জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১০ জানুয়ারি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি বিজয় অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। ২৫ মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালাতে শুরু করে। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর পর পরই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
শুরু হয় বাঙালির সশন্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই বাঙালি জাতি বঙ্গন্ধুর আদর্শে ও নির্দেশিত পথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর যৌথ প্রতিরোধের মুখে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ হন ও ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারান। এতো রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে বিজয় এলেও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় বাঙালির অর্জিত বিজয় পূর্ণতা পায়নি। বিজয়ী বাঙালি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে তাদের নেতার ফিরে আসার।
আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু সোজা লন্ডন চলে যান। সেখান থেকে ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফেরেন। সেদিন সারাদেশ থেকে মানুষ ছুটে আসে তাদের নেতাকে একবার দেখর দেখার জন্য। স্বাধীন দেশে ফিরে বাঙালির ভালবাসায় সিক্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা।
আমি তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। আমরা বিমানবন্দর থেকে লাখ লাখ মানুষের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স) নিয়ে আসি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন নেতা, যাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের সম্পর্ক গভীর। ঘাতকের বুলেট তাঁকে হত্যা করলেও সে সম্পর্ক মোটেই ছিন্ন করতে পারেনি। যত দিন যাচ্ছে, ততই ইতিহাসে তাঁর নাম সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
৬০ এর দশকে আমি সর্বপ্রথম কায়েদ-ই-আজম কলেজ (বর্তমানে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) এ ছাত্রলীগ থেকে জিএস নির্বাচিত হই। তখন থেকেই আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা। মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে সর্বশেষ ২৫ তারিখ ও আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে বললাম, লিডার একটু ক্যান্টনম্যান্ট যাবো। এখানে বলে রাখি, ক্যান্টম্যান্টের সঙ্গে আমার ফার্নিচারের ব্যবসা ছিলো। ইস্টার্ন ফার্নিচার নামে আমার একটি ফার্নিচারের প্রতিষ্ঠান ছিলো। আমি ক্যান্টনম্যান্ট গিয়েছিলাম ফার্নিচারের বিল আনতে। কিন্তু ওইদিন ক্যান্টনম্যান্টের পরিস্থিতি একটু অন্যরকম মনে হলো। ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর কাছে সংবাদটি পৌঁছেদিলাম।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সকালে আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি বাড়ির চারপাশে লোকে লোকারন্য। আমরা নগর আওয়ামী লীগের নেতারাই বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় নিয়ে আসি। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেন তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার সঙ্গে আমি মঞ্চের কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই ঐতিহাসিক দিনে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে সর্বদা ধন্য মনে করি।
বঙ্গবন্ধুর সময়ে আমি ছিলাম ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম কেমন চলছে, কীভাবে করলে ভালো হবে, কোথায় কী সমস্যা আছে, সেসব বিষয় নিয়ে আমরা (তৎকালীন নগর সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক সুলতান, কোষাধ্যক্ষ আমি আর কে চৌধুরীসহ অনেকে) নিয়মিত সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতাম। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে তার সঙ্গে বসি। আলোচনা হয় দীর্ঘসময় ধরে। পূর্বের ন্যায় বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সেদিনও ছিল খুব প্রাণচঞ্চলতা। বঙ্গবন্ধু কখনই ভাবেননি তার করা স্বাধীন বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ঘাতকরা তার ঘনিষ্টজনদের উপর নির্যাতন চালায়। আমাকে হত্যা করার জন্য কয়েকবার আমার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমাকে ৬ মাস আত্মগোপনে থাকতে হয়।
পরিশেষে বলছি, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক। সেরা মুক্তি সংগ্রামী, সেরা রাষ্ট্রনায়ক। জননন্দিত নেতা হিসেবে তার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও দায়বোধ তাকে মহীরূহে পরিণত করেছিল। ব্যক্তি শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু অমর, তার মৃত্যু নেই। তিনি আছেন বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের অন্তরে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন