শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রবাসে শ্রমিকের দুঃসহ জীবন

দয়াল কুমার বড়ুয়া | প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আমরা গর্ব করি। এই রিজার্ভের কল্যাণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের সচ্ছলতা বজায় থাকে। আর সেই রিজার্ভ গড়ে তুলতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে প্রবাসে কাজ করা বাংলাদেশি শ্রমিকরা। কিন্তু তাদের জীবন কীভাবে চলে সেই খবর আমরা কতটুকু রাখি।

একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিদেশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অতিরিক্ত সময় কাজ করাসহ নানা কারণে বছরে তিন হাজারের বেশি শ্রমিক লাশ হয়ে দেশে ফেরে। কোনো কোনো বছর এই সংখ্যা চার হাজারও ছাড়িয়ে যায়। শুধু মৃত্যু নয়, অনেকে কর্মক্ষমতা হারিয়ে দেশে ফেরে।

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাব থাকায় এবং কিছুটা উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় অনেকে অনেকভাবে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেউ কেউ মানবপাচারকারীদের হাতে পড়ে যায়। মরুভূমিতে বেঘোরে জীবন দিতে হয়। ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হয়। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার জঙ্গলে অতীতে অনেক বাংলাদেশির গণকবরও পাওয়া গেছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে যারা যায়, তারাও নানা ধরনের প্রতারণার শিকার হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুত কাজ ও বেতন পাওয়া যায় না। বিদেশে গিয়ে তারাই বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়। বিদেশে গিয়ে তারা যখন দেখে প্রতিশ্রুত বেতনের অর্ধেকও পাচ্ছে না, তখন অত্যধিক গরমের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি সময় কাজ করতে হয়। খরচ বাঁচাতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে বাধ্য হয়। ফলে তারা একসময় অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই দুষ্টচক্র থেকে প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ষা করতে হবে। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে লাশ হয়ে ফিরেছে দুই হাজার ৮৪৭ জন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচ দেশ থেকেই ফিরেছে এক হাজার ৯৮৭ জনের মৃতদেহ। আর শুধু সৌদি আরব থেকেই এসেছে এক হাজার ১৯৩ জনের মৃতদেহ। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবাসে মারা যাওয়া শ্রমিকদের বড় একটি অংশেরই মৃত্যু হয় স্ট্রোকে। এরপর রয়েছে হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যা। তা ছাড়া আছে কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু ও সড়ক দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, আগুনে পুড়ে মৃত্যু, আত্মহত্যা বা খুন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রবাসীদের মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখা হয় না। মেডিক্যাল রিপোর্টে মৃত্যুর যে কারণ উল্লেখ করা হয়, সেটাই মেনে নিতে হয়। এমনকি শরীরে জখম বা নির্যাতনের চিহ্ন থাকলেও তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকে না। দূতাবাসগুলোও সেই অভিযোগ নিয়ে সক্রিয় হয় না।

রেমিট্যান্স যারা উপার্জন করে, নিজের ভালোমন্দের দিকে না তাকিয়ে সেই অর্থ যারা দেশে পাঠায় এবং আমাদের রিজার্ভ স্ফীত করে, তাদের প্রতি কি আমাদের কোনো করণীয় নেই? রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে কি দায়বদ্ধ করা যায় না? এ ক্ষেত্রে দূতাবাসগুলোকে আরো সক্রিয় হতে হবে।

এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও নানা রকম প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত রয়েছে। সউদি আরব, মালয়েশিয়ার মতো ট্রাডিশনাল শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য ভিসা জটিলতা নিরসন করে আরো বেশি সংখ্যক শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ বার বার হাতছাড়া হয়েছে। তবে এসব শ্রমবাজারে অদক্ষ পুরুষ শ্রমিকের নিয়োগ থমকে দাঁড়ালেও নারী শ্রমিক ও গৃহকর্মী নিয়োগ এখনো অবারিত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী শ্রমিকদের নিয়োগ গত দুই দশকে দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বিভিন্ন দেশে এক কোটির বেশি প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে ১০ লক্ষাধিক নারী শ্রমিক রয়েছে। বৈশ্বিক মন্দা এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানে স্থবিরতার মধ্যেও নারী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স আশা জাগানিয়া ভূমিকা রাখছে। মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের মূল বিশেষত্ব হচ্ছে, শূন্য অভিবাসন ব্যয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত নারী শ্রমিকরা বছরে গড়ে আড়াই লাখ টাকা আয় করছে। সরকারি হিসাবে শুধুমাত্র সউদি আরবেই সাড়ে চার লাখের বেশি বাংলাদেশি নারী শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। সউদিতে কর্মরত নারী শ্রমিকরা প্রতিমাসে সাড়ে ১২শ’ কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছে বলে বিএমইটির সূত্রে জানা যায়।

দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রবাসে পুরুষ শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নারী শ্রমিক নিয়োগের সাম্প্রতিক প্রবনতা গতানুগতিক ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। এর ফলে নারী-পুরুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার সাথে সাথে নারীর সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আত্মনির্ভরতার স্থানকেও মজবুত করেছে। অনেক পরিবারেই কোনো পুরুষ সদস্য নেই। একটি দরিদ্র পরিবারের পুরুষ সদস্যের মৃত্যুতে সন্তানের লেখাপড়া ও ভরণপোষণের সুযোগ রুদ্ধ হয়ে যখন পুরো পরিবারটির আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের বোঝা বা গলগ্রহ হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। নারী শ্রমিকের প্রবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ পরিবারের অর্থনৈতিক সুরক্ষা দিয়েছে। তবে সব সমাজেই ভালমন্দের সহাবস্থান রয়েছে। সউদী আরবের মতো পবিত্র ভূমিতেও বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীরা বৈষম্য, নিগ্রহ ও অধিকারহরণের শিকার হচ্ছে। ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, যৌন নিগ্রহ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে নারী শ্রমিকদের দেশে প্রত্যাবর্তনের কাহিনীও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। সউদী বা আরব আমিরাতে গৃহকর্মী অথবা জর্দানের পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকদের বঞ্চনার শিকার হওয়ার মতো ঘটনাগুলোর আইনগত প্রতিকার নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। সুষ্ঠু বিচার ও প্রতিকার না পেয়ে প্রবাসে নারী শ্রমিকদের আত্মহত্যার মতো ঘটনার দায় সরকারের সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারে না।

রফতানি বাণিজ্য, বৈদেশিক কর্মসংস্থানসহ দেশের অর্থনীতির মূল খাতগুলোতে মন্দা চলছে। এর মধ্যেও দেশ থেকে প্রতিমাসে নানাভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও ক্রমবর্ধমান হারে ভূমিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসে নারীদের ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দফতর ও দূতাবাসগুলো আশানুরূপ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের নারী-পুরুষ শ্রমিকরা বিদেশে যেমন মজুরি বৈষম্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে, একইভাবে দেশেও সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি, তাদের দালালদের অতিরিক্ত মুনাফাবাজির শিকার হচ্ছে। শূন্য অভিবাসন ব্যয়ে নিয়োগ প্রাপ্তির কথা বলা হলেও একেকজন নারী শ্রমিককেও দেড়-দুইলাখ টাকা ব্যয় করে বিদেশে যেতে হচ্ছে। ধার-দেনা, ঋণ করে বিদেশ যাওয়ার পর নিয়োগকর্তার নির্মম আচরণ ও হয়রানির শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ গিয়ে তারা উপরন্তু ঋণগ্রস্ত ও সর্বস্বান্ত হয়ে মানবেতর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় প্রবাসে নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। সেই সাথে প্রবাসে নিয়োগকর্তার দ্বারা নিগ্রহ, অনৈতিক আচরণের শিকার হওয়ার পর সে দেশের আইনে সুষ্ঠু বিচার ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আইনগত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসসমূহের সংশ্লিষ্ট উইংকে আরো দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে নারী-পুরুষ অদক্ষ শ্রমিক ও গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে তাদের নতুন দেশ ও কর্মস্থল সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত জরুরি প্রয়োজনে হটলাইনে যোগাযোগের সুযোগ নিশ্চিত করা হলে নির্যাতনের শিকার প্রবাসী শ্রমিকদের আত্মহত্যা বা মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক কমবে। প্রবাসি নারী শ্রমিকদের মর্যাদার সাথে দেশের মানমর্যাদা, সামাজিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার গভীর যোগসূত্র রয়েছে। সরকারকে এ দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ, কো-চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন