বাংলাদেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাই ইসরাইলেরও বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তার পরেও দেখা যাচ্ছে, ইসরাইল ঠারে ঠুরে বা চিপাচাপা দিয়ে বাংলাদেশের কোনো না কোনো কোণায় ঢোকার অপচেষ্টা করছে। বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারে না, যে দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই, ইসরাইল থেকে বাংলাদেশের কোনো স্পর্শকাতর যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ ক্রয় করার সংবাদ বের হয় কেমন করে? গত ১১ জানুয়ারি ইংরেজি ডেইলি স্টারে এমনি একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। রিপোর্টটির শিরোনাম ছিল, Haaretz reports Dhaka bought spy tech from Israeli supplier. অর্থাৎ, হারেটজ রিপোর্ট করছে যে, ঢাকা ইসরাইলি সাপ্লায়ারের নিকট থেকে গোয়েন্দা যন্ত্রাংশ কিনেছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, হারেটজ হলো ইসরাইলের একটি দৈনিক পত্রিকা। অনেকে বলেন যে, ইসরাইলে এই পত্রিকাটি নাকি সবচেয়ে বেশি চলে। আলোচ্য রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জাতীয় টেলিযোগাযোগ মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) জন্য বাংলাদেশ ইসরাইলি সাপ্লায়ারদের নিকট থেকে গাড়ির ওপর সজ্জিত নজরদারি যন্ত্রপাতি কিনেছে। হারেটজে বলা হয়েছে যে, এই যন্ত্রের নাম ‘স্পেয়ার হেড সিস্টেম’। ‘প্যাসিটোরা’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে এই গোয়েন্দা যন্ত্র কেনা হয়েছে। সচেতন মানুষের চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য প্যাসিটোরার নিবন্ধন করা হয়েছে সাইপ্রাসে। কিন্তু এ ব্যাপারে ‘ওপেন কর্পোরেট’ নামক একটি সংস্থা গভীর অনুন্ধান করে দেখেছে যে, প্যাসিটোরার আগের নাম ছিল ‘উইস্পেয়ার’। এই উইস্পেয়ার আসলে একটি ইহুদী বা ইসরাইলি সংস্থা। প্যাসিটোরা নামক সংস্থাটি এখনো চালায় একজন অবসরপ্রাপ্ত ইহুদী সামরিক অফিসার। তার নাম তাল জনাথন ডিলন। এই ডিলন ইসরাইলি সামরিক বাহিনীতে ২৫ বছর চাকরি করেছেন। ইহুদী সামরিক বাহিনীতে ডিলন ছিল টেকনোলজিক্যাল ইউনিটের প্রধান।
হারেটজের ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, গাড়িতে গোয়েন্দা নজরদারির যন্ত্র সজ্জিত থাকবে। আর থাকবে সফটওয়্যার ট্র্যাক করার ডিভাইস। এই ডিভাইস মোবাইল ট্র্যাক করবে। আর মোবাইল ট্র্যাকিং করতে গিয়ে তারা ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের ভেতর ঢুকে যেতে পারবে। তারা হোয়াটস অ্যাপ ম্যাসেজ, ফেসবুক চ্যাট, কন্টাক্ট লিস্ট, কল লিস্ট এবং ম্যাসেজ লিস্টও ডিসাইফার করতে পারবে। অর্থাৎ মোবাইল ফোনের ঐসব অ্যাপে যা কিছু রক্ষিত আছে সেগুলো তারা পড়ে উদ্ধার করতে পারবে। এই গোয়েন্দা নজরদারির ডিভাইস অর্ধ কিলোমিটার রেঞ্জ কাভার করতে পারবে। এই ডিভাইস কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোনের মধ্যে স্পাইওয়্যার অর্থাৎ মারাত্মক ভাইরাস ঢুকাতে পারবে। গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি সজ্জিত এই গাড়িটি ৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যে কেনা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন এক ডলারের বিনিময় মূল্য ১০৫ টাকা এবং অনেক ক্ষেত্রেই তার বেশি। এনটিএমসির প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান ডকুমেন্ট থেকে জানা যায় যে, গাড়িতে সজ্জিত তথ্য সংগ্রহের জন্য আড়িপাতার যন্ত্রও কেনা হয়েছে। এর মূল্য ১৯১ কোটি টাকা। যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশের পুরা সেট ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা। এনটিএমসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন।
ডেইলি স্টার এ ব্যাপারে এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল হকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন বলে ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্টে বলা হয়। এ সম্পর্কে রিপোর্টে আরো বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আমরা অত ডিটেইলসে যাচ্ছি না। তবে এই রিপোর্টটি শুধুমাত্র ডেইলি স্টারেই প্রকাশিত হয়নি। একই দিন একই রিপোর্ট ইংরেজি ‘দৈনিক নিউ এজ’ এবং ‘ঢাকা ট্রিবিউনে’ও প্রকাশিত হয়েছে। নিউ এজের রিপোর্টে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তারও বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা ট্রিবিউন, নিউ এজ এবং হারেটজের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০১৯ সাল থেকে এসব আড়িপাতার যন্ত্র কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। গাড়ি এবং যন্ত্রপাতিসহ মোট ক্রয় মূল্য ১২ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২৫ কোটি টাকারও বেশি।
॥দুই॥
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জাতীয় সংসদে বলেছেন যে, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে আইন সম্মতভাবে আড়িপাতার ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইএলআইএস) অর্থাৎ আইন সম্মতভাবে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটে আড়িপাতার ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মন্ত্রী আরো বলেন, ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিংয়ে দেশ ও সরকারবিরোধী কার্যক্রম বন্ধের জন্য এনটিএমসিতে (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সিস্টেম) ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আড়িপাতার যন্ত্র স্থাপনের কথা স্বীকার করেছেন। তবে ঐ যন্ত্র বা সিস্টেম কোন দেশ থেকে কেনা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। তবে ইসরাইল থেকে গোয়েন্দা নজরদারির এই ডিভাইস ক্রয় সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবৃতি মোতাবেক, টিআইবি বলেছে, জনগণের করের টাকায় এমন ভয়ঙ্কর হাতিয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতি অনুযায়ী কেনা হলো, কী উদ্দেশ্যে কেনা হলো, কোন প্রেক্ষিতে কেনা হলো, কার স্বার্থে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, এই ধরনের অনেক মৌলিক প্রশ্নের জবাব জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। টিআইবির ঐ বিবৃতিতে আরো বলা হয়, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অনুপস্থিতিতে এমন প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যক্তিগত তথ্যের ও যোগাযোগের গোপনীয়তা, সুরক্ষা এবং বাক ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ একাধিক সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার খর্ব হওয়ার ব্যাপক ঝুঁকি রয়েছে। টিআইবির ঐ রিপোর্টে বিক্রয়কারী সংস্থাটিকে ‘কুখ্যাত’ বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে, গত জুন মাসে নাকি সমস্ত যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে পৌঁছেছে।
টিআইবির পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ইসরাইল থেকে সরাসরি কিছু কেনা হয়নি, সরকার এমন ব্যাখ্যা দিয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, ইসরাইল থেকে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে কেনা হয়নি। টিআইবির পূর্ণ বিবৃতি পড়তে হলে দেখুন দৈনিক ইনকিলাব, ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, প্রথম পৃষ্ঠা। ইনকিলাবের ঐ সংবাদটির শিরোনাম, ‘ইসরাইলী নজরদারি প্রযুক্তি সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের ভয়ঙ্কর হাতিয়ার’।
এই আড়িপাতার ব্যবস্থা চালুর তীব্র সমালোচনা করেছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। শুক্রবার দৈনিক মানবজমিনের অনলাইন সংস্করণে দলটির যে বিবৃতি ছাপা হয়েছে তার শিরোনাম, ‘আড়িপাতার ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সাইবার অপরাধের শামিল: বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।’ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আইন সম্মতভাবে আড়িপাতার ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সাইবার অপরাধের শামিল। দলটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আধুনিক কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ রাষ্ট্রকে যথেচ্ছভাবে তার নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনকে আইনসম্মত করতে পারে না। তার মতে, আড়িপাতার বিদ্যমান তৎপরতার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা। সাইফুল হক আরো বলেন, বিপুল অর্থ ব্যয় করে ইসরাইলি প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকার বহু আগে থেকে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে আইনবহির্ভূতভাবে আড়িপেতে আসছে। এখন সেটিকে তারা আইনি কাঠামোয় নিয়ে আসতে উদ্যোগী হয়েছে। রাষ্ট্রবিরোধিতা আর সরকারবিরোধিতা এক জিনিস নয়। সরকারবিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতা আখ্যায়িত করে সরকার এখন বিরোধী মত, চিন্তা ও তৎপরতাকে দমন করতে যেকোনো জায়গায় যেকোনো ব্যক্তির ওপর আড়িপাতাকে বিধিসম্মত করতে চায়। সরকারের এই নিবর্তনমূলক তৎপরতা দেশের জনগণের সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার পরিপন্থী।
॥তিন॥
এই লেখাটি যেদিন ছাপা হবে সেদিন অর্থাৎ ১৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার এসম্পর্কে হয়তো আরো প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমে পাওয়া যাবে। এখানে একটি বিষয় ভাবার আছে। সেটি হলো, যে দেশটির সাথে আইন সংগত কোনো লেনদেন নাই, সেই দেশটির নাম মাঝে মাঝে কেন বাংলাদেশে আসছে? দেখা যাচ্ছে যে, সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানই শুধু নয়, একাধিকবার একাধিক ব্যক্তির নামও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে জড়িত হচ্ছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব এবং ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের নাম। বাংলাদেশরই একটি বাংলা দৈনিকে বলা হয়েছে যে, নুরুল হক নূর পবিত্র ওমরাহ করার আড়ালে গত ২৮ ডিসেম্বর দুবাইয়ে ইসরাইলের গোয়েন্দা মেন্দি এন সাফাদির সাথে বৈঠক করেছেন। তাদের দুই জনের দন্ডায়মান একটি ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গণ অধিকার পরিষদের তরফ থেকে সরাসরি বলা হয়েছে যে, নূরের সাথে ইসরাইলের কোনো ব্যক্তির দেখা হয়নি। যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, সেটি ফটোশপে এডিট করা হয়েছে। কোথায় দেখা হলো, কীভাবে দেখা হলো, সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নাই। আসলে গণ অধিকার পরিষদের প্রেসিডেন্ট অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়া বলেন যে, তার দল যেহেতু সরকার পতন আন্দোলনে শামিল হয়েছে তাই সরকারি ষড়যন্ত্রে নুরুল হক নূরের বিরুদ্ধে এই বিকৃত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
একই ধরনের সংবাদ চোখে পড়েছিল ২০১৬ সালে। তখন যার নাম জড়িত হয়েছিল তিনি হলেন বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী। এই অভিযোগে আসলাম চৌধুরীকে কিছুদিনের জন্য জেলও খাটতে হয়েছিল। কিন্তু তারপর ৬ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল সে সম্পর্কে আর কোনো খবর নাই কেন? বিদেশি গোয়েন্দাদের সাথে কোনো বাংলাদেশির বৈঠকের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। এই ধরনের অভিযোগ উত্থাপনের পূর্বে দালিলিক প্রমাণসহ অভিযোগ উত্থাপন করতে হবে। যেমন রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ। সরকার বিরোধিতা আর রাষ্ট্র বিরোধিতা এক জিনিস নয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই দুইটি বিষয়কে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। ফলে এমন সিরিয়াস একটি বিষয় বিদগ্ধজনের কাছে হালকা হয়ে যাচ্ছে।
আমার বক্তব্য হলো, ইসরাইল, ভারত, পাকিস্তান, যে রাষ্ট্রই হোক না কেন, আমাদের প্রথম আনুগত্য থাকতে হবে বাংলাদেশে। এমন অনেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তোলা হয় যাদের বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। বিদেশের কোনো ব্যাংকে তাদের একটি পয়সাও নাই। তারা এই দেশেই জন্ম নিয়েছেন, আবার এই দেশেই তাদের মৃত্যু হবে। তাদের বাপ দাদাদের কবর রয়েছে এই দেশে। তারাও শায়িত হবেন ঐসব কবরের পাশে। বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভেকেট জেড আই পান্না এই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ নিয়ে একাধিক লেখা লিখেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপনের পূর্বে জেড আই পান্নার রচনাগুলি সংশ্লিষ্টদের পড়া প্রয়োজন।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন