন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানাসহ কৃষির উন্নয়ন হবে এ অঞ্চলের। উন্নয়নের গতি বাড়ার সাথে সাথে জীবন যাত্রার মানও বাড়বে বলে আশা স্থানীয়দের।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে জমি ক্রয়ের কাজ শুরু করে বেক্সিমকো কোম্পানি। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার নিভৃত পল্লী চরলাটশালা ও চরখোর্দ্দা গ্রামের ৬৫০ একর জমিতে গড়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে ৮৫ টি মাউন্টিং পাইলস। যার উপরে বিশেষ পদ্ধতিতে বসানো হয়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার সৌর প্যানেল। এসব সৌরপ্যানেল থেকে ১৬ টি ইনভার্টারের মাধ্যমে প্রতিদিন ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে এবং ১৬ টি ইনভার্টার স্টেশনের মাধ্যমে প্রতিদিন বিদ্যুৎ যাবে জাতীয় গ্রিডে। বক্স ট্রান্সমিশন স্থাপন করা হয়েছে দুইটি। নির্মাণ করা হয়েছে ১২০ কেভিএ ট্রান্সমিশন। ১৬ টি ইনভার্টার স্টেশনের মাধ্যমে ডিসি বিদ্যুৎ এসি বিদ্যুতে রুপান্তর হবে। সোলার প্যানেলে স্থাপন করা হয়েছে ট্রান্সফরমার। তিস্তা সোলার লিমিটেড-এর সকল টেকনিক্যালি কাজ শেষ হয়েছে। তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তির জন্য রংপুর সাবস্টেশন পর্যন্ত ১২২ টি টাওয়ারের মাধ্যমে স্থাপন করা হয়েছে ৩৪ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন। সবমিলে ১৮শ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানালেন এক কর্মকর্তা। গত ৩০ নভেম্বর থেকে এই সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ পরীক্ষামূলকভাবে রংপুর সাব স্টেশনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হচ্ছে। প্রথমেই বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা হবে রংপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট জেলার।
আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে বর্তমানে ৯০ থেকে ১৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। প্রকল্পটি চালু হলে ৭/৮ শ’ লোকের কর্মসংস্থান হবে। এরই মধ্যে স্থানীয়দের জীবন-যাত্রায় ছোঁয়া লেগেছে উন্নয়নের।
প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিন ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের টেকনিক্যালি সকল কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। আবহাওয়ার কারণে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন একটু কম হচ্ছে। আবহাওয়া ভালো হলে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বেশি উৎপাদন হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। ইনশাআল্লাহ চলতি জানুয়ারি মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হবে।
এব্যাপারে রংপুর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-১ এর সদর দপ্তরের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী হরেন্দ্র নাথ বর্মণের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিস্তা সৌরবিদ্যুতের উৎপাদিত বিদ্যুৎ পরিক্ষামূলকভাবে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। আপাতত: ৯০ মেগাওয়াট থেকে ১৪০ মেগাওয়াট পর্যন্ত যুক্ত হচ্ছে। এটা আবহাওয়ার কারণে কমবেশি হচ্ছে। তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ কতৃপক্ষ ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করছে। এ কর্মকর্তা আরও বলেন রংপুর বিভাগের ৮ টি জেলায় ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। তিস্তা সৌরবিদ্যুতের ২০০ মেগাওয়াট যুক্ত হলে প্রায় ৮ লাখ গ্রাহকের চাহিদা মিটবে। তবে গ্রাহকের সংখ্যা কম বেশি হতে পারে বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপর। তিনি আরও বলেন তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ থেকে দৈনিক ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন উত্তরাঞ্চলের জন্য মাইলফলক। এ ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হলে ঘন ঘন লোডশেডিং ও লো-ভোল্টেজ থাকবেনা। বিদ্যুৎ রংপুর থেকেই জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। প্রকল্পটি চালু হলে বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণসহ উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন