মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিদায় ফুটবলের রাজা পেলে

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো, যিনি পেলে নামেই অধিক পরিচিত ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৮২ বছর বয়সে কোলন ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। চার দশকেরও বেশি সময় আগে অবসর নেওয়ার পরেও সাবেক এই খেলোয়াড় সারা দুনিয়ায় এখনও সবচেয়ে পরিচিত ও সম্মানিত ফুটবলারদের একজন। মূলত তিনবার বিশ্বকাপ জয় করার জন্য পেলে বিখ্যাত হয়েছেন। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি এতবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন। এছাড়াও তিনি তার ক্লাব ও দেশের হয়ে ১,৩৬৩টি ম্যাচ খেলে মোট ১,২৮১টি গোল করেছেন যা বিশ্ব রেকর্ড।

ফুটবল খেলায় পেলে যে দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন সেটা মানুষের কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তার গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল খেলাধুলার বাইরের জগতেও। পেলে আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে খেলতেন। তাকে ফুটবলের রাজা বলা হয়। ব্রাজিলের হয়ে তিনি ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তিনি ব্রাজিলের জাতীয় দলের সর্বকালের সর্বাধিক গোলদাতা। পেলে ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের মিনাস জেরাইসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দন্দিনহো এবং মাতার নাম সেলেস্তে আরান্তেস। তার পিতাও একজন ফুটবলার ছিলেন ও ফ্লুমিনেস ফুটবল ক্লাবে খেলতেন। পেলে দুই ভাই-বোনের মধ্যে বড় ছিলেন এবং মার্কিন উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসনের নামানুসারে তার নাম রাখা হয়েছিল। তার পিতা-মাতা তাকে ‘এডসন’ বলে ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবারে তার ডাকনাম ছিল ‘জিকো’। বিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি ‘পেলে’ ডাকনামটি পান।

ধারনা করা হয়, পেলে নিজেই তার ডাকনামটি দিয়েছিলেন। তার কাছে তার পছন্দের ডাকনাম চাওয়া হলে তিনি স্থানীয় ভাস্কো দা গামার গোলরক্ষক বিলের নাম উচ্চারণ করেন। তবে তিনি ভুলভাবে উচ্চারণ করেন। পরে পেলে অভিযোগ জানালেও বিদ্যালয়ে তার ডাকনাম পেলে রয়ে যায়। পেলে তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে, নামটির অর্থ কী তা নিয়ে তার এবং তার পুরানো বন্ধুদের তখন কোনও ধারণা ছিল না। নামটি ‘বিলে’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এবং হিব্রু ভাষার এটির অর্থ ‘অলৌকিক’, এই দুইটি বিষয় ছাড়া পর্তুগিজ ভাষায় শব্দটির কোনও পরিচিত অর্থ নেই।

পেলে সাও পাওলো রাজ্যের বাউরুতে দারিদ্রের মাঝে বেড়ে ওঠেন। তিনি চায়ের দোকানে কাজ করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করতেন। তার বাবা তাকে ফুটবল খেলা শেখান। তবে তার ফুটবল কেনার সামর্থ্য ছিল না। ফলে তিনি মোজার ভিতর সংবাদপত্র, দড়ি বা আঙ্গুর ঢুকিয়ে বল বানিয়ে খেলতেন। পেলে তার যৌবনে বেশ কয়েকটি অপেশাদার দলের হয়ে খেলেছেন, যার মধ্যে রয়েছে সেট ডি সেতেমব্রো, ক্যান্টো দো রিও, সাও পাওলিনহো এবং আমিরিকুইনহা।

পেলে দুটি সাও পাওলো রাজ্য যুব চ্যাম্পিয়নশিপে বাউরু অ্যাথলেটিক ক্লাব জুনিয়রের নেতৃত্ব দেন। তাদের প্রশিক্ষক ছিলেন ওয়ালডেমার ডি ব্রিটো। পেলে তার মধ্য-কৈশোরে, রেডিয়াম নামক একটি ইনডোর ফুটবল দলের হয়ে খেলেন। সেই সময় বাউরুতে ইনডোর ফুটবল সবেমাত্র জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তিনি এই অঞ্চলের প্রথম ইনডোর ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। পেলে এবং তার দল প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপ এবং আরও বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতা জেতে। পেলের মতে, ফুটসাল কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। এটি ঘাসের উপর ফুটবল খেলার চেয়ে অনেক দ্রুত ছিল এবং পিচে প্রত্যেকেই একে অপরের কাছাকাছি থাকায় খেলোয়াড়দের দ্রুত চিন্তা করতে হত। পেলে, ক্রীড়ায় আরও ভালভাবে চিন্তা করতে সহায়তা করার জন্য ফুটসালকে কৃতিত্ব দেন। উপরন্তু, ফুটসালের কারণে তিনি ১৪ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে খেলতে পেরেছিলেন। তিনি যে টুর্নামেন্টগুলোতে অংশ নিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি টুর্নামেন্টে প্রথমে তাকে খেলার জন্য খুব কম বয়সী বলে ভাবা হয়েছিল, তবে পেলে শেষ পর্যন্ত ১৪ বা ১৫টি গোল করে শীর্ষ গোলদাতা হিসাবে উক্ত টুর্নামেন্ট শেষ করেন।

১৯৫৬ সালে পেশাদার ক্লাব সান্তোস এফসিতে খেলার জন্য ডি ব্রিটো পেলেকে সাও পাওলোর কাছে অবস্থিত শিল্প ও বন্দর শহর সান্তোসে নিয়ে যান। তিনি পেলেকে দেখিয়ে সান্তোসের পরিচালকদের বলেন যে, এই ১৫ বছর বয়সী ছেলে একদিন ‘বিশ্বের সেরা ফুটবল খেলোয়াড়’ হবে। পেলে এস্তাদিও ভিলা বেলমিরোতে ট্রায়ালের সময় সান্তোসের কোচ লুলাকে মুগ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালের জুনে পেলে সান্তোস ক্লাবে খেলতে ক্লাবটির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সেই সময় স্থানীয় গণমাধ্যমে পেলেকে ভবিষ্যতের সুপারস্টার আখ্যা দিয়ে বেশ প্রচার করা হয়।
১৯৫৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর করিন্থিয়ান্স দে সান্তো আন্দ্রের বিপক্ষে ১৫ বছর বয়সে পেলের অভিষেক ঘটে এবং ৭-১ ব্যবধানের জয়ে তিনি আকর্ষণীয় পারফরম্যান্স করেন। এই ম্যাচেই পেলে তার দীর্ঘ ও প্রফুল্ল কর্মজীবনের প্রথম গোলটি করেন। পেলে ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই মারাকানা স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন। ২-১ ব্যবধানে হারা সেই ম্যাচে ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে ব্রাজিলের পক্ষে প্রথম গোল করে পেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার স্থান দখল করেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে পেলে তার প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলেন। ১৯৫৮ সালের ফিফা বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের সেই ম্যাচটা ছিল প্রতিযোগিতার তৃতীয় খেলা। সেই বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ এবং তখন পর্যন্ত যেকোন বিশ্বকাপ খেলায় সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় পেলের সতীর্থ ছিলেন গ্যারিঞ্চা, যিতো এবং ভাভা। ওয়েলসের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে করা গোলটি ছিল প্রতিযোগিতায় পেলের প্রথম এবং সেই ম্যাচের একমাত্র গোল, যার সাহায্যে ব্রাজিল সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। ম্যাচের সময় পেলের বয়স ছিল ১৭ বছর ২৩৯ দিন, যা বিশ্বকাপের গোলদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে কম। ১৯৬৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্যায়ের ১ম খেলায় বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে জয়ী হলেও হাঙ্গেরীর বিরুদ্ধে ২য় খেলায় ব্রাজিল হেরে যায়। এর পূর্বে বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে জয়ী হলেও তিনি গুরুতর আঘাত পান। তারপরও কোচ ভিসেন্তে ফিওলা সকলকে আশ্চর্যান্বিত করে গ্রুপের শেষ খেলায় পর্তুগালের বিপক্ষে পেলেকে মাঠে নামান। তিনি পুরো রক্ষণভাগ পরিবর্তন করে ফেলেন। এমনকি গোলরক্ষকও বাদ পড়েননি। আক্রমণভাগে তিনি পরিবর্তিত দুজন খেলোয়াড়কে দেন। মধ্যমাঠে তিনি প্রথম খেলার ন্যায় সাজান। যদিও তিনি জানতেন যে, পেলে তখনো তার মারাত্মক জখমকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

পেলের সান্তোস এফসি ফুটবল ক্লাব ছিল ষাটের দশকে বিশ্বের জনপ্রিয় ক্লাবগুলোর একটি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে এই ক্লাবটি প্রীতি ম্যাচে অংশ নিতো। এই খ্যাতির কারণে তারা বাড়তি কিছু সুবিধাও পেয়েছিল। এরকম একটি প্রীতি ম্যাচ ছিল যুদ্ধ-বিধ্বস্ত নাইজেরিয়ায়, ১৯৬৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। বেনিন সিটিতে অনুষ্ঠিত ওই খেলায় সান্তোস ২-১ গোলে স্থানীয় একাদশকে পরাজিত করে। নাইজেরিয়াতে তখন রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ চলছিল। দেশ থেকে বায়াফ্রা রাজ্যটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে নাইজেরিয়াতে খেলোয়াড়দের পাঠানোর ব্যাপারে ব্রাজিলের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক দুশ্চিন্তা ছিল। সেকারণে বিবদমান পক্ষগুলো তখন যুদ্ধবিরতিতে যেতে সম্মত হয়।

১৯৭০ সালে আগের বিশ্বকাপের ব্যর্থতা মুছে ফেলে আবারও শিরোপা জিতে নেয় ব্রাজিল। টানা চারটি টুর্নামেন্টের তিনটিরই ট্রফি ওঠে তাদেরই হাতে। পেলে খেলেন তার চতুর্থ বিশ্বকাপের শেষটি। প্রতিটা ম্যাচে গোল করেন জেয়ারজিনহো। ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে গুঁড়িয়ে দেয় ক্যাপ্টেন কার্লোস আলবার্তো। দল তিনবার শিরোপা জেতায় জুলে রিমে ট্রফিটা একেবারেই দিয়ে দেওয়া হয় ব্রাজিলকে। সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন পেলে। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের পর নিজেকে সর্বকালের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করেন পেলে।

ব্রাজিলের অন্যান্য ফুটবলার বিদেশি ক্লাবে খেললেও পেলের ক্যারিয়ারের সোনালি সময়ে তাকে বাইরে খেলতে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। পেলেকে নেওয়ার জন্য সান্তোস এফসিকে প্রস্তাব দিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ থেকে শুরু করে এসি মিলানের মতো ক্লাবও। পেলেকে ব্রাজিলে রেখে দেওয়ার জন্য চাপ ছিল সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও। ১৯৬১ সালের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জানিও কোয়াদ্রস পেলেকে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাকে ‘রপ্তানি করা যাবে না’ বলে একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন। পেলে পরে অবশ্য একটি বিদেশি ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন শুধুমাত্র ১৯৭৫ সালে। সেসময় তিনি যোগ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফুটবল ক্লাব নিউ ইয়র্ক কসমসে।

১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই তিন বছর তিনি ব্রাজিলের ক্রীড়া মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় তার নেতৃত্বে কিছু আইন তৈরি হয়েছিল যাতে পেশাদার ফুটবলারদেরকে ক্লাবের সঙ্গে দর কষাকষির ব্যাপারে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, যা তার নিজের প্রজন্মের ফুুটবলারদের ছিল না। ২০১৬ সালে পেলের জীবন কাহিনী নিয়ে ‘পেলে: বার্থ অব অ্যা লিজেন্ড’ নামক একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এই চলচ্চিত্রে তার জীবনের উত্থান-পতন ও সকল অর্জনগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন