বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আসামে মাদরাসা শিক্ষার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০২ এএম

মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান মাদরাসা। মাদরাসা শিক্ষা, একটি সুপ্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা। শত শত বছর ধরে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অন্যান্য দেশে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হচ্ছে। উপমহাদেশে যখন ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হয়নি, তখনও মাদরাসা শিক্ষা ছিল। তখন মাদরাসা শিক্ষাই ছিল আধুনিক শিক্ষা। ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, অর্থশাস্ত্র, গণিত, বিজ্ঞান, তর্কশাস্ত্র থেকে শুরু করে যুগোপযোগী শিক্ষাদানের ব্যবস্থা মাদরাসাগুলোতে চালু ছিল। শাসকবর্গের আনুকূল্য ছিল। মাদরাসা থেকে শিক্ষিত ডিগ্রিধারীরাই সরকারি উচ্চপদে চাকরির সুযোগ লাভ করতেন। ফার্সি ভাষা ছিল শিক্ষার মাধ্যম, সরকারি কাজের ভাষাও। তাই, রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল মাদরাসা শিক্ষা। ধর্মনির্বিশেষে সকলেই সরকারি চাকরি বা শিক্ষিত হওয়ার জন্য ফারসি মাধ্যমে পড়াশোনা করত।
রামমোহন রায় থেকে শুরু করে তৎকালীন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ ফারসি ভাষায় সুপ-িত ছিলেন। কিন্তু ১৮৩৭ সালে এক আদেশে ব্রিটিশ বেনিয়া সরকার সরকারি ভাষা হিসেবে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি বলবৎ করল। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৮৪৪ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ আরেক নির্দেশে ফারসি ভাষায় শিক্ষিত মুসলমানদের সরকারি চাকরি প্রাপ্তির আশায় শেষ পেরেকটি পুঁতে দিল। মাদরাসা শিক্ষার প্রতি ব্রিটিশ বেনিয়ারা আতঙ্কিত ছিল। কারণ, মাদরাসা শিক্ষিতরাই বেশি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
৫৭ হাজার আলেম দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন। আন্দামানের বিখ্যাত সেলুলার জেলটিই তৈরি হয়েছিল মাদরাসা শিক্ষিত মুসলিম স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের অন্তরীন করে রাখার লক্ষ্যে! ভারতের একমাত্র নিহত বড়লাট, লর্ড মেয়ো; তাঁকে ১৮৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আন্দামানেই ছুরি দিয়ে হত্যা করেছিলেন শের আলি খান। তখনও সেলুলার জেল তৈরি হয়নি।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে মাদরাসার ভূমিকা অপরিসীম। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে-সকল জাতীয় মুসলিম নেতা অসামান্য অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেই মাদরাসার শিক্ষক অথবা ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিখ্যাত দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণই ছিল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করা। দেওবন্দ মাদরাসার অনুকরণে ভারতের প্রতিটি অঞ্চলে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একদা। আজও সেই সকল মাদরাসা শিক্ষা দিয়ে চলেছে। তৎকালে আসামের করিমগঞ্জের বাগবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাগবাড়ি মাদরাসা। এ মাদরাসাসহ অন্যান্য মাদরাসা এখনকার ভারতে ইসলামি মূল্যবোধের শিক্ষাদান করে আসছে, সাম্প্রদায়িক সদ্ভাব ও দেশের অখ-তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে।
সুলতানী ও মোগল যুগে মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল, বলাই বাহুল্য। ব্রিটিশ শাসকবর্গ সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটিয়েছিল রাজত্ব হারানোর ভয়ে। কারণ, মাদরাসা শিক্ষিতরাই বেশি ব্রিটিশবিরোধী ছিল সমগ্র আঠারো শতক ও উনিশ শতক জুড়ে। বিশ শতকে এসে স্বাধীনতা আন্দোলন একটি সর্বজনগ্রাহ্য আদল পায়। কংগ্রেস ও জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের যৌথ আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাদরাসাগুলোর অপরিসীম অবদান, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের অসামান্য আত্মবলিদান কিছুটা অলক্ষে চলে গেলেও মাদরাসা শিক্ষার প্রতি কোনও সরকারের বিরূপ মনোভাব কোনও দিন লক্ষ করা যায়নি। মুসলিমসহ সে দেশের অসংখ্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার সাব্যস্ত করে সংবিধান আর্টিকল ত্রিশ-এ সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের অধিকার দিয়েছে। মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, মক্তব, মসজিদ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা মুসলিমদের সাংবিধানিক অধিকার। সরকার চাইলেই তা বন্ধ করে দিতে পারে না। এটা মুসলমানদের মৌলিক অধিকার।
সংবিধান হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ। শেষ আশ্রয়। কিন্তু আজকাল গণতন্ত্র নিজেই বিপন্ন। সংবিধানের উপর বারবার সংশোধনী এনে সংবিধানের উদ্দেশ্যকেই জলাঞ্জলি দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে বর্তমান ভারতে। এমতাবস্থায় সংবিধানের পক্ষে সংসদে নীরবে অশ্রুপাত করা ছাড়া গত্যন্তর কী! কারণ, এখন গণতন্ত্র মানে, জোর যার মুল্লুক তার !
ইরাকের ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন নিহত হওয়ার পর ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, সাদ্দাম হোসেন ভারতে বিক্রিত তেলের রয়ালটি থেকে একটি ক্ষুদ্র অংশ ভারতের মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করতেন। এভাবে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র তাদের বিক্রি করা তেলের রয়ালটি থেকে একটি ক্ষুদ্র শেয়ার ভারতের মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় করে থাকেন। সেই অর্থ থেকেই মুসলিমদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকারি অনুদান প্রদান করা হয়ে থাকে। এমতাবস্থায়, অর্থের অভাব দেখিয়ে আসামের মাদরাসাগুলো বন্ধ করার তোড়জোড় ব্রিটিশ বেনিয়াদের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। আসামের বর্তমান রাজ্য সরকারের মাদরাসা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব সমগ্র দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে, সন্দেহ নেই। শত শত শিক্ষক ও হাজার হাজার ছাত্র বিপদগ্রস্ত হবে। সরকারি চাকরির বাজার আরও সঙ্কুচিত হবে। তাই, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা দরকার, যাতে সরকারি মাদরাসাগুলো আগের মতো স্বমহিমায় বহাল থাকে।
রাজ্যের ব্যাপক সংখ্যক দরিদ্র ও নি¤œবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের নিকট সরকারি মাদরাসাগুলো এখনও ভরসার স্থল। সীমিতসংখ্যক হলেও সরকারি মাদরাসা থেকে পাশ করেও পড়ুয়ারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার গৌরব অর্জন করছে। তাই, পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎকে নিয়ে এভাবে টানাহ্যাঁচড়া না করে তাদের দেশের সুনাগরিক ও জনসম্পদে রূপান্তরিত করা হোক, এটাই আসাম তথা ভারতের মুসলমানদের প্রাণের দাবি। আমাদের বিশ্বাস, বৃহত্তর স্বার্থে রাজ্য সরকার তা বিবেচনা করবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন