রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে ত্রিমুখী দুর্নীতি

উমেদারদের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেন ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিমের তদন্ত চিত্র

হাসান-উজ-জামান | প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

সাব-রেজিস্ট্রার অফিসগুলোসহ ঢাকার রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স ধরনের অবৈধ লেনদেনগুলো হয়ে থাকে নিয়োগবহির্ভূত উমেদারদের মাধ্যমে। এছাড়া দাতাগ্রহিতার মধ্যে জমির প্রকৃত বিনিময় মূল্য বেশি হলেও তা সাব-রেজিস্ট্রার ও দলিল লেখকদের সহায়তায় কম দেখানো হয়। যে কারণে প্রকৃত রেজিস্ট্রেশন ফি হতে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। দলিলে লিখিত মূল্যের অতিরিক্ত টাকা বিক্রিতার পক্ষে কালো টাকায় পরিণত হয়। একইভাবে ক্রেতার কালো টাকাও সাদা হয়ে যায়। এতে করেই ত্রিমুখী দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে দলিল রেজিস্ট্রেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন। কর্মচারী নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে এ সেক্টরে ব্যাপক বাণিজ্য হচ্ছে। আইন ও ম্যানুয়েল অনুয়ায়ী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বদলি, নকল নবিস, দলিল লেখক নিয়োেেগর ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রারের। কিন্তু বাস্তবে এ নিয়োগ ও বদলি হয়ে থাকে নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজিআর) এর দপ্তর থেকে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও প্রতিষ্ঠানের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের গঠিত ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিমের তদন্তে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসগুলোসহ ঢাকার তেজগাঁওস্থ রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে তদন্তকালে এ চিত্র ফুটে উঠেছে।

তদন্ত টিম এ সেক্টরে দুর্নীতির উৎস খুঁজতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, সাব রেজিস্ট্রার অফিসে বিপুল সংখ্যক নকল নবিস নিয়োজিত থাকলেও বাস্তব সত্য হলো ২০১৪ সালের দলিলও বালাম বইয়ে কপি করা হয়নি। অথচ দৈনিক সম্পাদিত দলিলগুলো নকল নবিসদের মাধ্যমে প্রতিদিনই কপি হওয়ার কথা। অথচ সময়মতো ভলিউমে কপি না হওয়ার কারণে মূল দলিল সরবরাহে বিলম্বের পাশাপাশি সার্টিফাইড কপি সরবরাহেও জটিলতার সৃষ্টি হয়। এতে করে সেবাগ্রহিতারা দালালের খপ্পরে পড়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হন। জমি রেজিস্ট্রেশনকালে রাজস্ব হিসেবে জমাকৃত পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট ও চেক ব্যাংকের হিসেবে নির্ধারিত সময়ে জমা হয় না। এ কারণে এসব পে-অর্ডার ও চেক সংশ্লিষ্ট দফতর হতে খোয়া যাচ্ছে এবং জালিয়াতির মাধ্যমে এসব অর্থ আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। জমি রেজিস্ট্রিকালে জমাকৃত জাল পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট কিংবা চেক নির্ধারিত সময়ে জমা না দেয়ার কারণে ধরা পড়ছে না। এসব চেক ও পে-অর্ডার এন্ট্রি দেয়ার জন্য রক্ষিত রেজিস্ট্রারের সকল কলামগুলো পূরণ করা হয় না। রেজিস্ট্রেশন ম্যানুয়েল অনুযায়ী ক্যাশ ট্রানসেকশন রিপোর্ট বা সিটিআর নিয়মিত ব্যাংকের সাথে মিলিয়ে সংরক্ষণ করার বিধান থাকলেও বাস্তবে তা সংরক্ষণ করা হয় না। পে-অর্ডার কিংবা চেক সময়মতো রাজস্ব খাতে জমা না হলে তা সংশ্লিষ্ট ইস্যুকারী ব্যাংকে দাবিদারবিহীনভাবে পড়ে থাকে। এক সময় তা ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা তা আত্মসাতের সুযোগ পায়।

বিতর্কিত জমিগুলো রেজিস্ট্রেশন করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক টিমের তদন্তে উঠে এসেছে আরও ভয়াবহ অনেক চিত্র। দলিল রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পর ল্যান্ড ট্রান্সফার বা এলটি নোটিশ সংশ্লিষ্ট অ্যাসিল্যান্ড অফিসে প্রেরণ করার কথা। কিন্তু এলটি নোটিশের অগ্রগামীপত্রের কপি পাওয়া যায়। একই স্মারকে একমাসের একাধিক এলটি নোটিশ অ্যাসিল্যান্ড অফিসে প্রেরণ করা হয়; কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো বিবরণ থাকে না।

দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক টিমের তদন্তে উঠে আসা এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, গত তিন বছর ধরেই বিজি প্রেস থেকে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ভলিউম সরবরাহ করতে পারেনি। যে কারণে নকল নবিসরাও দলিল নকল করতে পারেনি। বিজি প্রেস থেকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ভলিউম সরবরাহ করতে না পারায় নকল দলিল সম্পাদনে বিঘ্ন ঘটেছে।

জেলা রেজিস্ট্রার আরও বলেন, আজকের আদায়কৃত রাজস্ব খাত অনুযায়ী পরবর্তী কার্যদিবসে ট্রেজারিতে জমা হয়ে থাকে। সেখানে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ নেই। দাতা গ্রহিতার মধ্যে জমির প্রকৃত বিনিময় মূল্য বেশি হলেও তা সাব-রেজিস্ট্রার ও দলিল লেখকদের সহায়তায় কম দেখানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাব রেজিস্ট্রারের কাছে একটি লিখিত সম্পাদিত দলিল দাখিল হয়ে থাকে। এর আগে সাব রেজিস্ট্রারের সাথে দলিল লেখকদের কোনো ধরনের আলোচনার দরকার পড়ে না। সাবিকুন নাহার আরও বলেন, এখন সিটিআর অন লাইনেই সংরক্ষণ করা সম্ভব। তদন্তের অনেকগুলো বিষয়ের সাথেও তিনি দ্বিমত পোষণ করেন।
এদিকে গত ২৬ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো: মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত এক স্মারকে এ ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশনের বরাতে ১০টি সুপারিশের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

এতে প্রথমেই রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের সাব রেজিস্ট্রার অফিসগুলোর রেজিস্ট্রেশন ম্যানুয়েল ২০১৪ ও রেজিস্ট্রেশন আইন-১৯০৮ যথাযথভাবে অনুসরন নিশ্চিতের জন্য আইজিআরকে পরামর্শ প্রদানের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া মূল দলিল গ্রহিতাকে তাৎক্ষণিক ডেলিভারী প্রদানের জন্য ৩ কপি দলিল সম্পাদন করে রেজিস্ট্রেশন করার কথা বলা হয়। যাতে করে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে দাতা ও গ্রহীতাকে এক কপি করে এবং বাকি কপি ভলিউমে উত্তোলনের জন্য রাখা যায়। একইসাথে প্রতিটি দলিল ডাটাবেজে সংরক্ষণ করারও মতো দেন টিমের সদস্যরা। দেশের সকল সাব রেজিস্ট্রি অফিসের সিটিআর রিপোর্ট ব্যাংকের সাথে মিলিয়ে এক মাসের মধ্যে হালনাগাদ করা উচিত। এছাড়া যেসব জায়গায় অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা রয়েছে সে সকল জায়গায় অনলাইনে টাকা জমা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। জমির হালনাগাদ খতিয়ানের কপি সংশ্লিষ্ট সাব রেজিস্ট্রার অফিসে সংরক্ষিত নিশ্চিতের পাশপাশি দলিল রেজিস্ট্রির আগে মালিকানা নিশ্চিত করা দরকার। একইসাথে জমির মালিকানা বদলের ক্ষেত্রে অটো জেনারেটেড মোবাইল এসএমএস এর মাধ্যমে দাতা ও গ্রহীতাকে জানিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা।

এছাড়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সাব রেজিস্ট্রার অফিস একই কমপ্লেক্সের অধীনে এনে একই কমপ্লেক্সে স্থাপন করা যেতে পারে যাতে করে জমি রেজিস্ট্রেশন হওয়ার সাথে সাথেই নামজারী জমাভাগের কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন