এ কথা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না, স্বাধীনতার পর দেশে সুস্থ রাজনীতির বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা ঘটেছে এবং ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদলের গঠনমূলক সমালোচনা ও পারস্পরিক সহবস্থানের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। বরং এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য, ক্ষমতাসীন দল মানে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। অন্যদিকে, বিরোধীদল মানেই ক্ষমতাসীন দলের নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে পড়া। নানা অপবাদ দিয়ে বিরোধী রাজনীতি ও মতকে দমন করাই যেন ক্ষমতাসীন দলের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে থাকে। ’৯১ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ছাড়া ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলকে কখনোই কোনো বিষয়ে একমত হতে দেখা যায়নি। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তো এক ধরনের বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য এবং বিরোধী দলীয় রাজনীতি তার বৃত্তের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। বছর খানেক আগে তো আরও খারাপ অবস্থা ছিল। বিরোধীদলের রাজনীতি বলতে কিছু ছিল না। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় বিশ্বকে দেখানোর জন্য বিরোধীদলকে বৃত্তবন্দী অবস্থায় কিছুটা মিছিল-মিটিংয়ের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তবে বিরোধীদলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও মামলা-মোকদ্দমা সমান তালেই চলছে। এটাও বিরোধীদলকে দমন করার নতুন এক কৌশল। কারণ, একটি দলের প্রধান এবং মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা জেলে থাকলে সেই দল নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মী যতই আগ্রহী ও উদগ্রীব হোক না কেন, তাদের সামনে যদি প্রধান নেতৃত্ব না থাকে, তাহলে তাদের আগ্রহে ভাটা পড়া স্বাভাবিক। যেমন ক্ষমতাসীন দলের এক নম্বর ও দুই নম্বর নেতৃত্ব কিংবা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো কেউ যদি না থাকে, তাহলে মিছিল-মিটিংয়ে যে প্রাণ থাকা দরকার, তা কি থাকে? বর্তমান বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপি’র ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেটা হচ্ছে, দলটি বছরের পর বছর ধরে প্রধান নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত থেকে তার নেতাকর্মীর মধ্যে এখন মধ্যম সারির নেতৃবৃন্দকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। দলের কর্মসূচি থাকলেই যোগ দিচ্ছে, সেখানে কোন বড় নেতা থাকল কি থাকল না, তা বিবেচনায় নিচ্ছে না। তা নাহলে, দলটির যেকোনো মিছিল-মিটিংয়ে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি থাকত না। বলা যায়, দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটি স্বপ্রণোদিত ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছে। দলটির মহাসচিবসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতা গ্রেফতার হয়ে জেলে যাওয়ার পর যে কয়টি মিছিল-মিটিং হয়েছে এবং সর্বশেষ যে গণমিছিল হয়েছে, তাতে বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতিই তা প্রমাণ করে। এমনকি, পুলিশের লাঠিপেটা, গুলি ও গ্রেফতারকেও তারা এখন খুব একটা আমলে নিচ্ছে না। ইতোমধ্যে পুলিশের গুলিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির নেতা-কর্মীর মৃত্যুও তাদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করতে পারেনি।
দুই.
ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা হচ্ছে, ইচ্ছে করলে যা খুশি তা করতে ও বলতে পারে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করে নিজে পুলিশ বেষ্টনির মধ্যে থেকে অবারিত মিছিল-মিটিং ও সভা-সমাবেশ করতে পারে। ক্ষমতার গরমে একজন পাতি নেতার বুকের ছাতিও চওড়া হয়ে যায়। তাদের দাপটে ভিন্নমতাবম্বীতো বটেই, সাধারণ মানুষও তটস্থ থাকে। আবার ক্ষমতাসীন দলের নাম করে বা আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অনেক ভুঁইফোড় সংগঠনও গজিয়ে উঠে। তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীসহ অনেকেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগের সুযোগ পায়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধরন এমনই। ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতান্ধ হয়ে ভুলে যায়, জনগণ তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে সেবার জন্য, ক্ষমতাভোগের জন্য নয়। সে গণতন্ত্রকে সুসংহত ও রাজনীতিতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে করবে, এ আশায়। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যারাই ক্ষমতাসীন হয়, তাদের প্রথম কাজই হয় প্রতিপক্ষকে দমন ও নিঃশেষ করে দেয়া। তার কর্মকা- হয়ে পড়ে স্বৈরতান্ত্রের মতো। এমন আচরণ দেখে স্বৈরাচারও বলতে সুযোগ পায়, এখন গণতন্ত্র কোথায়? গণতন্ত্রের নামে এসব কি হচ্ছে? স্বৈরশাসক নিজেও জানে সে বন্দুকের জোরে এবং জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতাসীন হয়েছিল। তাকে বন্দুকের জোরের উপরই শাসন করতে হয়েছিল। স্বৈরশাসক তা করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে একনায়কতন্ত্রিক মানসিকতা ধারণ করে যে ক্ষমতাসীন হয়, সে যে স্বৈরশাসকের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠে, তার নজির বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। তার হাইব্রিড গণতন্ত্র যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি এর কুফল অনেক ভয়ংকর হয়ে ওঠে। জনসাধারণ উভয় সংকটে পড়ে। তারা না পারে কিছু বলতে, না পারে সইতে। আমাদের দেশে চলমান শাসনব্যবস্থাকে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে শুরু করে দেশের পর্যবেক্ষরাও একনায়কতান্ত্রিকতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিরোধীদলগুলো তো সরাসরিই বলছে, এ সরকার স্বৈরসরকার। তারা বরাবরই অভিযোগ করে আসছে, বিশেষ করে বৃহৎ বিরোধীদল বিএনপির আন্দোলনকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা সন্ত্রাসী কর্মকা- আখ্যায়িত করে তা দমনে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করছে। বিএনপিকে জঙ্গী ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রশ্নও তুলেছেন, এককভাবে বিএনপি’র গড়ে যে ৩৫ শতাংশ জনগণের সমর্থন রয়েছে, তারা কি ক্ষমতাসীন দলের এই অভিযোগের সাথে একমত? তারা কি সন্ত্রাসী সংগঠনের সমর্থক? যদি তাই মনে করা হয়, তাহলে এই বিপুল সমর্থনকারীরাও তো দলটিকে সমর্থন করে অপরাধ করছে। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? একইভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতার বাইরে থাকতে যে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করেছিল, তা কি একই অভিযোগে অভিযুক্ত পারে না? অন্যভাবেও বলা যায়, চলমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল যদি বিএনপি’র জায়গায় থাকত আর বিএনপি ক্ষমতায় থেকে তার বিরুদ্ধে একই পদক্ষেপ নিত, তাহলে দলটি কী করত? মোদ্ধা কথা, সহিংসতা মৃদু বা তীব্র যে মাত্রারই হোক না কেন, তা সহিংসতাই। এক পক্ষের সহিংস আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলে চালিয়ে দেয়া, আর অপরপক্ষের আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কর্মকা- বলা, কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বরং রাজনৈতিক আন্দোলন কেন সহিংসরূপ লাভ করে, তা বিবেচনায় নেয়া উচিৎ এবং এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার পথ তৈরি করা জরুরি। এক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রাজনৈতিক সমস্যা যৌক্তিক এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমেই সমাধান করা বাঞ্চনীয়।
তিন.
বিরোধীদলগুলোর চলমান আন্দোলনকে ক্ষমতাসীন দল দেশকে অস্থিতিশীল করা কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখলেও, সচেতন মহল এর মূল কারণ খোঁজার তাকিদ দিয়ে আসছে। তারা বলছে, বিরোধীদলগুলোর আন্দোলন সন্ত্রাসী কর্মকা-, নাকি রাজনৈতিক আন্দোলন তা একেক জনের কাছে একেক রকম মনে হতে পারে। এটা রাজনৈতিক সংজ্ঞার ব্যাপার। কোনটা রাজনীতি আর কোনটা অপরাজনীতি, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা ও মতামত থাকতে পারে। রাজনীতিতে সংঘাত উপসর্গ মাত্র। এই উপসর্গ একটি রোগের। রোগটি হলো অসুস্থ রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সমস্যাটা এখানেই। এর সঙ্গে কেউ একমত হতে পারে, না-ও হতে পারে, সেটা যার যার ব্যাপার। তবে সরকারি দল ও তার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বরাবরই এড়িয়ে যায়। বিরোধী দল কেন আন্দোলন করছে এবং এর মূল কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তারা ‘তালগাছ আমার’ এ নীতি অবলম্বন করে। এ কারণেই চলমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অথচ মূল কারণ সমাধান করা কঠিন কাজ নয়, যদি সদিচ্ছা থাকে। মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এ সমস্যার শুরু হয়েছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিনাভোট ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এ দুটি নির্বাচন কোনোভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ছিল না। দেশে-বিদেশে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই অগ্রহণযোগ্যতাকে কেন্দ্র করেই সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যই মাঠের বিরোধীদলগুলো আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। তাদের এই আন্দোলনকেই সরকার অপবাদ দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা সন্ত্রাসী কর্মকা- বলে আড়াল করার চেষ্টা করছে। দমননীতি অবলম্বনের পাশাপাশি ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার হয়তো মনে করছে, তার এই পদক্ষেপের কারণে মানুষ মূল সমস্যাটি ভুলে যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই সমস্যা সম্পর্কে দেশ-বিদেশের সকলেই অবগত। যদি তাই না হতো, তবে সকলেই একবাক্যে বিরোধীদলের আন্দোলন নাকচ করে দিত। এমনকি তারা আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য বারবার তাকিদ দিতো না। আগের দুটি নির্বাচন যদি গ্রহণযোগ্য হতো, তাহলে তাদের এ তাকিদ দেয়ার প্রয়োজন হতো না। জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বিরোধীদলের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতো। বাস্তবতা হচ্ছে, তারা আন্দোলনে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া নিয়ে এবং বিচারবর্হিভূত হত্যাকা-ের নিন্দা করে বটে, আন্দোলনের নিন্দা করছে না। প্রত্যেকেই যে কারণে বিরোধীদলের আন্দোলন ও রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধান এবং সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলছে। দেখা যাচ্ছে, সরকার মূল সমস্যা আড়াল করার যে চেষ্টা করছে, তা আড়াল করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি সম্ভব হতো, তবে সবদলের অংশগ্রহণভিত্তিক নিরপেক্ষ আরেকটি নির্বাচনের কথা উঠত না। বরং এ কথা বলা হচ্ছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। এই দুই নির্বাচনে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দেশের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই সঙ্কট নিরসনে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই। বিরোধীদলের চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের যেভাবে খুশি সেভাবে গ্রেফতার করতে পারে না। বিগত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রতিবেদনেও এ উদ্বেগের কথা প্রকাশিত হয়েছে। কয়েক বছর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছিল, নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা অপহরণ, হত্যা ও খেয়ালখুশিমতো আটক করছে। বিশেষ করে তা করা হচ্ছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের টার্গেট করে। গত শনিবার আইন ও সালিশ কেন্দ্র এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি বিভীষিকাময়। গণতন্ত্র সঙ্কুচিত হলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। নির্বাচন কমিশন নিয়ে মানুষের মধ্যে এখনও সঠিকভাবে আস্থা আসেনি যে তারা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে। দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা এ ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেন প্রকাশ করছে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার কিছু নেই।
চার.
পর্যবেক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরেই বলছেন, রাজনীতিতে প্রতিহিংসা ও একে অপরকে ধ্বংস করার প্রবণতা বিরাজমান থাকায় সুষ্ঠু রাজনীতির অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। এই অপরাজনীতি দেশের অগ্রযাত্রা ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এখন হয়তো উন্নয়ন, উৎপাদন, কৃষি, শিক্ষা ব্যবস্থা সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। তবে এটা শুধু বৈশ্বিক কারণই নয়, এর মধ্যে আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতাও বড় কারণ হয়ে রয়েছে। সরকার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে এড়িয়েই উন্নয়নের কথা বলছে। এই অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রেখে যে স্থিতিশীল ও টেকসই উন্নয়ন হয় না, তা এখন উপেক্ষা করে গেলেও দীর্ঘমেয়াদে এর ফলাফল সুখকর হয় না। কারণ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একসাথে চলতে পারে না। সরকার যে বুঝছে না, তা বিশ্বাস না করার কারণ নেই। তাহলে সরকার জেনে-বুঝে এ পরিস্থিতি চলতে দিচ্ছে কেন? পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার জন্য সরকার জবরদস্তিমূলক যে পথে হাঁটছে, তা কখনই রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য সহায়ক হতে পারে না। আগুন কোন কিছু দিয়ে চেপে রাখা যায় না। সরকার যদি মনে করে, দমন নীতির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব, তবে তা অপরিনামদর্শীতারই নামান্তর। যা বিনাশ করা সম্ভব নয়, সে চেষ্টা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়। দেশের স্বার্থে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়াই হবে দূরদর্শীতার পরিচায়ক। সরকার যেহেতু ড্রাইভিং সিটে এবং রাষ্ট্র পরিচালক, তাই তাকেই সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কর্মকা- আখ্যা দিয়ে হয়ত সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যায়, তবে তা কখনো স্থায়ী হয় না। কারণ, বিরোধীদলগুলোর আন্দোলন রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে এবং এর মধ্যেই সংঘাতের বিষয়টি নিহিত। এই সঙ্কট সরকার এড়িয়ে গেলে তা বাড়বে বৈ কমবে না। সরকার যদি মূল সঙ্কট ও সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে সংঘাত-সংঘর্ষও কমে যাবে। এখানে বাস্তবসম্মত চিন্তা-ভাবনা ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হিংসা-প্রতিহিংসা, খেলা হবে, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত নয়। সুস্থ রাজনীতিতে হার-জিৎ, পিছিয়ে পড়া-এগিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। রাজনীতিকে কলুষিত করা, অপবাদ দিয়ে দমন করা কখনো কাম্য হতে পারে না। এ কথা মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ক্ষমতাসীন দলের কাছে আজ যা বর্জনীয়, ক্ষমতাহারা হলে তা যে তার কাছে বরণীয় হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। রাজনীতির এ অপসংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি দেশের মানুষ দেখে আসছে। এ অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে সহিষ্ণুতা ও ঐকমত্যের বিকল্প নেই। চলমান সঙ্কট যে রাজনৈতিক তা স্বীকার করে সমাধানের পদক্ষেপ নেয়াই সমীচীন।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন