সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ

ব্যারিস্টার এম তমিজউদ্দিন | প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ইতিহাস সৃষ্টি করেই, যিনি ইতিহাস হয়ে আছেন। অন্য অনেক ঐতিহাসিক দিনের মতো ১১ জানুয়ারি ১৯১১ দিনটিও একটি স্মরণীয় বরণীয় দিন হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে মিশে আছে এবং যথাযত মর্যাদায় এদিনটি পালিত হয়ে আসছে। এ দিন পূর্ব বাংলা তথা উপমহাদেশের একজন কিংবদন্তি সিংহ পুরুষের জন্ম হয়। যুগযুগান্ত ধরে যার নাম স্মরণীয় হয়ে আছে এবং থাকবে। তিনি হলেন, বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ। বিচারপতি মোর্শেদ জন্ম গ্রহণ করেন বাংলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তার পিতা-মাতা সৈয়দ আবদুস সালেক, বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য ছিলেন। তাঁর মাতা ছিলেন আফজালুন্নেসা বেগম ছিলেন শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ছাত্র জীবন থেকেই বেড়ে ওঠেন এক নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশে, কঠিন অধ্যবসায় এবং পরিশ্রম যা তাকে শুধু ঈর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারীই করেনি, প্রেরণা জুগিয়েছে বিদেশ থেকে ডিগ্রি অর্জন করার। তিনি ১৯৩৮ সালে যুক্তরাজ্যের অন্যতম বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘দ্য অনারেবল সোসাইটি অফ লিংকন ইন’ থেকে ‘ব্যারিস্টার-এট-ল’ অর্জন করেন।

তাঁর অসাধারণ মেধা ও কঠোর পরিশ্রম পেশাগত জীবনেও তাঁকে নিয়ে গেছে খ্যাতির শীর্ষে। ১৯৫৪ সালের শেষদিকে তিনি হাইকোর্টে যোগ দেন এবং একই বছর বিচারক পদে নিযুক্ত হন। পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হন।

বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে নিন্ম আদালতের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালে তার কিছু ঐতিহাসিক রায় এবং সাংবিধানিক ব্যাখ্যা উপমহাদেশের পরিধি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।


তিনিই প্রথম বিচারপতি যিনি পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি দেশে রিট পিটিশন চালু করেছিলেন। এই রিট পিটিশনের মাধ্যমেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছিল। বিচারপতি মোর্শেদ নির্ভয়ে রায় দিয়েছেন সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, এতে অতেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ন্যায় বিচার পেয়েছেন।

বিচারপতি মোর্শেদ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের জানাজায় অংশগ্রহণের পর তিনি এবং শেরে বাংলা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে একটি মিছিলের নেতৃত্ব দেন। এর ফলস্বরূপ, পুলিশ লাটিচার্জ করে, তাঁকে এবং শেরে বাংলাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য গ্রেফতার করে রাখে।

বিচারপতি মোর্শেদ আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন ও শোষণের বিপরীতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এবং ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বলা হয়ে থাকে, ২১ দফা দাবির প্রথম খসড়াটি তিনিই প্রণয়ন করেছিলেন।

বিচারপতি মোর্শেদ তার জীবদ্দশায় শুধু বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না, তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। পেশাগত সুখ্যাতি, মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও সাধারণের মাঝে তার অংশগ্রহণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা ও অবস্থানের গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। সে সময় ঐতিহাসিক ‘নেহেরু-লিয়াকত’ চুক্তি প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বিচারপতি মোর্শেদ একজন সাধারণ মানুষের মত জীবনযাপন করলেও তাঁর হৃদয় ছিলেন সাহসী। একদিন তিনি কমিশনার অফিস থেকে পররাষ্ট্র দফতরে যাওয়ার পথে গাড়িতে বসেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জামিন দেন। কেউ একজন তাঁকে বলেছিলেন, মোমেন খান এটা পছন্দ করবেন না। তাঁর জবাবে তিনি বলেছিলেন, তাকে বলবেন ‘আমিই আইন’।

এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের ঐতিহাসিক গোলটেবিল বৈঠকে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৬৯) সমগ্র পাকিস্তানের যে ৩৫ নেতা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন তাদের অন্যতম। সেই বৈঠকে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইতিহাসবিদদের মতে, সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ অত্যন্ত সাহসের সাথে ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সামরিক জান্তাদের রক্তচক্ষুর সামনে এ দাবি ছিনিয়ে আনেন। এর আগে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সমানসংখ্যাক আসন নির্ধারিত ছিল।

বিচারপতি মোর্শেদের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতি গ্রহণের ফলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) আসন সংখ্যা ১৫০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৯। রাজনৈতিকভাবে এ আসন সংখ্যার বিভাজনটি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে পরাভূত করে, যার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৭০-এর নির্বাচনে। বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের এ অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর এ অবদানের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে কখনো মুছে যাবে না। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।


লেখকঃ কলামিস্ট ও গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন