পুরান ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এ জন্য পুরান ঢাকার বংশাল, চকবাজার, ইসলামবাগ, মৌলভীবাজার, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও হাজারীবাগ এলাকার পুনরুন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক সহযোগিতা দেবে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। নগর পুনরুন্নয়নের জন্য পুরান ঢাকার যে ৭টি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে এর মধ্যে বংশাল অন্যতম। প্রায় ১২.৭১ একর আয়তনের বংশালে আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবনসহ প্রায় ৫০০ অবকাঠামো রয়েছে। এ এলাকার ভবনগুলো ইমারত নির্মাণের বিধান মেনে নির্মিত হয়নি। রাস্তাগুলো সংকীর্ণ। তাই বংশালে বসবাসকারীরা খুব কমই প্রাকৃতিক আলো-বাতাস পান। সরু রাস্তা থাকায় জরুরি ও দুর্যোগের সময় ভোগান্তি তৈরি হয়।
রাজধানীর বয়স ৪০০ বছর হলেও জনবসতি হিসেবে ঢাকার বয়স ৮০০ বছরেরও বেশি। পৃথিবীর অন্যসব সমৃদ্ধ নগরীর মতোই ঢাকাও গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। নৌপথের জৌলুসের দিনে ১৬১০ সালে ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন সুবেদার ইসলাম খান। এরপর বিভিন্ন বণিক সম্প্রদায় ঢাকায় এসে বসতি গড়েছেন বাণিজ্যিক কারণে। আরো বেশ কয়েকটি নদীর সংযুক্তি ছাড়াও ঢাকায় শতাধিক খালের উপস্থিতির তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গাসহ ৬টি নদী দখল-দূষণে বিপর্যস্ত অবস্থায় টিকে থাকলেও বেশির ভাগ খাল হারিয়ে গিয়েছে।
অগ্নি দুর্ঘটনার পাশাপাশি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে পুরান ঢাকার জনবহুল ৪৪টি এলাকা। যেখানে রয়েছে রাসায়নিক দাহ্য ও বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্যের সাড়ে ৩ হাজার গুদাম, কারখানা কিংবা দোকান। ফায়ার সার্ভিস ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মুনাফালোভী অসচেতন ব্যবসায়ীদের কারণে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিতে ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকা।
২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলী ও ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা। নিমতলিতে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয় ১২৪ তাজা প্রাণ, আর চুড়িহাট্টায় ৭১। দুবারই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরান ঢাকা থেকে দাহ্য রাসায়নিকের ব্যবসা স্থানান্তর করা হবে। তবে এখনো দাহ্য কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্ত হয়নি পুরান ঢাকা।
আশ্বাসের পর আশ্বাস, উদ্যোগ, মিটিং, অভিযান সবই চলছে; কিন্তু পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরেনি। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় মর্মান্তিক অগ্নিকা-ের চার বছর হতে চলল। অনেকের মনেই হয়তো দুঃসহ সেই স্মৃতি এখন ধূসর। কিন্তু যারা স্বজন হারিয়েছেন? তারা আজও কাঁদছেন। প্রিয় মানুষের এমন মৃত্যু তাদের কান্না থামবে না কোনোদিন। চকবাজার মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ার পর কী হয়েছিল? সরকারের উচ্চপর্যায়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অল্প সময়ের মধ্যেই পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে ঝুঁঁকিপূর্ণ ও দাহ্য রাসায়নিকের দোকান, কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়া হবে। ঘোষণার পর তৎপরতাও শুরু হয়েছিল। এরপর যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।
পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে; যার বেশির ভাগই প্লাস্টিকের ওয়ার্কশপ বা প্লাস্টিক শিল্প। প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ, পলিথিন ও অন্যান্য পণ্য তৈরি হয়। আর এ এলাকার বেশির ভাগ রাস্তা সরু থাকায় সবসময় যানজটে আটকে থাকতে হয় বাসিন্দাদের। ফুটপাত না থাকায় পথচারীরা রাস্তায় ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করেন। পুন:উন্নয়নের মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। পুরান ঢাকার ৭টি এলাকার মধ্য মৌলভীবাজার সবচেয়ে ছোট। এ এলাকার ভিতরে দুটি ভিন্ন বাজার রয়েছে। মৌলভীবাজার বিভিন্ন ধরনের মসলার জন্য প্রসিদ্ধ। পুনরুন্নয়ন আর্থিক সুবিধা, নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করবে এবং পথচারী চলাচলে সুবিধা দেবে। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের বাণিজ্যিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করবে। অন্যদিকে, লালবাগের আয়তন ৩৩ একর। সেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় ১ হাজার ১০০ অবকাঠামো রয়েছে। এ এলাকাটিতে মিশ্রশিল্প ও আবাসিক ব্যবহার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে পরিবহন যাতায়াতের অনুপযোগী। এলাকাটি বসবাস উপযোগী করতে হলে অবশ্যই পুনরুন্নয়ন করতে হবে। এ ছাড়া কামরাঙ্গীর চরের আয়তন প্রায় ৩৩.৬৩ একর। যার মধ্যে কাঠামো সংখ্যা ১ হাজার ৫০০। এলাকাটির বেশির ভাগ কাঠামোই মিশ্র ব্যবহারের। এ এলাকার অনেক ভবনের নিচতলা মুদি ও দর্জির দোকান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেহেতু এলাকাটি অন্য এলাকার তুলনায় দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, তাই সংস্কার জরুরি। হাজারীবাগের আয়তন ১৯১.০৩ একর। এটি মূলত ট্যানারি শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন সেগুলো নেই। বর্তমানে মোট জমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অব্যবহৃত বা খালি অবস্থায় রয়েছে। শহরের মধ্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পুনরুন্নয়নের ক্ষেত্রে হাজারীবাগ একটি সম্ভাবনাময় এলকা। তাই সবুজ মনোরম পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে এ এলাকার সংস্কার করা যেতে পারে।
নগর পুনরুন্নয়নের মাধ্যমে মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করে সুন্দর আবাসিক এলাকা নির্মাণের মাধ্যমে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য আবারও পুনরুজ্জীবিত করা জরুরি। প্রকল্পের অধীনে পুনরুন্নয়নের ফলে ১.৪৬ একরের চকবাজারের পাইকারি ব্যবসা কেন্দ্র নতুন রূপ ধারণ করবে। এ এলাকায় বর্তমানে ১ হাজার ১০০টি দোকান রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে এখানে ব্যবসা চালাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পুরান ঢাকার ইসলামবাগ ১৪.১৪ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। এ এলাকায় যেমন বিপুলসংখ্যক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তেমনি রয়েছে নিম্নআয়ের লোকজনের বসবাস। পুনরুন্নয়নের মাধ্যমে এই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে বসবাস উপযোগী করে তুলতে হবে।
মৌলভীবাজার, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও হাজারীবাগ এলাকা পুনরুন্নয়ন করা হলে ফিরে পাবে নতুন চেহারা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে এআইআইবি। এর মধ্যে ৩ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে অনুদান হিসেবে। পুরান ঢাকার পুনরুন্নয়ন সম্পন্ন হলে পাল্টে যাবে পুরো এলাকার চিত্র। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিতির অবসান ঘটবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন