দেশে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ কোটির উপরে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ কোটির বেশি। উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৯ লাখের বেশি। আলিয়া মাদরাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। কওমী মাদরাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। তার মানে হলো দেশে অধ্যয়নরত তরুণ শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ কোটি। অন্যদিকে শিক্ষিত তরুণ বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। অর্থাৎ দেশের মোট জনশক্তির অর্ধেকই তরুণ ও শিশু। আর এ কথা স্পষ্ট যে, একটা দেশের মূল চালিকাশক্তি হলো এ শিশু ও তরুণরা। কিন্তু আজ এ শিশু ও তরুণদের শক্তির বড়ো একটি অংশ হতাশাগ্রস্ত। ঠিকমতো হাঁটতে শিখার আগেই আমাদের শিশুদের স্কুলে ভর্তি করা হয়। স্কুলে ভর্তি করার পর তার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয় মস্তবড় এক ভারী ব্যাগ। আত্মস্থ ও মুখস্ত দুটি শব্দ একাডেমিক অঙ্গনে সকলের কাছেই পরিচিত। আর শিক্ষিতজন মাত্রই এটা জানেন যে, পড়াশুনার ক্ষেত্রে আত্মস্থ শব্দটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ শব্দটি মুখস্ত শব্দ থেকে অনেক বেশি টেকসই। শব্দটির মহিমা অনেক ব্যাপক হওয়া সত্ত্বেও শিশু শিক্ষার্থীদের সাথে এ শব্দটির পরিচিতি নেই বললেই চলে। শব্দটি আজ অবদি অজ্ঞতার নিচে চাপা পড়ে রয়েছে। আমাদের শিক্ষকগণ গুরুত্বপূর্ণ এ শব্দটি নিয়ে কোনো কথা বলেন না। শ্রেণীকক্ষে শিশুদের এ বিষয়ে তেমন কোনো গুরুত্বই দেয়া হয় না। বিপরীতে মুখস্ত শব্দ দিয়েই শিশুর মেধা যাচাই করা হয়। কোটি কোটি শিশুকে ইংরেজি ও বাংলা বর্ণমালা মুখস্ত করানো হয়। আর এ মুখস্ত বিদ্যার মাধ্যমেই তাদের মেধা যাচাই করা হয়। এ মুখস্ত বিদ্যা দিয়েই তাদের মূল্যায়ন করা হয়। বুদ্ধি, বিচক্ষণ বা সৃজনশীলতা দিয়ে তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। আমাদের দেশে যার যত মুখস্তশক্তি বেশি সে ততো বেশি মেধাবি হিসেবে বিবেচিত। এভাবে একটি শিশু ৩ বছর বয়স থেকেই বর্ণমালা মুখস্ত করতে থাকে। বর্ণমালার পাশাপাশি তারা কবিতাবিদ্যাও মুখস্ত করে থাকে। শিশুটি হাঁটতে শেখার আগেই কবিতা ও ছড়া মুখস্ত করে ফেলে। শিশুটির বাবা-মা আহ্লাদে গদগদ হয়। বাবা-মা গর্ব ও পুলকিত অনুভব করেন। তারা গর্ব করে বলেন, ‘আমার সন্তান হাঁটতে শেখেনি কিন্তু দেখো, এটুকু বয়সে কত সুন্দর ছড়া মুখস্ত বলতে পারে’!
সন্তানদের কবিতা শিখানোর মাধ্যমেই আমাদের অভিভাবকগণ তাদের কৃতিত্ব জাহির করেন। মূলত এখানেই শিশুর মেধা অর্ধেক পচে যায়। মুখস্তবিদ্যা মেধার বাহক নয়, ধারকও নয়। ‘আত্মস্থ’ শব্দটি মেধার ধারক ও বাহক হলেও এটির সঙ্গে শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটে কলেজে ভর্তি হবার পর! অর্থাৎ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিশুটির সাথে আত্মস্থ শব্দের পরিচয় ঘটে না। একটি শিশু এ মুখস্ত শব্দটির সাথে জড়িয়ে থাকে দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর পর্যন্ত। ফলে আমাদের শিশুরা মুখস্ত শব্দ থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। এ শিশুরা যখন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখনও তারা এ বিদ্যাটাকে গলাধকরণ করতে থাকে। তারা বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি হয়েই বিসিএস-এর প্রস্তুতি নিতে থাকে। সেখানেও আত্মস্থ করার কোনো বালাই নেই। শুরু হয় বিসিএস গাইড মুখস্তের নির্মম প্রতিযোগিতা! ফলে আমাদের শিশুরা বড় হয়ে দাপুটে আমলা হয়। তারা এক সময়ে প্রভাবশালী লুটেরাতে পরিণত হয়। দেশের জন্য তারা সেবক না হয়ে নৈতিকতা বিবর্জিত শাসকে পরিণত হয়। তাদের মধ্যে ন্যূনতম দেশপ্রেম থাকে না। তারা দেশের গরিব মানুষের কথা ভাবে না। দেশের ঘামঝরা মেহনতি মানুষের অর্জিত টাকা দিয়ে তারা বিলাসিতায় লিপ্ত হয়। ঠিক এ কারণে দেশে ৫১ বছরেও একজন বিশ^মানের বিজ্ঞানী তৈরি হয়নি। মূলত দেশে শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণ বরাবরই অবহেলিত রয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৫ দশকেও একটি টেকসই শিক্ষানীতি তৈরি হয়নি। উল্টো আমাদের শিক্ষা কারিকুলামকে নানাভাবে টানা-হেঁচড়া করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা ইচ্ছেমত এটাকে কাটাছেঁড়া করেছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সময় গড়ালেও এক অজানা কারণে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী কোনো সরকারই এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় হ য ব র ল অবস্থা বিরাজমান। আমাদের শিশুরা একদিকে বইয়ের চাপে নুয়ে পড়ছে। অন্যদিকে মুখস্তবিদ্যার কারণে মেধাহীন হয়ে যাচ্ছে। জিপিএ-৫ প্রাপ্তিকেই মেধার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে যে তাদের মেধাকে ধ্বংস করা হচ্ছে, আমরা সেদিকে খেয়াল রাখছি না। আবার জীবনমুখী শিক্ষা না থাকায় তারা বেকারত্বের কষাঘাতে জর্জরিত হচ্ছে। বিশ^বিদ্যালয়গুলো আজ নীতিহীন রাজনীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। দেশ সেরা বুয়েট আজ আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরীহ, মেধাবী আর ভদ্র ঘরের সন্তানরা বুয়েটে ভর্তি হতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষকগণও আজ সবচেয়ে অবহেলার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে তারা নানাভাবে নাজেহাল হচ্ছেন। তারা প্রহৃত হচ্ছেন, এমনকি তাদের নির্মমভাবে হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে। এসবই আমাদের শিশুশিক্ষার দৈন্যের ফল।
আমরা আমাদের বাচ্চাদের সারাদিনই বই নিয়ে পড়ে থাকতে বলি। প্রাথমিকের একজন বাচ্চাকে স্কুল থেকে হোমওয়ার্ক দেয়া হয়! বাচ্চাটি যখন হোমওয়ার্ক প্রস্তুত করতে ব্যস্ত তখন বাসায় হাজির হন গৃহ শিক্ষক! বাচ্চাটির খেলা ও বিশ্রামের কোনো সুযোগ নেই। শুধু পড়া আর পড়া। পড়া না পারলে তাকে জোর করে আমরা মুখস্ত করাই, গলাধকরণ করাই! বুঝা ও আত্মস্থ করার কোনো বালাই নেই। ফলে আমাদের শিশুরা গণিতের মতো বিষয়ও মুখস্ত করে। কারণ, সামনে পরীক্ষা আসন্ন। পরীক্ষায় তো পাস করতে হবে। পেতে হবে জিপিএ-৫। শিশুটির মাথায় অনেক চাপ। তাই মুখস্ত ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। এভাবে আমরা আমাদের শিশুদের শিখাতে গিয়ে মাথা নষ্ট করছি। আমরা আমাদের শিশুদের মেধা, মননশীলতা ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে বাধাগ্রস্ত করছি, তাদের সুকুমারবৃত্তিকে এভাবেই আমরা তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের সম্বিত ফিরে আসছে না!
আমাদের দেশকে আমরা উন্নত করতে চাচ্ছি কিন্তু শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছি না। কোনো দেশকে উন্নত করতে চাইলে আগে শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। কোনো দেশের উন্নতির পূর্ব শর্তই হলো শিক্ষাকে উন্নতি করা, শিক্ষাকে জীবন ও কর্মমুখী করা। শিক্ষাকে উন্নত করা মানেই জাতিকে উন্নত করা। আর জাতির সামগ্রিক উন্নতিই হলো দেশের উন্নতি। শুধু রাস্তাঘাট উন্নতি করে দেশের উন্নয়ন হয় না। মেট্রোরেল ও সেতু নির্মাণ কোনো দেশের উন্নয়নের মাইলফলক হতে পারে না। এটা উন্নয়নের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। অথচ, এগুলো নিয়ে আমরা মাত্রাতিরিক্ত উৎসব-আয়োজন করছি। অথচ, আগামী দিনের দেশনায়কদের আমরা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে চলেছি।
ইউনিসেফের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে ১০ লাখ পথশিশু রয়েছে। তবে প্রকৃত হিসাবে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। অন্য এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে পথশিশুর সংখ্যা ২৫ লাখ। এদের মধ্যে ২০ লাখেরই শীতের কাপড় নেই। ১০ লাখ শিশু আছে, যাদের শুবার ঘর নাই। তারা রাস্তায় আয় করে, রাস্তায় ব্যয় করে এবং রাস্তায়ই ঘুমায়। ৯ লাখ এমন শিশু আছে, যাদের টয়লেট ও গোসলখানা নেই। এসমস্ত শিশু উন্মুক্ত জায়গায় মলত্যাগ করে। ৬ লাখ শিশু অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকলেও তাদের দেখার কেউ নেই।
এসব পথশিশুর অনেকের বাবা-মা নেই। অনেকের বাড়িতে খাবার নেই। অনেকের ভিটেমাটি নেই। কারো বাবা-মা মাদকাসক্ত। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে। অনেকে সংসার চালাতে পারে না। এমতাবস্থায় এসব পরিবারের শিশুরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। এদেরে সাধারণত পথশিশু বলা হয়ে থাকে। দেশে ১০ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ দরিদ্র। তারা শিশুদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারে না। তারা শিশুদের ঠিকমতো খাবার দিতে পারে না। এসব শিশু দৈনন্দিন মৌলিক অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকে। ছিন্নমূল এসব শিশু এ বয়সেই জীবন সংগ্রামের কঠিন পথ বেছে নেয়। তারা কঠিন এ পথে এসে নানা ধরনের পেশায় জড়িয়ে পড়ে। এসব পেশার মধ্যে অন্যতম হলো ফুল বিক্রি, বিড়ি বিক্রি, রিকশা চালানো, হকারি করা, কুলিগিরি, বুননকর্মী, হোটেল শ্রমিক, মাদকবাহক, আবর্জনা সংগ্রাহক, লোহা ঝালাই ইত্যাদি। এসব পথশিশু ছোটোবেলা থেকেই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। সকাল ৮টা থেকে ১২-১৩ ঘণ্টা কাজ করে। এসব শিশুশ্রমিক মাসে সর্বোচ্চ ৫০০-৬০০ টাকা আয় করে। মালিকপক্ষের কাছে ন্যূনতম কোনো মানবিক দাবি তুলতেই তাদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। এসব শিশুদের অধিকাংশই নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ছেলে শিশুদের রাজনৈতিক মিছিল, শোডাউন, হরতালে পিকেটিং, ভাংচুর ও ককটেল নিক্ষেপে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর মেয়ে শিশুদের অল্প বয়সেই পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত হতে বাধ্য করা হচ্ছে।
আমাদের দেশে প্রতি মিনিটে শিশু বৃদ্ধির হার ৪.২ জন করে। ঘণ্টায় বৃদ্ধি পাচ্ছে ২৫৩ জন করে। মাসে বৃদ্ধি পাচ্ছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১০০ শিশু। আর বছরে যুক্ত হচ্ছে ২২ লাখ নতুন শিশু। আমাদের দেশে এ নতুন শিশুদের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। উল্টো প্রত্যেকটি শিশু ৬০ হাজার টাকা বাজেট ঘাটতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। আমাদের সংবিধানে সকল নাগরিকের অধিকারের কথা বলা থাকলেও এসব শিশু সকল অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। সরকার ‘পথশিশুদের উন্নয়ন কার্যক্রম’ নামে একটি সংগঠন পরিচালনা করছে। এটি তাদের জন্য একটি ‘শেল্টার হোম’ হলেও প্রয়োজনের তুলনায় সেটি মোটেই যথেষ্ট নয়। পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় সেখানে তারা থাকতেও চায় না। তারা যেহেতু স্বাধীনভাবে চলতে অভ্যস্ত। তারা শেল্টার হোমের নিয়ম কানুনও বোঝে না। এসব শিশু তাদের বাবা-মায়ের নাম পর্যন্ত বলতে পারে না। সঠিক ঠিকানাটাও তারা জানে না। ফলে তাদের জন্মনিবন্ধনও করা যায় না। ফলে অনাগত এসব শিশু সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।
দেশে বেকারত্ব হু হু করে বাড়ছে। শিক্ষিত শিশু ও তরুণরা দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ কোটি ৫৫ লাখই দরিদ্র। তারা একবেলাও ঠিকমত পেট ভরে ভাত খেতে পায় না। দেশে ভয়ঙ্কর বৈষম্য বিরাজ করছে। চরিত্র গঠনের সকল উপাদান বিদায় করা হয়েছে। বিপরীতে চরিত্র নষ্টের সকল উপাদান আমদানি করা হয়েছে। কাদের জন্য, কোনো কারণে এবং কেনো এগুলো করা হচ্ছে, এসব প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণভাবে অজানাই রয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের মনের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা জন্ম নিয়েছে। দেশে বন্যার মতো ধেয়ে এসেছে পর্নোগ্রাফির অনৈতিক ছোবল। এ ছোবলে আক্রান্ত হয়ে নির্জিব হয়ে পড়েছে উঠতি বয়সি শিশু ও কিশোর। তাদের মাঝে লুকায়িত সৌর্যবির্য অনৈতিক অস্থিরতায় রূপ নিয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীতে প্রাথমিকে পড়া শতকরা ৯৪ শতাংশ শিশু পর্নোগ্রাফির ছোবলে দিশেহারা। এ ছোবলে শুধু শিশু কিশোররাই নয়, মধ্যবয়সী বুড়ো-বুড়িরাও এরোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। পর্নোগ্রাফির পাশাপাশি দেশে যুক্ত হয়েছে মাদকের মহোৎসব। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ মাদকের মরণ নেশায় মত্ত হয়ে পড়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১ কোটি। তবে প্রকৃত হিসাবে এ সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি। ১৮ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। এদের মধ্যে ৭ থেকে ১৮ বছর বয়সী মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ! আর বর্তমানে মাদক সেবক শিশুর সংখ্যা অগনিত। আগের কালে মাদকদ্রব্য সাধারণত নাগালের বাইরে ছিল। রাজধানী এবং বিশেষ শহরগুলোতে এটা অতি গোপনে সরবরাহ হতো। কিন্তু বর্তমানে এটা দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে। এটা এখন অতি সহজলভ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। শহরকে ছাপিয়ে এটা এখন নিভৃত পল্লীতেও বিস্তার ঘটেছে। বিশ^বিদ্যালয়ের হলগুলোতে এখন মাদকের ব্যবসা জমজমাট আকার ধারণ করেছে। তরুণ-তরুণীরা মাস্টার্স পাশ করে এখনও কোনো চাকরি পায়নি। তারা বাড়ির সবার কাছে বোঝায় পরিণত হয়ে পড়েছে। তাই বাড়িতে না গিয়ে বড় ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের হলে অবস্থান করছে এবং ইয়াবার ব্যবসার মাধ্যমে আয় উপার্জন করছে! কলেজগুলোতেও চলছে একই অবস্থা। স্কুলগুলোতেও একইভাবে মাদকের ছোবল চলমান রয়েছে। কিছু শিশু মাদক থেকে দূরে থাকলেও তাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। তাদের ইয়াবা ও মাদক সেবনে নানাভাবে বাধ্য করা হচ্ছে। যারা মাদককে এড়িয়ে চলতে চায় তাদের মাদকসেবীরা ‘আনস্মার্ট’, ‘গেয়ো’ ও ‘খ্যাত’ বলে অপমান করছে। এ লেখকের সাথে একাধিক শিশু যুক্ত হয়ে তাদের মতামত পেশ করেছে। তারা উল্লেখিত সকল অনিয়ম-অনাচারকে জাতীয় উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে মত প্রকাশ করেছে। কোমলমতি শিশুরা এসব অসংগতির নিরসন চায়। তারা আনন্দের জন্য পড়তে চায়। ভালো লাগা ও ভালো মানুষ হবার জন্য পড়তে চায়। তারা লেখাপড়াকে উন্নত বিশে^র মতো বিনোদন নির্ভর পেতে চায়। পরীক্ষা ও মুখস্ত নির্ভর লেখাপড়ার চাপ থেকে তারা বেরিয়ে আসতে চায়। তারা সকলেই জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা চায়। তারা নৈতিকতা ও ধর্ম শিক্ষার বাস্তবায়ন দেখতে চায়। তারা পরিবার, জাতি ও দেশের জন্য বোঝা হতে চায় না, বরং তারা সম্পদ হতে চায়। নতুন বছরে শিশু শিক্ষার্থীদের এ প্রত্যাশাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা দরকার। এ বিষয়ে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের অনিবার্য দাবি।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দা’ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
dr.knzaman@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন