রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শ্রমিকদের প্রতি নজর দেয়া দরকার

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকের মজুরি বিশ্বের মধ্যে নিম্ন। মজুরির এ অবস্থা শুধু গার্মেন্ট খাতেই নয়, সব খাতেরই শ্রমিকের মজুরী বৈশ্বিক বিচারে অনেক কম। এছাড়া, বেসরকারি খাতের বেশিরভাগ শ্রমিক নিয়মিত মজুরীও পায়না।তাই বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করতে হয়। গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকরা প্রায়ই বকেয়া বেতন ও বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করে, যার অন্যতম সড়ক অবরোধ, ধর্মঘট ইত্যাদি। অন্য খাতেও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন হতে দেখা যায়। চা শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে এক মাস ধর্মঘট করে গত আগস্টে। এ প্রেক্ষিতে তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ থেকে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করা হয়। কিন্তু বর্ধিত টাকা আদায় না হওয়ায় শ্রীমঙ্গলের চা শ্রমিকরা সম্প্রতি ১৯ মাসের বকেয়া মজুরি পরিশোধসহ বিভিন্ন দাবিতে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিয়েছে। এর মধ্যে দাবি পূরণ না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছে শ্রমিকরা। নৌযান শ্রমিকরা দুদিন ধর্মঘট করার পর গত ২৮ নভেম্বর শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মালিক-শ্রমিকের সভায় নৌযানের আকার ভেদে শ্রমিকদের মজুরি অন্তর্বর্তীকালের জন্য বিশেষ ভাতা হিসাবে ১২০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা বৃদ্ধি এবং নৌযান শ্রমিকদের মজুরি স্কেল নতুন করে নির্ধারণের সুপারিশ করতে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা কমিটিকে নির্দেশনা দেওয়ায় নৌ ধর্মঘট প্রত্যাহার করে শ্রমিকরা। এরূপ অনেক কর্মস্থলে শ্রমিকরা বকেয়া বেতন পরিশোধ ও বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করছে।

বিভিন্ন তথ্য মতে, দেশে নিম্নতম মজুরি বোর্ড রয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের প্রেক্ষিতে এই বোর্ড নিম্নতম মজুরী নির্ধারণ করে শ্রমিক ও মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা করে। শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী, শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিম্নতম মজুরি পুনর্বিবেচনা করার বিধান রয়েছে। দেশে ৬.৩৫ কোটি শ্রমিক রয়েছে, যারা বিভিন্ন খাতে কর্মরত। তন্মধ্যে ৮৫% অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। সরকার নির্ধারিত খাত ৪২টি।যার অন্যতম হচ্ছে: গার্মেন্ট, রাবার, পাটকল, বিড়ি, ম্যাচ, জুট প্রেস, সিনেমা হল, হোসিয়ারি, কোল্ড স্টোরেজ, পেট্রোল পা¤প, আয়ুর্বেদিক কারখানা, ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, লবণ, হোটেল, চা ইত্যাদি। কিন্তু প্রতি পাঁচ বছর পরপর মজুরি পুর্নমূল্যায়ন করার নিয়ম থাকলেও শুধু গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির মেয়াদ ৫ বছর চলছে। বাকীগুলোর মেয়াদ এক যুগের অধিক হয়েছে। এছাড়া, জাতীয় নিম্নতম মজুরী না থাকায় একটি খাত থেকে আরেকটি খাতের মজুরির ব্যবধান অনেক। কোনও কোনও খাতের মজুরি মাত্র তিন হাজার টাকা, আবার কোনও কোনও খাতের মজুরি ১৬ হাজার টাকার বেশি। অন্যদিকে, দেশে শ্রমিক খাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে কৃষি শ্রমিকরা। কিন্তু তাদের কোন নিম্নতম মজুরী নির্ধারণ করা নেই। চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে মজুরী নির্ধারিত হয়। একই অবস্থা গৃহ পরিচারিকাদেরও। এমনকি তাদের কাজের স্বীকৃতিও নেই। দেশে শিল্প দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। তাতে নিহত-আহত হচ্ছে অনেক। এর ক্ষতিপূরণ পায় না শ্রমিকরা। কোন নিয়মও নেই। তাই দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের জন্য রাজনৈতিক দাবি উঠেছে। এছাড়া, বেসরকারি খাতের শ্রমিকের বোনাস, অবসরোত্তার সুবিধার ব্যবস্থা নেই। এমনকি কারখানা বন্ধ হলে অনেকেই বকেয়া পাওনাও পায়না। সর্বোপরি বেশিরভাগ কল-কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারও নেই। যেখানে আছে, তা নামকাওয়াস্তে। মালিকের আজ্ঞাবাহরা নেতা হয়, যা দিয়ে শ্রমিকের কোন কল্যাণ হয় না। সর্বোপরি কোথাও কোথাও আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর হামলা, মামলা, চাকুরিচ্যুতি ইত্যাদিও হয়। দেশের বেসরকারি খাতের শ্রমিকের ক্ষেত্রে আইনের কোন বালাই নেই! ফলে শ্রমিকরা শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। তাদের জীবনমানের কোন উন্নতি হচ্ছে না। ইদানিং পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকের সংসার চলছে না। ধার দেনা ও স¤পদ বিক্রি করে খেয়ে ও না খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে। তাই তাদের অধিকাংশ অপুষ্টির শিকার। নারী শ্রমিকরা রক্তস্বল্পতায় ভুগছে! গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইম্প্রুভড নিউট্রিশনের গবেষণা রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশের প্রতি ১০ নারী শ্রমিকের আটজনই ভোগেন রক্তস্বল্পতায়। দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখের অধিক! তন্মধ্যে বিরাট অংশ চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির প্রাণ হওয়া সত্ত্বেও প্রবাসীদের দেখভাল করার মতো কেউ নেই। তাই বিদেশে মারা গেলে তার লাশও আসতে বহুদিন লাগে!

দেশের উন্নতির ব্যারামিটার ক্রমশ: উপরে উঠছে। সম্প্রতি প্রকাশিত কানাডাস্থ ভিজুয়াল ক্যাপিটালিস্টের মতে, ২০২২ সালে জিডিপির দিক থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম, মোট আকার ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন, যা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার চেয়ে বেশি। সে হিসাবে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার শ্রমিকদের কাজ করার জন্য বাংলাদেশে আসার কথা। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে তার উল্টেটা। বাংলাদেশের মানুষ দলে দলে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া যাচ্ছে শ্রম দেওয়ার জন্য। কারণ, সেখানে মজুরী ও সুবিধাদি অনেক বেশি বাংলাদেশের থেকে। অথচ বাংলাদেশের মালিকরা এক শিল্প থেকে একাধিক বা বহু শিল্প এবং দেশ-বিদেশে একাধিক আলিসান বাড়ী বানিয়েছে। অনেকের পরিবারের সদস্যরা বিদেশে থাকছে শান সৈকতে।এসব অর্জিত হয়েছে শ্রমিকের ঘাম ও রক্ত ভেজা শ্রমের মুনাফা থেকেই। অথচ তার বিন্দুমাত্র ভাগ পাচ্ছে না তারা।ফলে দেশে আয় বৈষম্য বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ দেশের মহান গৌরবোজ্জল ইতিহাসের পরতে পরতে অবদান বেশি কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদ গত ২ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে দ্রুত মজুরি বোর্ড গঠন করে মাসিক ২২ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি (যার মূল বেতন ৬৫%) নির্ধারণের দাবি জানিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছে। এর মধ্যে তাদের দাবি মানা না হলে আন্দোলন শুরু করবে বলে সরকার ও বিজিএমইএকে জানিয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নান গত ২ নভেম্বর বলেছেন, দেশে মূল্যস্ফীতি যেভাবে বেড়েছে বেতন-ভাতা সেভাবে বাড়েনি।বিলসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ২০২ ডলার বা ২১,৪১৫ টাকার প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। আইএলও’র ২০২১ সালে বলেছে, বাংলাদেশের শ্রমিকের শোভন মজুরী হওয়া উচিৎ মাসিক ২৫২ মার্কিন ডলার।গত ১৭ ডিসেম্বর সিপিডি বলেছে,বর্তমানে ঢাকা শহরে চার সদস্যের একটি পরিবারের স্বাভাবিক পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে মাসে ২৩,৬৭৬ টাকা প্রয়োজন। বিএনপি ঘোষিত ১০ দফা দাবীর একটি হচ্ছে, শ্রমিকদের প্রাইস-ইনডেক্স বেজড ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা ও শিশুশ্রম বন্ধ করা। বিএনপি উক্ত দাবীকে দেশের বেশিরভাগ দল ও মানুষ সমর্থন করেছে। তাই শ্রমিকের বেতন বাড়ানোর ব্যাপারে জাতীয় ঐক্যমত্য দরকার।

বিলস একটি নিরপেক্ষ শ্রম বিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। যার প্রতিষ্ঠার পর থেকে সভাপতি হয়ে আসছেন শ্রমিক লীগের প্রাক্তন ও বর্তমান সভাপতি। অর্থাৎ বিলসের সাথে আওয়ামী লীগের লোকরাও সংশ্লিষ্ট। ফলে সংগঠনটি নিম্নতম মজুরীর যে প্রস্তাব তৈরি করেছে তা কোন ষড়যন্ত্র নয়, ন্যায্য। উপরন্তু সেটাকেই জাতীয় নিম্নতম মজুরী নির্ধারণ করে শ্রমিকসংশ্লিষ্ট নিয়মিত বেতন পরিশোধের ব্যবস্থা করা দরকার । এছাড়া, শ্রম আইন অনুযায়ী সব সুবিধা, স্বল্প মূল্যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু এবং সর্বজনীন পেনশন প্রবর্তন করা দরকার। সর্বোপরি শিল্প দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণের বিধান করা প্রয়োজন। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা জনিত ক্ষতিপূরণের বিধান করা হয়েছে। অনুরূপ বিধান শিল্প দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও করা প্রয়োজন। দেশে বেকারত্ব বেড়েছে এবং দেশ বিদেশী পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে, তাই দেশের সব বন্ধ কল-কারখানা দ্রুত পুন:চালু করার ব্যবস্থা করা দরকার। সর্বোপরি শিশু শ্রম বন্ধ করা জরুরি। বর্তমান জাতীয় পে-স্কেল প্রদান করা হয়েছে ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে। ৫ বছর পর পর জাতীয় পে-স্কেল দেওয়ার নিয়ম থাকলেও এ ক্ষেত্রে ৭ বছরের বেশি হয়েছে। তাই নতুন জাতীয় পে-স্কেল প্রদান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পে-স্কেলের দাবিতে অনেক কর্মচারী ইউনিয়ন দাবি করছে। আন্দোলন করারও হুমকি দিয়েছে। বিষয়টি জাতীয় সংসদেও আলোচিত হয়েছে।

পণ্যমূল্য ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে সম্প্রতি তুরস্কসহ বহু দেশে শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন বাড়ানো হয়েছে। তবুও বিজিএমইএ’র নেতৃবৃন্দ বলেছেন, যদি অনেক বেশি বেতনের চাপ দেয়া হয় তাহলে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এই বক্তব্য সর্বাংশে সঠিক নয়। কারণ, শ্রমিকের মজুরি বেশি হলেই যদি কারখানা বন্ধ হয়, তাহলে দেশে নৌ শ্রমিকের মজুরি বাড়ানোর পর নৌযান বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। মনে রাখতে হবে, শ্রমিকরা আর্থিকভাবে যত ভাল থাকে, মালিক-শ্রমিক স¤পর্ক তত ভাল থাকে। উৎপাদনশীলতাও বাড়ে।

লেখক:সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
sardarsiraj1955@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন