গাইড বই ও প্রাইভেট কোচিংকে বৈধতা দিয়ে শিক্ষা নীতি ২০১৬-এর বিল চূড়ান্ত করেছে সরকার। শিঘ্রই এ বিল অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় প্রেরণ করা হবে। সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে শিক্ষাবিদরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, এর ফলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা যেমন ব্যাহত হবে, তেমনি শিক্ষা ‘পণ্যে’ পরিণত হবে। শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টার ও গাইড বইয়ের উপর নির্ভরশীল করে তোলার পাশাপাশি অভিভাবকদের শিক্ষার পেছনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে। শুধু তাই নয়, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদানের বিষয়টি দারুণভাবে ব্যাহত হবে। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে কিছুদিন আগে বলা হয়েছিল, শিক্ষানীতিতে গাইড বই ও কোচিং-এর বিষয়টি তুলে দেয়া হবে। শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করার পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার সাথে কথা বলে এ নীতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রয়োজনে আবারও সবার সাথে আলাপ করা হবে। আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীদের মেধা ধ্বংসকারী গাইড বই এবং কোচিং সেন্টার শিক্ষানীতিতে কোনোভাবেই সংযোজন করা উচিত হবে না। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের বিষয়টি বাদ দেয়া জরুরি।
দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষা ক্ষেত্রে গাইড বই ও কোচিং সেন্টার-এর প্রচলন রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এই দুটো বিষয় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা লাভ ও জ্ঞান আহরণের অন্তরায় হয়ে রয়েছে। তারা নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে না লাগিয়ে গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের ছককৃত পড়াশোনায় আবদ্ধ হয়ে থাকছে। তাদের মেধা নির্দিষ্ট গ-িতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, মুখস্থ এ বিদ্যা অর্জন করতে গিয়ে অভিভাবকদেরও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এ কথা বারবার বলা হয়েছে, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা যদি পাঠ্যপুস্তক অনুযায়ী বিশ্লেষণ ও বোঝানোর মাধ্যমে যথাযথভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠ দান করতেন, তবে শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে গাইড বই পড়া ও কোচিং করার কোনো প্রয়োজন হতো না। পড়া বোঝার জন্য শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হতে অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠত। দুঃখের বিষয়, একশ্রেণীর শিক্ষক এ কাজটি সঠিকভাবে করছেন না। তারা শ্রেণীকক্ষে নামমাত্র উপস্থিত হয়ে সঠিক পাঠদানের পরিবর্তে তাদের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য প্রচ্ছন্নভাবে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিয়ে থাকেন। তাদের এমন ধারণা দেয়া হয়, আলাদাভাবে ব্যাচে পড়লে স্কুলের পরীক্ষার পাশাপাশি চূড়ান্ত পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করা যাবে। স্বাভাবিকভাবে শিক্ষকের সুদৃষ্টি পাওয়ার আশায় শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট কোচিংয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে। কোনো কোনো স্কুলের শিক্ষকরা তো শিক্ষার্থীদের এমন ধারণা দিয়ে থাকেন, তাদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে ভাল ফলাফল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এসব শিক্ষকরা নিজেদের কাছে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে তো উৎসাহী করে তোলেনই, তার উপর নির্দিষ্ট প্রকাশনীর গাইড বই অনুসরণ করার কথাও বলেন। এর ফলে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং ও গাইড বই অনুসরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নিজস্ব বোধবুদ্ধি ও মননের চর্চা বলতে কিছু হয় না। তাদের জ্ঞান নির্দিষ্ট ছক ও মুখস্থ বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাক্ষেত্রের এই অনাচার দূর করার জন্য আইন করে গাইড বই ও কোচিং নিষিদ্ধ করার দাবী শিক্ষাবিদরা সরকারের কাছে করে আসছেন। সরকার বিষয়টি আমলেও নেয়। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা। একবার বলে গাইড বই ও কোচিং নিষিদ্ধ করা হবে, আরেকবার বলে করা হবে না। শেষ পর্যন্ত যে নীতিটি করা হয়েছে, তাতে গাইড বই ও কোচিং প্রকারান্তরে বৈধ করা হয়েছে। বিলের ১৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রকাশক অথবা যে কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষা সহায়ক উপকরণ অথবা ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রকাশ করতে পারবে। তবে কোনো ধরনের নোটবুক বা গাইডবুক প্রকাশ করতে পারবে না। এ ধারাকে শিক্ষাবিদরা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সাথে তুলনা করেছেন। তারা বলেছেন, শিক্ষা সহায়ক যে কোনো উপকরণ প্রকাশ গাইড ও নোটবুক প্রকাশের নামান্তর। ধারায় কথাটি সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে বলা হয়েছে। কে না জানে গাইড ও নোট বই মানেই সহায়ক বই। ২৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষার মান উন্নয়নে শ্যাডো এডুকেশন বা ছায়াশিক্ষা করা যেতে পারে, যার মধ্যে প্রাইভেট টিউশন থাকবে। এর অর্থ ক্লাসের বাইরে যে কোনো স্থানে এই ‘শ্যাডো এডুকেশন’ দেয়া যাবে। তবে সরকারি বা বেসরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না। অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ব্যতিরেকে শ্যাডো এডুকেশনের নামে প্রাইভেট পড়া যাবে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, ‘শিক্ষা সহায়ক উপকরণ’ এবং ‘শ্যাডো এডুকেশন’ শব্দগুলো টেকনিক্যালি ব্যবহার করে মূলত গাইড বই এবং কোচিংকে প্রচ্ছন্নভাবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ভাষার এদিক-সেদিক ব্যবহার বা প্রতিশব্দ ব্যবহার করে এ ধরনের বৈধতা দেয়া কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার ও শিক্ষামন্ত্রীর আন্তরিক উদ্যোগের অভাব নেই। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশে ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এটা খুবই ভাল এবং মেধা উন্নয়নে সহায়ক। এই মেধা উন্নয়নে যদি শিক্ষার্থীদের গাইড বই ও কোচিংয়ের উপরই নির্ভর করতে হয়, তবে সৃজনশীল পদ্ধতি তো কোনো কাজে আসবে না। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটবে না। তাদের সেই আগের মতোই গাইড বই ও কোচিং পদ্ধতির মুখস্থ বিদ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যেতে হবে। অভিভাবকদের কোচিং সেন্টারের খরচ মেটাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠবে। শিক্ষা পণ্যে পরিণত হবে। আমরা মনে করি, সরকারকে শ্রেণীকক্ষে যথাযথ পাঠদানের নিশ্চয়তা বিধানে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতোমধ্যে সরকার শিক্ষকদের বেতন অনেক বৃদ্ধি করেছে। ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি করা হবে। এসব করা হচ্ছে, শ্রেণীকক্ষে যথাযথ পাঠদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। কাজেই আলাদাভাবে প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ কোনোভাবেই রাখা উচিত নয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এতদিন গাইড বই ও কোচিংয়ের বিষয়টি অনেকটা অনৈতিকতার বাতাবরণের মধ্যে ছিল। এখন আইন করে তা বৈধতা দেয়া হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা মনে করি, আইনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অথবা শব্দের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে কোনোভাবেই গাইড বই ও কোচিংকে উৎসাহী করার মতো কোনো বিধান রাখা যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন