বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি

মোশারফ হোসেন | প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনা প্রধানতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব আজ পরিবর্তনশীল জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তন অঞ্চলভেদে, দেশভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। একই দেশের অভ্যন্তরেও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের জলবায়ু বিরাজ করতে পারে। মানুষ জলবায়ুর সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়।

জলবায়ু হলো কোনো নির্দিষ্ট এলাকার দীর্ঘমেয়াদী আবহাওয়ার ধরন। এটি কোনো এলাকায় দীর্ঘসময়ব্যাপী তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুমন্ডলের চাপ, বাতাস, বৃষ্টিপাত, বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন উপাদানের অস্তিত্ব গণনা এবং অপরাপর আবহাওয়া সংক্রান্ত চলকসমূহের পরিমাপের মাধ্যমের নির্ধারিত হয়। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনকে দায়ী করা হচ্ছে। কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, সিএফসি, জলীয়বাষ্প বিভিন্ন গ্যাস নির্গমনের ফলে বিশ্ব উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক কাঠামো এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীলতাই এর অন্যতম কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাতে বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ জেমস হানসেন বলেছিলন, ‘এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ কোনো সাধারণ ভয়ের বিষয় নয়, এটি নীরবে খেতে এসেছে বিশ্ব জনপদকে।’


জলবাযু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে ঋতুচক্রের হেরফেরের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ও হেরফের ঘটছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও উষ্ণতা বৃদ্ধি, ভূমিকম্প, নদীর নাব্য হ্রাস, ঘূর্ণিঝড়, খরা, হিমবাহ, হিমঝড়, দাবানল, অস্বাভাবিক নদ-নদীর প্রবাহ, মরুকরণ, বজ্রপাত, উল্কাপাত, তুষারপাত, ভূস্তরে ফাটল ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হচ্ছে। ইন্টান্যাশনাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেইঞ্জের তথ্যানুসারে, ‘২০৩০ সালের পর নদীর প্রবাহ নাটকীয়ভাবে কমে যাবে। ফলে এশিয়ায় পানির স্বল্পতা দেখা দেবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস নদী, খাল, বিল, তথা সমুদ্রের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মৎস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাছের অন্যতম প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীসহ অন্যান্য নদী দূষিত, সংকুচিত ও বিনষ্ট হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূলতায় একদিকে বৃষ্টির অভাব, অন্যদিকে অসময়ে ভারী বর্ষণ হওয়ায় মাছের প্রজননে বিঘœ হচ্ছে।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ঝুঁকির মধ্যে থাকা বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রায় ১৩ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের মাথা পিছু জিডিপি প্রায় ১৪.৪ শতাংশ হ্রাস পাবে। দেশের আবাদি জমির প্রায় ৩০ ভাগ উপকূলীয় এলাকায় রয়েছে। বাংলাদেশের মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা মতে, দেশের উপকূলবর্তী প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চল লবণাক্ততা দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। দক্ষিণ-দক্ষিণ পঞ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৮.৬ লাখ হেক্টর উপকূলীয় এলাকার মধ্যে ১০.৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত। লবণাক্ততাসহ জলবায়ুগত বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে মানুষ উপকূল ছাড়ছে। উপকূল ছেড়ে অন্য জায়গায়ও বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। লবণাক্ত পানি পান করা, দূষিত পানি পান করায় আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেই অসহায় দুর্ভোগ-প্রতিকূলতার সম্মুখীন।

প্রজনন স্বাস্থ্য, পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসা, শিশুর খাদ্য-পুষ্টি, বিকাশ-বৃদ্ধি, নিরাপত্তা, লেখাপড়াসহ স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সৃষ্টি হয় আরো নানা ধরনের জটিল সমস্যা। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত কারণে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১,৫৪,০০০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উৎপাদন তারতম্য ঘটছে। কাক্সিক্ষত ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। খাদ্য আমদানি তথা পরনির্ভরতার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিল্পের জন্য কাঁচামাল, জ্বালানি সংকট তৈরি হচ্ছে। বাড়ছে মৌসুমি বেকারত্ব এবং ছদ্ম বেকারত্ব। উৎপাদিত ফসলের পুষ্টিমান যেমন হ্রাস পাচ্ছে, তেমনি কমছে ফসলের পুষ্টি উপাদান। যেমন: জিংক, আয়রন, কপার ঘাটতির প্রভাব মানবদেহের উপর পড়ছে। মেধাহীন, দুর্বল-শুকনো অসুস্থ জাতি তৈরি হচ্ছে।

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের মতে, ‘বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি শিশু জলবায়ু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’ দুর্যোগ-মহামারিতে শিশুরা পরিবার, বিদ্যালয়, খেলার সাথীর সংস্পর্শে আসতে না পেরে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হচ্ছে। সুস্থ-সুন্দর স্বাভাবিক সামাজিকীকরণের অভাবে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে বিপদগামিতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিচ্যুতিমূলক আচরণ করছে। যেটি, জাতির জন্য অশনি সংকেত।


লেখক: প্রভাষক, সরকারি ইস্পাাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন