দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে বইছে শৈত্যপ্রবাহ। রাজধানী ঢাকার অবস্থাও বেহাল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর ঘন কুয়াশায় জবুথবু হয়ে পড়েছে জনজীবন। ঘন কুয়াশায় যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গেছে। সড়ক, বিমান, ট্রেন, লঞ্চ, ফেরি সব যোগাযোগে সিডিউল ভেঙ্গে গেছে। ঘন কুয়াশার কারণে সড়কে হেড লাইট জ্বালিয়ে বাস চললেও গন্তব্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগছে। সিডিউল অনুযায়ী বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। গতকালও ঘন কুয়াশার কারণে মধ্যরাতে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামতে পারেনি ৮টি ফ্লাইট। কুয়াশার কারণে রাজধানী ঢাকা থেকে তিনটি ট্রেন বিলম্বে ছাড়তে হয়েছে। রাতে কয়েক ঘন্টা করে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখতে হচ্ছে। একই চিত্র সদরঘাটের লঞ্চ চলাচলেও।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী গতকাল দেশের ১৫ অঞ্চলের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে। সবচেয়ে কম তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমেছে ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তবে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। শনিবার ঢাকার তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রিতে নামলেও গতকাল রোববার দুই ডিগ্রি বেড়ে ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঠেকেছে। আগামী কয়েক দিন এই আবহাওয়া অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। সংস্থাটি জানিয়েছে নওগাঁ, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের সব এলাকার তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেছে। ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আছে ১৫ অঞ্চলের তাপমাত্রা। এরমধ্যে তেতুলিয়ায় ৯.৬, বদলগাছিতে ৯.৮, যশোর ও দিনাজপুরে ১০, সাতক্ষীরায় ১০.২, সৈয়দপুরে ১০.৫, ঈশ্বরদীতে ১০.৪, কুমারখালি, ডিমলা ও রাজশাহীতে ১০.৬, বরিশাল ও বগুড়ায় ১০.৭, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জে ১০.৮, নিকলির তাপমাত্রা ১০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত দুদিনে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৮, আর সর্বনিম্ন ছিল ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ঢাকার ফ্লাইট কোলকাতায় : মধ্যরাতের পর থেকে ঘন কুয়াশার কারণে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফ্লাইট ওঠা-নামা ব্যাহত হয়। ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামতে পারেনি ৮টি ফ্লাইট। এর মধ্যে ৭টি ফ্লাইট অবতরণের চেষ্টা করে ঘন কুয়াশার কারণে নামতে না পেরে ভারতের কলকাতা বিমানবন্দরে চলে যায়। অপর ফ্লাইটটি নামতে না পেরে মালয়েশিয়ায় ফিরে যায়। আর দীর্ঘ সময় আকাশে চক্কর দিয়ে ৭টি ফ্লাইট দেরিতে নামতে বাধ্য হয়েছে। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, কুয়াশার কারণে রানওয়ের ভিজিবিলিটি (দৃশ্যমানতা) কম থাকায় ৭টি ফ্লাইট ঢাকায় নামতে না পেরে চট্টগ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। তবে চট্টগ্রামে প্লেন রাখার জায়গা (পার্কিং) সংকট থাকায় তারা কলকাতা চলে যায়।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, ঘন কুয়াশার কারণে ফ্লাইটগুলোর পাইলট অবতরণের আগে স্বচক্ষে রানওয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন না। ফলে কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকাগামী বাটিক এয়ার, কুয়েত থেকে আসা কুয়েত এয়ারওয়েজ, জাজিরা এয়ারওয়েজ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের দুবাই, বিমানের দাম্মাম, গালফ এয়ারের বাহরাইন ও সালাম এয়ারের মাস্কাট থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইট কলকাতা চলে যায়। এছাড়াও এয়ার এশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইট উড্ডয়নের পর ২ ঘণ্টা উড়ে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার বিষয়ে জানতে পারে। পরে মাঝ আকাশ থেকে ফ্লাইটটি কুয়ালালামপুর ফিরে যায়। পাশাপাশি সউদী জেদ্দা থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইট তাদের যাত্রা বাতিল করেছে। একই কারণে ঢাকাগামী প্রায় ডজনখানেক ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ে অবতরণ করতে পারেনি।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, কুয়াশা কমে যাওয়ার পর আকাশে চক্কর দিতে থাকা ও কলকাতা থেকে আসা ফ্লাইটগুলোকে আগে অবতরণের সুযোগ দেওয়া হবে। এরপর ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের ফ্লাইট উড্ডয়ন করতে দেওয়া হবে।
ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় : রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে তিনটি ট্রেন দেরিতে ছেড়েছে। ঘন কুয়াশার কারণে ট্রেনগুলো কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছাতে দেরি করায় এ ঘটনা ঘটে। এতে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, রোববার তিনটি ট্রেন ২ ঘণ্টা দেরিতে ঢাকা ছেড়েছে। ঘন কুয়াশার কারণে ট্রেনগুলো ঢাকায় পৌঁছাতে দেরি হয়, যার ফলে ট্রেনগুলো বিলম্বে ছেড়েছে। বিলম্বে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো হচ্ছে রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস, নীলফামারীর চিলাহাটিগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস ও পঞ্চগড়গামী একতা এক্সপ্রেস।
ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, প্রচন্ড শীতে তারা কমলাপুর স্টেশনে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছেন। এতে নিদারুণ কষ্ট করতে হয়। শিশু ও বৃদ্ধ যাত্রীদের জন্য অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়তে হয়।
রাতে ফেরি বন্ধ : ঘন কুয়াশার কারণে প্রতিদিন মধ্যরাতে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, আরিচা-কাজিরহাট ও ধাওয়াপাড়া-নাজিরগঞ্জ নৌরুটে নিয়মিত চলাচল করা ফেরি ফেরিসহ সব নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হচ্ছে। গতকালও ঘন কুয়াশায়র কারণে দিন ঠিক করতে ব্যর্থ হয়ে মাঝ নদীতে আটকা পড়েছে ছোট-বড় ৬ টি ফেরি। এতে কনকনে শীতে চরম দুর্ভোগে পড়েন যানবাহনের শ্রমিক ও যাত্রীরা।
বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ জানায়, মধ্যরাত ৪টা থেকে কুয়াশার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, আরিচা-কাজির হাট ও ধাওয়াপাড়া-নাজিরগঞ্জ নৌরুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছিল। ভোর রাত ৫টার দিকে কুয়াশার মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করে। এতে এ নৌরুটগুলোতে বিকনবাতি ও মার্কিং পয়েন্ট কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তাই ওই তিন নৌরুটে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেন কর্তৃপক্ষ। এ সময় মাঝনদীতে ছোট-বড় ছয়টি ফেরি আটকা পড়ে। এতে তিন নৌরুটে পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে তিন শতাধিক যানবাহন। ঘন কুয়াশার কারণে প্রতি রাতে কয়েক ঘন্টার জন্য ফেরি চলাচল বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
সড়কে দিনেও হেডলাইট : তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় মোড়ানো থাকছে সারাদেশ। তবে দেশের উত্তরাঞ্চল সবচেয়ে কুয়াশা বেশি। ঘন কুয়াশার মধ্যে মহাসড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে সব ধরনের যানবাহন। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে হাইওয়ে রোড, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-মানিকগঞ্চ প্রতিটি রুটে সকারে হেড লাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করতে করছে। তারপরও ঘন কুয়াশার কারণে যেখানে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটছে। বাস চালকরা জানান, যে সড়কে ঘন্টায় ৬০ থেকে ৮০ কিমি বেগে বাস চলার কথা সেখানে কুয়াশার কারণে ৩০ থেকে ৪০ কিমি বেগে চলতে হচ্ছে। তারপরও দুর্ঘটনা ঘটছে। ফলে ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় নিয়মিত বাস কোম্পানীগুলো সিডিউল অনুযায়ী যানবাহন চালাতে পারছে না। ঘন কুয়াশায় সড়কে যানবাহনের সিডিউল ঠিক রাখা যাচ্ছে না।
আবহাওয়া অধিদফতারের আবহাওয়াবিদরা জানান, পৌষের শেষ দিকে শীতের আবহ বেড়েছে। হিমালয় পাদদেশীয় উত্তরাঞ্চলজুড়ে শীত জেঁকে বসেছে। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে শীতের মাত্রা। দিন যত যাচ্ছে কুয়াশার দাপট ততই বাড়ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন