শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

যেভাবে দেশে শিল্পের বিকাশ হয়েছে

মো: আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রাচীন কাল থেকেই বাংলা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কারুশিল্পের জন্য খ্যাত। পাঁচ শতকে বাংলার সর্ববৃহৎ বন্দরনগরীর সাথে দক্ষিণ ভারত, সিংহল, বার্মা, মালয়, পারস্য উপসাগর এবং দূরপ্রাচ্যের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। এই সময়ে প্রধান প্রধান উন্নত শিল্পসমূহের মধ্যে ছিল বস্ত্রশিল্প, চিনি শিল্প, লবণ শিল্প, গজদন্ত শিল্প এবং ধাতু শিল্প। আট শতকে আরব দেশীয় বণিকগণ চট্টগ্রামের সাথে বহির্বিশ্বের বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অনেক আগে থেকেই বাংলায় নৌকানির্মাণ শিল্প উন্নতি লাভ করে। ঢাকার মসলিন বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করে। এমনকি পূর্বে বস্ত্র, চিনি, লবণ ও অলঙ্কার রপ্তানিতে বাংলার রেকর্ড ছিল। ৬০০ সালের দিকে হস্তশিল্পও সমৃদ্ধি লাভ করে। অবশ্য উৎপাদনকারীদের কার্যক্রম কয়েক প্রকারের দ্রব্য উৎপাদনের মধ্যেই দীর্ঘদিন সীমাবদ্ধ ছিল এবং সতেরো শতক পর্যন্ত এর বিকাশ হয়েছে ধীর গতিতে। মুগল আমলে বাংলায় উৎপাদন ক্ষেত্রে তেজি ভাব আসে। রপ্তানি বাজারে বিদেশীদের অংশগ্রহণ শিল্প উন্নয়নে নতুন প্রেরণা যোগায়।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুদ্রার প্রসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় এবং মূলধন গঠন প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়। ফলে নতুন নতুন বাজার ও উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হয়। উৎপাদন ও বাজারের প্রসার ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও বীমা খাতে বাণিজ্যিক কাগজপত্রের ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলে। বাজার সম্প্রসারণের সাথে সাথে চিনি উৎপাদন জোরদার করা হয়। সতেরো শতকে নোনা পানি থেকে লবণ উৎপাদনে ব্যাপক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়। এই সময়ের মধ্যে বাংলায় অন্যান্য যে সকল দ্রব্য উৎপাদনের প্রসার ঘটেছিল তার মধ্যে কৃষি যন্ত্রপাতি, ধাতুনির্মিত দ্রব্যাদি ও অস্ত্রপাতি, তামার ছাঁচ, গজদন্ত ভাস্কর্য, কাঠের কারুকাজ, সূচিশিল্প, অলঙ্কার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে বাংলায় বস্ত্রশিল্প ছিল সম্পূর্ণ কুটিরশিল্প নির্ভর। বস্ত্র উৎপাদন ও বস্ত্র ব্যবসার অর্থায়নে মহাজনগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক দাদন প্রথার মাধ্যমে ও এজেন্সি পদ্ধতিতে তাঁতিদের ঋণ দেওয়া হতো। দাদন প্রথা কালক্রমে কারিগর শ্রেণির জন্য প্রতিকূল, এমনকি অত্যাচারমূলক হয়ে ওঠে। এর ফলে বহু তাঁতি প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পেশা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

এসব শিল্প উপনিবেশিক আমলে ধ্বংস হয়। এর কারণ একদিকে বৃটিশ সরকার কর্তৃক ব্রিটেনের বাজারে প্রেরিত কাপড়ের উপর শুল্ক ও শুল্ক বাধা, অপরদিকে শিল্প বিপ্লবে বিকাশমান বস্ত্রশিল্প। অবশ্য বৃটিশ আমলেই সরকারের বাণিজ্যিক নীতিমালার অধীনে বহিঃবিশ্বের সাথে বাংলার বস্ত্রশিল্পের বাণিজ্য চলতে থাকে এবং বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া হয়। ভারতের রেশম শিল্প প্রধানত বাংলায় কেন্দ্রীভূত ছিল এবং ব্রিটিশদের শাসন আরম্ভের প্রথম থেকেই এই শিল্প তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

রেশমগুটি চাষ ও রেশম উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদের অংশবিশেষ এখন রাজশাহীর অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য মধ্য ঊনিশ শতকে চীন ও জাপানে উৎপাদিত সস্তা রেশমের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে এবং ব্রিটেনে উৎপাদিত বিকল্প বস্ত্রের দ্রুত মূল্য হ্রাসের জন্য বাংলার রেশম শিল্পের প্রসার ব্যাহত হয়। ব্রিটিশ আমলে যে সকল বৃহদাকার শিল্পের উন্নয়ন করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল লবণ ও চিনি শিল্প। এই লবণ ব্যবসায়ের দুটো পরিণতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল: এক, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লবণ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং দুই, বর্ধিত ট্যাক্সের জন্য লবণের ঊর্ধ্বগামী মূল্য সাধারণ ও গরিব ভোক্তাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে।

ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটিশ সরকার স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত লবণের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমদানিকৃত লবণের জন্য আমদানি কর ধার্য করে। এছাড়াও আমদানিকৃত লবণের মান উন্নততর বলে আমদানিকৃত লবণের জন্য দেশীয় লবণশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলা চিনিশিল্পে প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু ১৮৪৬ সাল থেকে বাংলা ব্রিটেনে চিনির বাজার হারায়। তখন থেকে ব্রিটিশ সরকার শুল্কবিধির সমতার অধীনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে থেকে আমদানিকৃত চিনির শুল্ক ধার্য করার জন্য শুল্কবিধি পরিবর্তন করে। ইউরোপে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিট চিনি উৎপাদনের উন্নয়ন বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চিনি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দেয়।

জাভা, মরিসাস ও ফরমোজায় ইক্ষু ও চিনি উৎপাদনের প্রযুক্তি উন্নয়নের ফলে চিনির আন্তর্জাতিক মূল্য ভারতে উৎপাদিত চিনির উৎপাদন মূল্যের নিচে নেমে আসে। এইসব ঘটনার ফলে বাংলার চিনিশিল্পে ধস নামে। তবে, ইক্ষু, খেজুর এবং তাল বৃক্ষ থেকে গুড় উৎপাদনে বাংলা বেশ ভাল ভূমিকা পালন করে। সস্তা ও পুষ্টিকর খাদ্যের উপকরণ হিসেবে গুড়ের বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। আন্তর্জাতিক চিনির বাজারে সব ধরনের উন্নয়ন সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যাপক চাহিদার জন্য চিনি শিল্প বাংলায় টিকে থাকে।

ব্রিটিশ আমলে বাংলার শিল্পের, বিশেষ করে কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে, একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সীমিত শিল্পখাতে সঙ্কীর্ণ বিশেষায়ণ। বহু শতক ধরে ভারতে প্রচলিত বর্ণভিত্তিক কারুকর্মীদের বিশেষায়ন ব্রিটিশ আমলেও সমৃদ্ধি অর্জন করে। অনেক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এইসব কুটির শিল্পের উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখেন। কিন্তু অন্য অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় কারিগরদের দৈহিক নিপীড়নসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয় এবং জোর করে তাদের ব্যবসা থেকে বিতাড়ন করে আমদানিকৃত দ্রব্যাদির জন্য স্থান করে দেওয়া হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান অবিভক্ত বাংলার শিল্পের সামান্যই উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে। বাংলার ১০৮টি পাটকল, ১৮টি লৌহ ও ইস্পাত কল এবং ১৬টি কাগজ কলের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশে একটিও পড়ে নি। বাংলার ৩৮৯টি সুতাকলের মধ্যে মাত্র ৯০টি, ১৬৬টি চিনিকলের মধ্যে মাত্র ১০টি এবং ১৯টি সিমেন্ট কারখানার মধ্যে মাত্র ৩টি পূর্ব পাকিস্তান ভূখন্ডে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের সিলেটের ছাতকে অবস্থিত সিমেন্ট কারখানাকে চুনাপাথর সরবরাহের জন্য ভারতের আসামের ওপর নির্ভর করতে হতো।

পূর্ব পাকিস্তানের সুতাকলগুলোকেও আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভর করতে হতো। পাট, পেপার বোর্ড, সিমেন্ট, সার, চিনি, রাসায়নিক দ্রব্যাদি, বস্ত্র, ঔষধ, হাল্কা প্রকৌশল ও জাহাজনির্মাণ প্রভৃতি খাতে শিল্প ইউনিট স্থাপনে পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অবশ্য, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে এবং পশ্চিম পাকি¯স্তনের শিল্প উন্নয়নে পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করে। এই উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার করা হয়। তাছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার বহিঃসম্পদের অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের জন্য ব্যয় করে।

বাংলাদেশ আমল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে শিল্পখাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৭২টি পাটকল, ৪৪টি বস্ত্রকল, ১৫টি চিনি কল, ২টি সার কারখানা, একটি ইস্পাত কল, একটি ডিজেল ইঞ্জিন ইউনিট এবং একটি জাহাজনির্মাণ কারখানা নিয়ে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পখাতের কার্যক্রম আরম্ভ হয়। রাষ্ট্রীয় নীতিতে বহু সমন্বয় ও সাময়িক পরিবর্তন আনয়ন করে সরকার অবশেষে ১৯৮২ সালে একটি নতুন শিল্পনীতি প্রণয়ন করে। বাংলাদেশে সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায়ই তাঁতিদের বসতি আছে, কিন্তু নরসিংদী, বাবুরহাট, হোমনা, বাঞ্ছারামপুর, বাজিতপুর, টাঙ্গাইল, শাহাজাদপুর এবং যশোর এলাকায় তাদের অধিক সংখ্যায় কেন্দ্রীভূত রূপে দেখা যায়। রেশম শিল্প রাজশাহী ও ভোলাহাটে প্রসার লাভ করে। বাংলাদেশে ১৯৮০-র দশকে অন্যান্য যে সকল স্থান কুটির শিল্পের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ইসলামপুর (তামা ঢালাই), সিলেট (মাদুর ও বেতের আসবাবপত্র), কুমিল্লা (মৃৎশিল্প ও বাঁশের কাজ), কক্সবাজার (সিগার), বরিশাল (নারিকেলের ছোবড়া থেকে উৎপাদিত দ্রব্য) এবং রংপুর (নকশাযুক্ত কার্পেট)।

বস্ত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত খাতের অন্যতম শিল্প এবং অন্যান্য অধিকাংশ শিল্পখাতের মতোই বস্ত্রখাতকে লোকসানের বোঝা বহন করতে হয়েছে। এই খাতের অসুবিধাসমূহের মধ্যে রয়েছে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টির অসুবিধা, কাঁচামাল ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অপর্যাপ্ততা। বাংলাদেশের পাট শিল্পের প্রধান তিনটি কেন্দ্র ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় অবস্থিত। পাটজাত দ্রব্যের পরিবর্তে এখন সস্তা ও অধিক টেকসই প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহূত হচ্ছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বালু, লবণ ও চুনাপাথর সহজলভ্য হওয়ায় দেশে কাচ শিল্প উন্নয়নের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। এই শিল্প স্থাপনের জন্য দুটি প্রধান স্থান হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম। দেশের সার শিল্পে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়। দেশের প্রধান সিমেন্ট কারখানাদ্বয় ছাতক ও চট্টগ্রামে অবস্থিত। পাবনার পাকশী এবং চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় রয়েছে বাংলাদেশের কাগজ শিল্পের প্রধান কারখানা ম্যাচ উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। দর্শনার চিনিকলে চিনি ছাড়া আরও উৎপন্ন হয় অ্যালকোহল, মেথিলেটেড স্পিরিট এবং রেক্টিফাইড স্পিরিট।

বাংলাদেশের লৌহ ও ইস্পাত মিলগুলোর অধিকাংশই ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের অধীনে চট্টগ্রাম ও ঢাকাতে কেন্দ্রীভূত। অবশ্য খুলনা, কুষ্টিয়া ও বগুড়াতেও কিছু ইস্পাত ও লোহার কাজের প্রতিষ্ঠান আছে। ১৯৮০-র দশকে বাংলাদেশে জাহাজনির্মাণ শিল্প, মোটরগাড়ি সন্নিবেশ শিল্প, তৈল, শোধনাগার, ইনসুলেটর ও চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরির কারখানা, টেলিফোন যন্ত্রপাতি তৈরির শিল্প, বৈদ্যুতিক দ্রব্যাদি তৈরির কারখানা, টেলিভিশন সন্নিবেশ কারখানা, সিগারেট কোম্পানি এবং উদ্ভিজ্জ তেল কল বিশেষ স্থান অধিকার করে। এই সময় দেশে তৈরি পোশাক শিল্প ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করে।


লেখকঃ সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন