বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের বিষয়টি ক্ষমতাসীন দল ও তার সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একটি অপবাদ থেকে বের হয়ে এসেছে। এ অপবাদটি ছিল, ‘বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রাম মানেই সহিংসতা এবং বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল।’ তাদের এ কথা বলার সুযোগ কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল কিংবা দলটির গায়ে কিভাবে এই তকমাটি লাগিয়ে দেয়া হয়, তা বোধকরি সবাই জানে। অন্তত বিএনপি সমর্থকরা তা ভালো করে জানে। বিগত একদশক ধরে দলটিকে এই অপবাদ বয়ে বেড়াতে হয়েছে এবং এই অপবাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন দল তাকে রাজনীতির মাঠ থেকে এক প্রকার বিদায়ই করে দিয়েছিল। তবে একদশক পর কিছুটা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপিকে বাধা-বিঘ্নর মধ্যেই সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। দলটির উদগ্রীব নেতা-কর্মী এমনকি সাধারণ মানুষও শত বাধা পেরিয়ে সভা-সমাবেশে যোগ দিচ্ছে। নানা ধরনের উস্কানি হামলা-মামলা সত্ত্বেও দলটির নেতা-কর্মীরা অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে সভা-সমাবেশ ও মিছিল শান্তিপূর্ণভাবে পালন করে চলেছে। এতেই ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে কিছুটা অসহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিষয়টি এমন, বিএনপির আন্দোলনকে এখন কোনোভাবেই ‘সহিংস’ হিসেবে অভিহিত করতে না পারা। তারপরও ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও নেতারা বলছেন, বিএনপি সহিংসতা করলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। আমরা বসে থাকব না। আমাদের নেতা-কর্মীরা সতর্ক পাহারায় থাকবে। এসব কথার মধ্যেই আপাতত সান্ত¦না খুঁজে পাচ্ছে।
দুই.
বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবী আদায়ের নজির খুব বেশি নেই। সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন কিংবা অবস্থান ধর্মঘট করে সরকারের কাছ থেকে দাবী আদায় করা গেছে, এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। বরং দাবী-দাওয়া আদায়ের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বরবারই ব্যবহৃত হয়েছে হরতাল, ভাঙচুর বা অবরোধের মতো আন্দোলন-সংগ্রাম। এ ধরনের আন্দোলন না হলে সরকারের টনক নড়ে না। তবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেও যে দাবী আদায় করা যায়, তার বড় নজির স্থাপিত হয়েছিল ২০১৮ সালের এপ্রিলে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। বলা যায়, সরকার বাধ্য হয়েছিল শিক্ষার্থীদের দাবী মেনে নিতে। এ আন্দোলন এতটাই সুশৃঙ্খল ছিল যে, কেবলমাত্র রাস্তা-ঘাটে যানজট সৃষ্টি ছাড়া কোনো ধরনের যানবাহন ভাঙচুর বা সহিংসতা ছিল না। আন্দোলনের শুরুর দিকে পুলিশের গুলি ও টিয়ারশেল এবং আন্দোলনকারীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হামলার মতো ঘটনা ঘটেছিল, যাতে আন্দোলনকারীদের কোনো ধরনের ভূমিকা ছিল না। যদিও পরবর্তীতে এসব কোনো কিছুই আন্দোলনকারীদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, এ আন্দোলন সফল হওয়ার কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আন্দোলনের যদি ন্যায্যতা থাকে এবং এর মূল চালিকাশক্তি যদি তরুণরা হয় ও সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকে, তবে সরকার যত শক্তিশালী এবং নিপীড়ক ও কঠোর হোক না কেন, তার বুক কেঁপে ওঠে। স্যাবোটাজের মতো ঘটনা উপেক্ষা করে এবং সরকারি দলের কিছু নেতা ও সমর্থক বুদ্ধিজীবী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটিয়েও শিক্ষার্থীদের অভিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কাছে যে সরকার পরাভূত হয়ে দাবি মানতে বাধ্য হয় তা এই আন্দোলন থেকে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। বিএনপি এখন যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে, তাতে তেজ কম থাকলেও তার দাবিগুলো জোরালো হয়ে উঠছে। দলটির সভা-সমাবেশে নেতা-কর্মীসহ অনেক সাধারণ মানুষও যুক্ত হচ্ছে, যদিও সরকার তা মানতে নারাজ। সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, এখানে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা নেই। কেবলই বিএনপির নেতা-কর্মী। এটা উপেক্ষা করে যাচ্ছে, যেকোনো আন্দোলনে দলের নেতা-কর্মীদেরই আগে সংগঠিত হতে হয়, আন্দোলন শুরু করতে হয়। তাদের সংগঠিত হওয়া দেখে সাধারণ মানুষও সম্পৃক্ত হয়। ক্ষমতাসীন দলের সভা-সমাবেশেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে দলের নেতা-কর্মীই থাকে। তারপর তার সমর্থকরা যুক্ত হয়। এটাই বাস্তবতা। বিএনপি যেভাবে বাধা পেরিয়ে দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করছে এবং তাতে নেতা-কর্মীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যুক্ত হচ্ছে, তা ক্ষমতাসীন দলের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে, বর্তমান সরকারের যে মনোভাব, তাতে আন্দোলন করে দাবি আদায় করা কঠিন। বিরোধীদলগুলোর দাবি যত যৌক্তিক হোক না কেন, সরকার তা মানতে নারাজ। মানতে গেলে তার ক্ষমতায় থাকা খুবই কঠিন। কোনো সরকারই বিরোধীদলের দাবি মানতে চায় না। উল্টো সরকার মনে করে, বিরোধীদলের দাবি যতই যৌক্তিক হোক, তার তোয়াক্কা করার সময় তার নেই এবং তা দমনে যা যা করার দরকার তাই করা হবে। এমন কঠোর মনোভাবের কারণে সরকারকে ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে কর্তৃত্ববাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে সরকারের মধ্যে তেমন কোনো বিচলন নেই। বরং মনে মনে যেন খুশিই। বলা বাহুল্য, সরকারবিরেধী যেকোনো ন্যায্য আন্দোলন যখন ব্যর্থ হয় বা সরকার দমিয়ে ফেলতে পারে, তখন সে কতটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে বা ওঠতে পারে এবং আন্দোলনকারীদের পরিণতি কতটা নাজুক হয়, তা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার দাবীতে বিএনপি ও তার জোট যখন আন্দোলন করে, তাতে তারা সফল তো হয়ইনি, উল্টো সরকার তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে দমন শুরু করে। বলা হয়ে থাকে, এই আন্দোলন বিএনপি যতটা না করেছিল, তার চেয়ে বেশি করেছিল সরকারের বিভিন্ন লোকজন। আন্দোলনে স্যাবোটাজ করে তা ভয়ংকর রূপ দিয়েছিল। অর্থাৎ সরকার আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয়েছিল। বিরোধীদলের সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর সরকার বিএনপিকে একসুতোও ছাড় দেয়নি। দলটির নেতা-কর্মীদের ওপর এমন অত্যাচার, নির্যাতন এবং হামলা-মামলা দেয়া হয় যে, এখন পর্যন্ত তাদের আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। দলের সভা-সমাবেশ দূরে থাক, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি মানববন্ধন পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। ৫ জানুয়ারির আন্দোলনকে উসিলা ধরে বিএনপির কর্মসূচি সহিংস হবে এমন আগাম ধারণা করে সরকার সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া এক প্রকার বন্ধ করে দেয়। বিএনপি যতই বলুক সে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবে, সরকার ঐ এক উসিলায় মানতে চায় না। উল্টো বিএনপির আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই, নিঃশেষ হয়ে গেছে, মাজাভাঙা দল ইত্যাদি নানা ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকে। এখন অবশ্য এসব কথা শোনা যায় না। এর কারণ হচ্ছে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। সরকার যেভাবে একটি দেশের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে এসেছে এবং অন্য প্রভাবশালী দেশগুলো তা মেনে নিয়েছে, সেই পরিস্থিতি এখন নেই। এখন প্রভাবশালী দেশগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে এবং বিরোধীদলের অবাদ সভা-সমাবেশ করতে দেয়ার কথা বলেছে। এতেই সরকার অনেকটা নরম হয়েছে। সেই আগের মতো রাস্তায় নামতে না দেয়ার অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এটা দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সরকারের জন্য অস্বস্তিকর হলেও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় বাধ্য হয়ে বিরোধীদলের সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে। বিরোধীদলগুলোও শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করছে। এটা ক্ষমতাসীন দলের জন্য মোটেই সুখের বিষয় নয়। কারণ, বিরোধীদলের কথা সাধারণ মানুষের কানে যাচ্ছে এবং তাদের ভাবাচ্ছে। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছা অনুযায়ী বা ছলচাতুরিপূর্ণ হওয়া খুবই কঠিন।
তিন.
সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের মেয়াদের শেষ বছরে নানা জটিলতা দেখা দেয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। সরকারও এ সময় অনেকটা ব্যাকফুটে থাকে। এর কারণ হচ্ছে, একদিকে তার ক্ষমতায় টিকে থাকা, অন্যদিকে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়টি দেশে-বিদেশে এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে এ দাবিতে আন্দোলনে করছে। তবে ক্ষমতাসীন দল সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করার পক্ষে অনড় অবস্থানে রয়েছে। বারবারই বলছে, কিছুতেই সংবিধানের বাইরে যাবে না। তার অধীনেই নির্বাচন হবে। পাশাপাশি বিএনপি যাতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে খুব বেশি আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে এ জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করছে। দলটির রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে নানাভাবে বাধা দিচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই দলটির কোনো না কোনো নেতাকর্মী গ্রেফতার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দশটি বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে দলটির প্রায় পঁচিশ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার ও মামলা দেয়া হয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে। এছাড়া পুরনো মামলা নতুন করে সচল করা এবং গ্রেফতার করা হচ্ছে। দলটির মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। বলা যায়, বিএনপিকে কোনঠাসা করে রাখা এবং আন্দোলন যাতে জোরালো করতে না পারে এজন্য সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সরকারের এই কঠোর মনোভাবের মধ্যে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সে বিরোধী দলের অবাধ রাজনীতি করার সুযোগ দিতে চায় না। শুধু বিরোধী দলই নয়, সরকারের কর্মকাণ্ডের যাতে সমালোচনা ও ভিন্নমত পোষণ করতে না পারে, সেজন্য নানাভাবে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। বলা যায়, সরকার বিরোধীদল ও মতকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে নির্বাচন করতে চায়। যেমনটি দেখা গিয়েছিল তিউনিসিয়ায়। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বেন আলী প্রায় ২৩ বছর ধরে বিরোধী রাজনীতি, মত, পথ, বাক স্বাধীনতা স্তব্ধ করে রেখেছিলেন। তার স্বেচ্ছাচারিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষের প্রতিবাদ করার সুযোগই ছিল না। যারাই প্রতিবাদ করত, তাদের কঠোরভাবে দমন করা হতো। পাশাপাশি দেশটির বেকারত্ব, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ি সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিপীড়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, অতি সাধারণ মানুষও তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেত না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, বেন আলীর দুঃশাসন থেকে তিউনিসিয়ার জনগণ মুক্তির কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। এমনই এক দুঃসময়ে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ছোট্ট একটি ঘটনা থেকে বেন আলীর পতনের সূচনা হয়। প্রাদেশিক শহর সিডি বউজিদে মোহাম্মদ বউআজিজ নামে এক সবজি বিক্রেতা প্রতিদিনের মতো সকালে তার ভ্যানগাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিল। এমন সময় এক মহিলা পুলিশ তাকে আটকায়। বউআজিজ বরাবরের মতো তার এক দিনের আয় দশ দিনার জরিমানা দিতে চেষ্টা করে। এতে ঐ পুলিশের মন ভরেনি। সে তাকে থাপ্পড় মারে এবং ভ্যানগাড়িটি জব্দ করে নিয়ে যায়। বউআজিজ অভিযোগ নিয়ে মিউনিসিপ্যাল হেডকোয়ার্টারে যায় এবং তার ভ্যানগাড়িটি ফেরত চায়। সেখান থেকে সে কোনো প্রতিকার পায়নি। পরে ক্ষুদ্ধ ও অপমানিত বউআজিজ মিউনিসিপ্যাল হেডকোয়ার্টারে গিয়ে নিজের গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে এবং প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। ফেসবুক-ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বউআজিজের ছবি ছড়িয়ে পড়ে। সব পেশার মানুষ এর প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের ওপর টিয়ার গ্যাস, গুলি, লাঠিচার্জ শুরু করলে আন্দোলন সহিংস রূপ লাভ করে। সরকার আন্দোলনের এসব খবর মিডিয়াতে প্রচার সীমিত করে। শহরটিতে মিনি কারফিউ জারি করা হয়। এতেও আন্দোলন থামেনি বরং তা রাজধানী তিউনিসসহ অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ নিয়ে ছাত্র, শ্রমিক, আইনজীবীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আন্দোলনে নেমে পড়ে। বেকারত্ব, দুর্নীতি, অত্যাচার-নির্যাতন এবং বেন আলীর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তারা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। ঐ বছরের ২৮ ডিসেম্বর বেন আলী এক টেলিভিশন ভাষণে আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে বলে ঘোষণা দেন। এতেও আন্দোলনকারীরা দমে যায়নি। তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে যেতে থাকে। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি বেন আলী সরকার ভেঙ্গে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং আন্দোলনের মাধ্যমে সরে যাওয়া থেকে বাঁচতে ছয় মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণাতেও কাজ হয়নি। আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত ঐ দিনই বেন আলী দেশ থেকে পালিয়ে সউদী আরবে আশ্রয় নেন। তিউনিসিয়ার গণমানুষের আন্দোলন সফল হয় এবং জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা এক স্বৈরশাসকের পতন ঘটে। অথচ এর সূচনা হয়েছিল এক সবজী বিক্রেতার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ঘটনার সূত্রপাত সামান্য হলেও এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে গণতন্ত্রকামী মানুষের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ ও বঞ্চনা। বাংলাদেশেও স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন এভাবেই ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে হয়েছিল। এসব উদাহরণ থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, স্বৈরাচার যে ফরমেটেই থাকুক না কেন, একসময় তাকে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও বিক্ষোভের অনলে পুড়তে হয়। কারণ স্বৈরশাসক নিজেকে রক্ষা ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এমনসব অনিয়ম ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যা সাধারণ মানুষকে বিক্ষুদ্ধ করে তোলে। তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ ও প্রতিকারের পথ সরকার বন্ধ করতে পারলেও কোনো না কোনো সময় তার প্রকাশ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ থেকে ভয়াবহ দাবানলের সৃষ্টি হয়।
চার.
অস্বীকারের উপায় নেই, বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার সংকট চলছে। দুটোই সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দুর্নীতি, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা, সামাজিক অস্থিরতা, বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড, খুন, গুম, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার অসীম ব্যবহারসহ নানা নেতিবাচক দিকের প্রকাশ ঘটছে। সরকার যতই উন্নয়নের কথা বলুক না কেন, দীর্ঘ মেয়াদের এসব নেতিবাচক দিকের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে তা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য বলে কিছু নেই। এমন একটি অপসংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটেছে যে, দেশে কেবল ক্ষমতাসীনরাই দাপিয়ে বেড়াবে আর অন্যরা তা মেনে নেবে। এ ধরনের প্রবণতা স্বৈরশাসনকেই প্রতিষ্ঠিত করে। সরকার মনে করছে, তার বিরোধীমত মেরে-কেটে দমিয়ে কেবল উন্নয়ন করলেই জনগণ খুশি থাকবে। এ ধারণা যে ভুল, তা সবদলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিএনপি এ কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে। সরকার তা উড়িয়ে দিচ্ছে। তবে সরকারের এ উড়িয়ে দেয়া থেকে বোঝা যায়, সরকার হয়তো নিজেও জানে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে হেরে যাবে। এ ভয়েই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে ভয় পায় এবং নিজের অধীন ছাড়া নির্বাচন করতে রাজী নয়। যদি সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং বিএনপি এ নির্বাচনে না যায়, তবে এটা নিশ্চিত আগামী নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে না।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন