এই একটা কথা অনেক জায়গায় অনেকবার বলতে চেষ্টা করেছি যে, বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির জন্য মোটা দাগে আওয়ামী লীগ সরকারই দায়ী। অপর ভাষায়, এই কথাটি শেয়ার করতে চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা নিয়ে ২০১১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের সাথে অন্যায় আচরণ করেছে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে বিদগ্ধ ব্যক্তিরা যেন এই প্রসঙ্গে চিন্তা করতে পারেন এবং রাজপথে ও রাজপথের বাইরে আন্দোলনের যুক্তিগুলোকে আরো শক্তিশালী করা যায়, সে জন্যই কিছু কথা বলা। শুরুতেই যা বর্ণনা করছি, তার উদ্দেশ্য হলো, নাগরিক সমাজের কাছে তুলে ধরা যে, আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের ৫১ বছরের ইতিহাসে মোটা দাগে তিনবার দেশকে বা দেশের সরকার ব্যবস্থাকে বা শাসন পদ্ধতিকে বড় রকমের সঙ্কটে ফেলেছে, তৃতীয় সঙ্কটটিই বর্তমানে চলছে।
১৯৭৫-এর জানুয়ারি থেকে আগস্ট এই সময়টি হলো আওয়ামী লীগ কর্তৃক বাংলাদেশকে তথা তার শাসন ব্যবস্থাকে সঙ্কটে ফেলার প্রথম ঘটনা। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাত্র চারটি বাদে সব পত্রপত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীসহ সরকারি জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশালের সদস্য করার নিয়ম চালু হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে অথবা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রিত হতো। অনেক আগে প্রকাশিত আমার কলামে, আমি একজন প্রখ্যাত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ (নাম : টনি বেন)-এর একটি বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করেছিলাম। টনি বেন-এর সেই উক্তির একটি বাক্য ছিল সরকারকে উদ্দেশ করে বলা, ‘আপনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার কোনো রাস্তা কি খোলা আছে’? এটাই ছিল ওই ৭৫-এর বাংলাদেশের সঙ্কট।
১৯৮৬-তে একটি সময়ে, প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে এই মর্মে একমত হয়েছিল যে, তারা কেউই সামরিক শাসক এরশাদের অধীনে পার্লামেন্ট নির্বাচনে যাবে না, যেন এরশাদ সরকার বৈধতা না পায়। কিন্তু প্রকাশ্যে প্রদত্ত ওয়াদা ভঙ্গ করে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও তৎকালীন জামায়াতে ইসলামী, এরশাদ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে ১৯৮৬ সালে অংশ নেয়। এরশাদ সরকার সাংবিধানিক বৈধতা পায়। অপর ভাষায় বলা যায়, জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়া হয়। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের এক বছর পর, আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেও এরশাদ সরকার ক্ষমতায় থেকে যায়। সংসদ থেকে পদত্যাগের পর আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় রাজনৈতিক দলই এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে মনোনিবেশ করে। ওই সময় বাংলাদেশের জন্য যে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে পরবর্তী সাড়ে তিন বছর দেশবাসীকে রক্তমাখা রাজনৈতিক আন্দোলন করতে হয়েছিল। এটা ছিল আওয়ামী লীগ কর্তৃক সৃষ্ট, বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় সঙ্কট।
২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি দেখিয়েছিল। ২০১০-১১ সালের কথা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে বা ২০১৪ সালের জানুয়ারির শুরুতে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনকে নিজেদের পক্ষে নেয়ার নিমিত্ত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের জুলাই মাসের শুরুতে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে। ১৯৯৬ সালে যে আইনের মাধ্যমে তথা সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল করা হয়েছিল সেটি ছিল ত্রয়োদশ সংশোধনী। যে প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে এই পঞ্চদশ সংশোধনীটি আনা হয়েছে, সেগুলো জাতির সাথে প্রতারণা বা শুভঙ্করের ফাঁকির পর্যায়ে পড়ে। সেই কারণেই, আওয়ামী লীগ কর্তৃক সৃষ্ট তৃতীয় সঙ্কট। এই দীর্ঘ কলামের পরবর্তী অংশে এর কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা আছে।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়েছিল, সেই সংশোধনীকে বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করার জন্য বা অপর ভাষায় ওই আইনটিকে অবৈধ ও অকার্যকর ঘোষণা করার জন্য, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে, একটি রিট মামলা করা হয়েছিল। উপযুক্ত সময়ে, হাইকোর্টের বিচারপতিরা তাদের রায় প্রদান করেন। হাইকোর্টের বিচারপতিদের রায় মোতাবেক, ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে করা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী, বাংলাদেশের সংবিধানসম্মত এবং আইনানুগ ঘোষিত হয়। অর্থাৎ রিট খারিজ হয়ে যায়। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের ২৯ তারিখ বাংলাদেশে নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পর, আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করা হয়। আপিল বিভাগের বিচারপতিরা শুনানির জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন। নিজেদের সন্তুষ্টি ও উপকারের জন্য তারা সাতজন অ্যামিকাস কিউরি (বাংলা অর্থ : আদালতের বন্ধু) নিযুক্ত করেছিলেন। অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে একজন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিপক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন; কিন্তু অন্য সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল রাখার অনুকূলে বক্তব্য রেখেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার তথা আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির অনুকূলে বক্তব্য রাখেন। অতঃপর আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যথাসময়ে রায় প্রদান করেন। রেওয়াজ মোতাবেক, রায় প্রদান দুই ধাপে হয়েছিল। ১০ মে ২০১১ তারিখে মহামান্য আদালত মৌখিকভাবে একটি সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনান, যে রায়টি সাথে সাথে বা পরবর্তী সময়ে মিডিয়াতে প্রচার হয় এবং ওই সংক্ষিপ্ত রায়ের লিখিত রূপ আগ্রহী বা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের কাছে যথাযথ নিয়মেই পৌঁছে যায়। সংক্ষিপ্ত মৌখিক রায় প্রদানের প্রায় ১৬ মাস পর, দীর্ঘ লিখিত রায় প্রদান করা হয়। এই কলামের, এই পর্যায়ে, আমরা আদালতের আলোচনা থেকে অন্যত্র সরে যাচ্ছি সাময়িকভাবে।
২০১০ সালের শেষাংশে, তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে, বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের নিমিত্ত, পার্লামেন্টে একটি বহুদলীয় কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিনিধিত্ব থাকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, ওই আমলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সেই কমিটিতে বেশির ভাগ সময়ে অংশগ্রহণ করেনি, যেকোনো কারণেই হোক না কেন। কমিটি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করে। আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানতে পেরেছিলাম যে, ওই কমিটি যতজনের মতামত গ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় সবাই এবং অন্যান্যের মধ্যে বেশির ভাগই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল রাখার অনুকূলে মতামত প্রদান করেছিলেন। কিন্তু সেই সুপারিশমালা যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাবরে উপস্থাপিত হয়েছিল, তখন অপ্রকাশিত বা অজ্ঞাত কারণে তিনি ওই সুপারিশের সাথে একমত না হয়ে, বিপরীত মতামত প্রদান করেছিলেন। তার মতামতই কমিটির কাছে আদেশ হিসেবে শিরোধার্য হয়ে যায়। তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার ব্যবস্থা করতে মতামত বা নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। ওই বহুদলীয় সংসদীয় কমিটির মতামত বা সুপারিশ সংবলিত সংশ্লিষ্ট কাগজগুলো বা কার্যবিবরণীর পৃষ্ঠাগুলোর কপি, বিখ্যাত সংগঠন ‘সুজন’-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের কাছে রক্ষিত আছে বলে আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানতে পেরেছি। জাতীয় সংসদের উপযুক্ত বিভাগের কাছেও অবশ্যই রক্ষিত থাকার কথা। অতএব, চূড়ান্ত পর্যায়ে সেই সংবিধান সংশোধনী কমিটি, সুপারিশ প্রদান করেছিল : তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের জন্য, তথা সংবিধান থেকে ওই সংক্রান্ত বিধান বাতিলের জন্য। উল্লেখ্য যে, ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখের নির্বাচনের আগে পরে, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন প্রকারের বক্তব্যে, মাননীয় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তাদেরই আন্দোলনের ফসল এবং ওয়ান ইলেভেন সরকারও তাদেরই আন্দোলনের ফসল। কিন্তু তিনি ২০১১-তে এসে ঠিক বিপরীত মতামত প্রদান করলেন। ১৯৮৬ সালে যেমন বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আহরিত আভ্যন্তরীণ সমঝোতা ও নিজেরই দেয়া প্রকাশ্য বক্তব্য তিনি লঙ্ঘন করেছিলেন, এখনো তেমনই লঙ্ঘন করলেন। যা হোক, এখন আমরা পুনরায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কথায় ফিরে আসি।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত রায় প্রদানের তারিখ ১০ মে ২০১১। এর পরপরই, দীর্ঘ লিখিত রায়ের জন্য অপেক্ষা না করেই সংবিধান সংশোধন করা হয় ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারিখে। তখন বলা হয়েছিল এবং এর পর থেকে সর্বদাই বলা হয়েছে যে, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হলো। সরকারদলীয় লোকেরা সবাই বলতেন যে, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে যেহেতু অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন, সেহেতু পার্লামেন্টের সামনে ওই পদ্ধতি বাতিল করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। এখানেই প্রতারণা বা শুভঙ্করের ফাঁকি।
দু’টি প্রাচীন প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার আলোকে, দশম এবং এগারোতম সংসদ নির্বাচন এই মামলায় আলোচ্য বা তর্কিত, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর বিধানগুলোর আওতায় অনুষ্ঠিত হতে পারে। সেই প্রাচীন প্রতিষ্ঠিত দু’টি নীতিমালার প্রথমটি হচ্ছে : ‘যা সাধারণত আইনানুগ নয়, সেটিই আইনানুগ হয়ে দাঁড়ায় বাস্তব প্রয়োজনীয়তার নিরিখে’। দ্বিতীয় নীতিমালাটি হচ্ছে : ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় আইনই হচ্ছে সর্বজ্যেষ্ঠ আইন’। যা হোক, বাংলাদেশের পার্লামেন্ট ইতোমধ্যে, নিজেদের ইচ্ছায় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত বিধানগুলোতে সংশোধন আনতে পারেন এই মর্মে যে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতিরা বা আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতিরা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হবেন না।’ বাংলা ভাবানুবাদ শেষ।
১০ মে ২০১১ তারিখে প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত রায়ের বিশ্লেষণ করলে, বিশেষত যে তিন নম্বর অনুচ্ছেদটি ইংরেজিতে উদ্ধৃত করা হয়নি; কিন্তু বাংলা ভাবানুবাদ দেয়া হয়েছে, সেই অংশকে বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত আঙ্গিকগুলো ভেসে ওঠে। প্রথম আঙ্গিক : রায়ের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ মোতাবেক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি, যা ১৯৯৬ থেকে চালু ছিল, সেটিকে সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘোষণা করা হলো। দ্বিতীয় আঙ্গিক : অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও জনগণের নিরাপত্তা বা জনগণের মঙ্গল তথা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে এবং বাস্তবতার নিরিখে ওই বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতেই দশম এবং এগারোতম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যাবে, সংবিধান সংশোধনী সাপেক্ষে। তৃতীয় আঙ্গিক : বাংলাদেশের পার্লামেন্ট এই সংক্ষিপ্ত রায়ের আলোকে সংবিধানে সংশোধনী আনতে পারে, তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে সংশোধন করতে পারেন, নিম্নলিখিত বিধানকে শামিল করার নিমিত্তে। সেই বিধানটি হলো এই যে, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতিরা বা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতিরা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালনের সাথে কোনো প্রকারে জড়িত থাকতে পারবেন না।
২০১১ সালের মে মাসের ১১ তারিখ সংক্ষিপ্ত রায় প্রদান করা হয়েছিল। তার পরপরই ২০১১ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে অর্থাৎ ছয় থেকে সাত সপ্তাহের মধ্যেই, পার্লামেন্ট কর্তৃক সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। সেই সময়ে তথা ৩ জুলাই ২০১১ তারিখে সংবিধানের সংশোধনীতে যত বিধান বা নির্দেশ বিস্তারিত লেখা আছে সেগুলো সুপ্রিম কোর্টের সংক্ষিপ্ত রায়ে ছিল না। রায়ে যে ছিল না, এই কথাটি দীর্ঘ রায় প্রদানের সময়, ভিন্নমত অবলম্বনকারী বিচারপতিরা লিখিতভাবে উল্লেখ করেন, যা উপরে কিছু আগে উল্লিখিত সূত্রে (এডিসি) অনুচ্ছেদ নম্বর ১৫৯৭ এবং ১৫৯৮-তে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। সূত্রের পৃষ্ঠা ৩৩৪ থেকে ৩৪৮ দ্রষ্টব্য। সেই লিখিত দীর্ঘ রায়ে লেখা না থাকলেও, সরকারি রাজনৈতিক দল কর্তৃক জনগণকে অব্যাহতভাবে বলা হলো যে, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে বা হয়েছে।’ আসলে ২০১১ সালের মে মাসের ১১ তারিখের ১৬ মাস পরে দীর্ঘ লিখিত রায় প্রদানের সময়, যেসব বিস্তারিত নির্দেশিকা বা বিধান দেয়া হয়েছে, সেগুলো ১৫-১৬ মাস আগে ৩ জুলাই ২০১১ তারিখেই বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনৈতিক সরকার কর্তৃক পার্লামেন্টের মাধ্যমে যেসব সংশোধনী সংবিধানে সন্নিবেশ করেছিলেন, ওই বিধানগুলো দীর্ঘ লিখিত রায়ের মাধ্যমে ১৬ মাস পর আদালতীয় বৈধতা বা বিচারিক বৈধতা পায়। এখন যদি এ কথা বলা হয় যে, ‘সুপ্রিম কোর্টের দীর্ঘ আনুষ্ঠানিক রায়ের কারণে সংবিধান সংশোধন হয়নি বরং সংবিধান সংশোধনের কারণে দীর্ঘ রায়ে অনেকগুলো নির্দেশিকা দেয়া হয়েছে’, তাহলে কি অতিরঞ্জন হবে? এখানেই জনগণের সাথে প্রতারণা অথবা সাংবিধানিক বা পার্লামেন্টারি কার্যক্রমে শুভঙ্করের ফাঁকি। ওই দীর্ঘ রায়টি উপরে ইংরেজি ভাষায় উল্লিখিত জার্নালের (এডিসি) ১৬ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে পরবর্তী ৩৬৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মুদ্রিত আছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমেও কোনো আগ্রহী পাঠক এই রায় পড়তে পারবেন।
ওই দীর্ঘ রায়ের এক জায়গায় ১১৮৪ নম্বর অনুচ্ছেদে উপ-অনুচ্ছেদ-১ প্রত্যক্ষভাবে বর্তমান রাজনৈতিক সরকার সাম্প্রতিককালে লঙ্ঘন করেছে। সে উপ-অনুচ্ছেদ-১, এখানে উদ্ধৃত করছি : ‘সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের বিবেচনা (ইংরেজি ভাষায়, ডিসক্রিশন) অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল (ইংরেজি ভাষায়, রিজনেবল পিরিয়ড) পূর্বে যথা ৪২ (বিয়াল্লিশ) দিন পূর্বে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়া বাঞ্ছনীয় হইবে, তবে নির্বাচন পরবর্তী নতুন মন্ত্রীসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণকরত: উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করিবেন’। উদ্ধৃতি শেষ। পাঠক খেয়াল করবেন যে, বিগত নবম সংসদ ‘ভাঙ্গিয়া দেওয়া হয় নাই’; বরং তা বহাল থাকা অবস্থাতেই প্রত্যক্ষ নির্বাচনের পরিবর্তে ১৫৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং পুরো নবম সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় দশম সংসদের সব সদস্যকে নির্বাচিত ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়।
আরো তিন চারটি উল্লেখযোগ্য তথ্য প্রদান করছি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি কর্তৃক সংক্ষিপ্ত রায় প্রদান করা হয়েছিল ১০ মে ২০১১ তারিখে। ২০ অক্টোবর ২০১১ সালে সংশোধিত বাংলাদেশের সংবিধান পুনর্মুদ্রণ হয়। ওই একই মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব এ বি এম খায়রুল হক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত হন এবং অবসরে যান ১৮ মে ২০১১ তারিখে। অর্থাৎ অবসরে যাওয়ার মাত্র সাত দিন আগে তিনি সংক্ষিপ্ত রায় প্রদান করেছিলেন। সাত দিন তো লম্বা সময়, এক দিন আগেও রায় দেয়া বৈধ। কিন্তু পরের তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি অর্থাৎ একই মাননীয় প্রধান বিচারপতি পরবর্তী ১২/১৩ মাস যাবৎ নিজের অবসরজীবনে শপথবিহীন অবস্থায়, ব্যক্তিগত পরিবেশে, ওই দীর্ঘ রায় লিখেছিলেন। বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে ওই দীর্ঘ লিখিত রায় প্রদান করা হয় ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে। কিন্তু রায়ে তারিখ দেয়া হয় পেছনের তারিখ অর্থাৎ ব্যাক ডেটে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণ বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ওই রায় প্রদান করেননি। যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের সব বিভাগের মাননীয় বিচারপতিদের জ্ঞানগর্ভ মতামত মূল্যবান, সেহেতু ভিন্নমত অবলম্বনকারী বিচারপতিদের মতামতও সচেতন নাগরিকদের জানা প্রয়োজন।
আমি এই কলামটি লিখতে গিয়ে একটি পুস্তকের সহায়তা গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ‘গণতন্ত্র ও আইন গবেষণা কেন্দ্র’ নামক প্রতিষ্ঠানের আহ্বায়ক (১৪/১, কোর্ট হাউজ স্ট্রিট, হায়দার ম্যানশন দ্বিতীয় তলা, ঢাকা) জনাব অ্যাডভোকেট মো: মুবিনুল হক একটি বই লিখেছেন যার নাম ‘গণতন্ত্রের সংলাপ’, যেটি ‘সদর প্রকাশনী’ নামক সংস্থা ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করেছেন। ওই মূল্যবান পুস্তকের পৃষ্ঠা নম্বর ৫৪ থেকে ৬১ এবং ৬৮ থেকে ৭৬-এ অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। আমি নিজে যেহেতু আইনবিদ নই, সেহেতু আমি রাজনীতিবিদ হিসেবে আইনি চেতনা যতটুকু অনুভব করি তার সাথে, মুবিনুল হকের বিশেষণধর্মী আলোচনার সারমর্ম সংমিশ্রণ ঘটিয়েছি।
এই দীর্ঘ কলাম শেষ করছি ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে, সাড়ে আট বছর আগে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তৎকালীন মাননীয় প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে। শনিবার ৫ এপ্রিল ২০১৪ একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি বলেছিলেন যে, ‘দেশের সব আদালতের বিচারকই সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন। তবে তারা আইনের ঊর্ধ্বে নন।’ দ্বীন ইসলাম মোতাবেক সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্ববিষয়ের সর্বপ্রধান বিচারক হচ্ছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। দুনিয়াবি নিয়মে, প্রশাসনই আদালতের বিচারপতি বা বিচারক নিযুক্ত করে। বর্তমান দুনিয়ার গণতন্ত্রের আবহে নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রণয়ন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের সব কর্মের সর্বপ্রধান বিচারপতি হচ্ছে ভোট প্রদানকারী জনগণ। ২০২২ সালের শেষ সপ্তাহে জনগণের কাছে বিচার দাখিল করলাম।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন