রাজধানী ঢাকায় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে তিন থেকে চারগুণ মানুষ বসবাস করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন। কিন্তু জনসংখ্যা অনুপাতে চলাচলের রাস্তা কম এবং ট্রাফিক ব্যবস্থায় দুর্বলতা কারণে সড়কে প্রতিদিন যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে জ্বালানি অপচয়ের পাশাপাশি কর্মজীবী মানুষের লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা সড়কের এই যানজট কার্যত ‘জাতীয় সমস্যায়’ রূপলাভ করেছে। যানজট থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি উন্নয়নমূলক প্রকল্প করা হয়েছে। মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার, খিলগাঁও ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার, মহাখালী ফ্লাইওভার, মগবাজার ফ্লাইওভারসহ কয়েকটি ফ্লাইওভার করে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। উত্তরার বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) অর্ধেক খুলে দেয়ার পর মেট্রোরেলের অর্ধেক পথ খুলে দেয়া হয়েছে। এখন বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ পুরো দমে এগিয়ে চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এ প্রকল্পের বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলগেইট পর্যন্ত কাজসম্পন্ন হয়েছে। এ বছর যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। এতে কিছুটা হলেও যানজট কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হলে বিমানবন্দর থেকে যাত্রবাড়ী দূরত্ব হবে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের পথ।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আকতার বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কথা মাথায় রেখেই বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও অংশ খুলে দেব। তেজগাঁও অংশ পর্যন্ত খুলে দিলে নগরীর যানজটের জটলা অনেকটা কমে যাবে। চলতি বছরেই সাড়ে ১১ কিলোমিটার খুলে দেয়া হবে। এই অংশের কঠিন কাজ শেষ পর্যায়ে। পিলার ও ভায়াডাক্ট অধিকাংশ স্থানে বসে গেছে। হাতে সময় এখনো সময় আছে। এই সময়ে বাকি কাজসম্পন্ন হবে।
রাজধানীর যানজট নিরসনে জাদুরকাঠি হিসেবে কাজ করবে এই ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে প্রকল্পের কাজ। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল লেনের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত দৈর্ঘ্য সাড়ে ১১ কিলোমিটার। এ অংশটি চলতি বছরে খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের। প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ হলে বিমানবন্দর থেকে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যাবে যাত্রাবাড়ী।
রাজধানীর সড়কগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহনের চাপ থাকায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের নির্মাণের সুবিধার্থে তিনটি ট্রাঞ্চে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশ বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত। দ্বিতীয়াংশ বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার পর্যন্ত। তৃতীয়াংশ মগবাজার থেকে যাত্রাবাড়ীর পেরিয়ে চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক হিসাবে ব্যবহৃত হবে। এটি সম্পূর্ণ চালু হলে রাজধানী ঢাকায় যানজটের দৃশ্য হারিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানী ঢাকাকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে মহানগরীর যানজট নিরসনে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মহাপ্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে নগরীর দুর্বিষহ যানজটের ভোগান্তি থেকে অনেটাই রেহাই পাবে নগরবাসী এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। প্রকল্পটির কাজে এসেছে গতি। ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্যে দেশি-বিদেশি, শ্রমিকরা-কর্মকর্তারা মহাব্যস্ত প্রকল্পটির কাজে। কাজের অগ্রগতির নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন কর্মকর্তারা।
সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে একাংশের কাজ এগিয়ে চলছে। তিনটি ভাগে প্রকল্পের কাজ ভাগ করা হয়েছে। প্রথমপর্ব বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত চালু করা হবে এ বছরেই। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ-পিপিপির আওতায় পরিচালিত এ অংশের কাজ প্রায় শেষের দিকে।
বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত উঠে গেছে ভায়াডাক্ট। সøাব বসানো শেষ, উপরের অংশে ফিনিসিংয়ের কাজও শেষ করছেন শ্রমিকরা। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত শিগগিরই খুলে দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছে প্রকল্পের পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। খুব তাড়াতাড়ি চালুর টার্গেট করে দ্রুত কাজ এগিয়ে চলেছে। প্রচণ্ড শীতের এই ঠান্ডায়ও কাজ করছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। বিরূপ আবহাওয়াও কাজের কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। শ্রমিকরা মনোযোগের সাথে কাজ করছেন।
সরেজমিন কুড়িল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যেও কাজ করছেন শ্রমিকরা। মূল সড়কের কাজ প্রায় শেষ। এখন বাকি রয়েছে কার্পেটিংয়ের কাজ। আর কার্পেটিংয়ের কাজের জন্য উপরের মূল সড়ক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। লাইট লাগানোর কাজ চলছে পুরোদমে। এই এলাকায় কয়েকতলা বিশিষ্ট অফিস ভবনটিতে চলছে রঙ করার কাজ। শ্রমিকরা নিয়মিত রঙ করার কাজ করে যাচ্ছেন। মূল সড়কে উঠা এবং নামার স্থানগুলো বালি ভরাটের কাজ করা হচ্ছে।
এছাড়াও বনানী এলাকার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূলসড়কের কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ। এ এলাকায়ও শ্রমিক ও কর্মকর্তারা পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে রয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নামা-উঠার স্থান। এসব এলাকায়ও শ্রমিকরা কাজ করে যাচ্ছেন।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুপারভাইজার মেহেদী হাসান ইনকিলাবকে বলেন, বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলগেট অংশের মূল কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ রয়েছে চলমান। পুরোদমে কাজ চলছে এই অংশের। বিমানবন্দর কাওলা থেকে বনানী পর্যন্ত এ মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে কার্পেটিং শুরু হবে বলে জানান তিনি। ইতোমধ্যে উপরের সকল কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে কার্পেটিং করার জন্য। আগামী মার্চে ঢাকা এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর কাওলা থেকে বনানী পর্যন্ত সরকারকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, উড়ালসড়ক বাস্তবায়নের পর ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক সৃষ্টি হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি হেমায়েতপুর-কদমতলী-নিমতলী-সিরাজদিখান-মদনগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-মদনপুরে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। উড়ালসড়ক শুধু বিমানবন্দর ও যাত্রাবাড়ী রুটের যাত্রীদেরই স্বস্তি দেবে না, একইসঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করতে সহায়তা করবে। উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢাকাকে বাইপাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। এতে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অংশে নিরসন হবে যানজট।
প্রকল্পটি ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা ছিল। মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২১৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। পরে প্রকল্প ব্যয় অপরিবর্তিত রেখে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পটির বিদ্যমান অঙ্গের পরিমাণ ও ব্যয় বাড়ার কারণে প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। একই সঙ্গে সময় বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয়বারের মতো প্রকল্পে সংশোধনী এনে সময় ও ব্যয় আরও বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে কাজ শতভাগ সম্পন্ন করার কথা জানান সংশ্লিষ্টরা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) পর্যন্ত উড়াল সড়কে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
এদিকে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সার্বিক কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। একইসঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান না করে নতুন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদানের জন্যও মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়। গত ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকে এ সুপারিশ করা হয়।
কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নানের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, এনামুল হক, আবু জাহির, রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, ছলিম উদ্দীন তরফদার, সেখ সালাহউদ্দিন, সৈয়দ আবু হোসেন এবং মেরিনা জাহান অংশ নেন।
টঙ্গী থেকে মতিঝিল সড়কে নিয়মিত চলাচলকারী মো. মামুন ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিদিনই আমাকে বাসে অথবা ট্রেনে যাতায়াত করতে হয়। ট্রেনে কোনো কোনো দিন উঠতে পারি না। মাসের বেশিরভাগ দিনগুলোতে বাসেই যাতায়াত করতে হয়। আর বাসে যাতায়াত মানে কিযে দুর্ভোগ এটা যারা ঢাকায় বসবাস না করে তারা বলতে পারবে না। এতা কষ্ট করে নিয়মিত কাজে যেতে হয়। চাকরির তাগিদেই এতো কষ্ট করছি। যদি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প খুলে দেয়া হয় তাহলে আমরাই সবচেয়ে সুবিধাভোগী হবো। কারণ নিয়মিত যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। ঠিক সময়ে নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারব। নূর হোসেনের মতো টঙ্গী ও উত্তরা থেকে মতিঝিলে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন এমন যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা সবাই বলেন, স্বপ্ন দেখছি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। কয়েক মাস পর একাংশ চালু হবে। তখন যানজটে পড়তে হবে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিকবার সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ডিসেম্বরে এর একাংশ খুলে দেয়ার কথা ছিল। এই সময়ে খুলে দিতে পারলে ভালো হতো। কারণ এর উপর দিয়ে গাড়ি চলবে। নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে অনেক জটিলতা রয়েছে। যেটি আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। পিপিপি’র আওতায় নির্মাণাধীন প্রকল্পটি টেকনিক্যাল হিসাব-নিকাশ করে কাজ শেষ করতে হবে। কাজে অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের জন্য ঠিকাদারদের জবাবদিহির আওতায় আনতে কবে। তবে সার্বিক বিষয়ে মনে হচ্ছে এবারো নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন