বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে সরকার নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি ৫ শতাংশ হারে দাম বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি গড় দাম বেড়েছে ৩৬ পয়সা। গত ১৪ বছরে এ নিয়ে ১১ বারের মতো বৃদ্ধি পেলো বিদ্যুতের খুচরা দাম। এই মূল্যবৃদ্ধি জানুয়ারি মাস থেকেই কার্যকর হবে। এর আগে গতবছরের নভেম্বর মাসে ১০ম বারের মতো পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বিইআরসি, যা গত ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে।
খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে গত ডিসেম্বর মাসে আবেদন করে দেশের ৬টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা। দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানি করার ব্যবস্থা করতো বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। কিন্তু গত ডিসেম্বর মাসে সরকার দাম বাড়ানোর ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে অধ্যাদেশ জারি করে, যা সংসদের চলতি অধিবেশনের প্রথম দিনেই উত্থাপিত হয়। অধ্যাদেশ অনুসারে সরকার বিশেষ পরিস্থিতিতে গণশুনানি ছাড়াই দাম বৃদ্ধি করতে পারবে। এরপর গত ১২ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো সরকার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে দাম বৃদ্ধি করে। গণশুনানি না করে একতরফাভাবে দাম বাড়ানোর ফলে দাম নির্ধারণে স্বচ্ছতা আর থাকলোনা বলেই মনে করা হচ্ছে। শুনানি হলে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, দুর্নীতি, অনিয়ম ও কোম্পানির অদক্ষতার বিষয় সামনে আসে। পেট্রোবাংলা এর আগে গ্যাসের দাম বাড়াতে বাড়তি এলএনজি আমদানি তথ্য দিয়েছিল সেটি শুনানির সময় ধরা পড়ে। বিইআরসি শুনানির ক্ষেত্রে সময় কমানো যেতে পারতো। একে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। সরকারের নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ালে বাজারে মনোপলি তৈরি হতে পারে, এতে কোম্পানিগুলি অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিতে পারে। অদক্ষতা আরো বাড়তে পারে। তাই অবশ্যই বিইআরসির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যুক্তিযুক্ত ছিল। বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর ফলে বাজারে তেমন প্রভাব পড়ার কথা নয়। তবু দেখা যাবে সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। আমাদের দেশে ৫ দাম টাকা বাড়লে বাজারে জিনিসপত্রের দাম ১০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা পুরনো। জ্বালানি তেলের দাম ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে পরিবহন ভাড়া ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাজারে ও ভোক্তা পর্যায়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। শক্ত হাতে সরকারকে দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
পিডিবি পাইকারি পর্যায়ে বিতরণ সংস্থার কাছে ৬ টাকা ২০ পয়সায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে থাকে। আর ভোক্তা পর্যায়ে গড়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা প্রতি ইউনিটে বিক্রি করে থাকে। দাম বৃদ্ধির ফলে এখন থেকে ভোক্তাকে ইউনিট প্রতি গড়ে ৭ টাকা ৪৯ পয়সা গুনতে হবে। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চ মাসে খুচরা পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি করেছিল বিইআরসি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ায় মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের জন্য এটা বাড়তি বোঝা হিসেবে দেখা দেবে। এছাড়া বিদ্যুতের দাম বাড়ায় নতুন করে মূল্যস্ফীতি উসকে দিতে পারে।
এর আগে গত বছরের জুন মাসে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বড়ানো হয়। ফলে ভোক্তাকে বাসার রান্নায় ব্যবহৃত ২ চুলার জন্য মাসে ১ হাজার ৮০ টাকা, এক চুলার জন্য দিতে হচ্ছে ৯৯০ টাকা। আর প্রিপেইড গ্রাহকদের প্রতি ইউনিটের জন্য (ঘনমিটার) ১৮ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে করে ভোক্তা পর্যায়ে ৪৩ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। এদিকে গত আগস্ট মাসে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে। ডিজেলের দাম লিটারে ৪৩ টাকা অকটেনের দাম ৪৬ টাকা এবং পেট্রোলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়। অবশ্য মাসের শেষের দিকে সরকার ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমিয়ে দেয়। কিন্তু এর কোনো প্রভাব বাজারে দৃশ্যমান হয়নি। ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি সাশ্রয় করতে গিয়ে গত জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে লোডশেডিং শুরু করেছে সরকার। নভেম্বরে শীত শুরুর আগ পর্যন্ত এটি চলমান থাকে। এরপর শীতের মধ্যেও ৮ জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং করা হচ্ছে। এখন দাম বাড়ানোর পর আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা সরকার দিতে পারছে কি না সেটাই দেখার বিষয়। তবে সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় আশাবাদী হবার কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না।
মূলত বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। দেশে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে শিল্প-কলকারখানা সব জায়গাতেই কমবেশি বিদ্যুতের ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে সব খাতে এই মূল্য বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতির কারণে ইতোমধ্যেই অর্থনীতিতে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। আমদানিতে টাকার মান পড়ে গেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। নতুন করে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। সত্যিকার অর্থেই ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে। কিছুদিন আগেও আমরা শুনেছিলাম, শীতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। দেশবাসী তাতে আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির পুরোপুরি উন্নতি তো হয়েইনি, বরং শীতকালেও ক্ষেত্রবিশেষে লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কয়েক মাস ধরে দেশের শিল্প কারখানা শনিবারে বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। ফলে শিল্পমালিকরা বাধ্য হয়ে বেশি দামে ডিজেল কিনে জেনারেটর ব্যবহার করে তাদের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছিল। এতে উৎপাদন খরচ অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। এমনিতেই ডলার সংকটের কারণে সব ধরনের শিল্প মালিকরা কমবেশি ডলার সংকটে ভুগছেন। ডলার সংকটের কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।
সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে এ খাতে ভুর্তুকি বাড়ালে আরো ভালো হতো। দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্যের দাম বাড়বে, উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে করে ব্যবসায়ে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে একদিকে যেমন বিদ্যুতের বিল বাড়বে, অন্যদিকে বাজারে পণ্যের দাম আরো বাড়বে। কৃষিকাজে সেচের ব্যয় বাড়বে। কৃষি পণ্যের দাম বাড়বে। এর সঙ্গে দোকানের বিদ্যুৎখরচ বাড়বে। কারখানায় উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। সাধারণত দেখা যায় যে, দিনশেষে ব্যয়বৃদ্ধির বড় একটি অংশ ভোক্তাদের ওপরই চাপানো হয়। বিদ্যুৎ খাতে সরকার বড় অংকের ভর্তুকি দেয় সত্য, মূল্য বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সরকারের ভুর্তুকি ব্যয় হয়তো কিছুটা কমবে, কিন্তু বড় ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে না। মনে করা হচ্ছে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে সরকার যে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের কথা বলেছিল, তার অংশ হিসেবেই এটা করা হয়েছে। তবে মূল্যবৃদ্ধি না করেও তা অন্যভাবে করা যেতে পারত। মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়ার নিশ্চয়তা সরকার দিতে পারছে না। দেশে সামগ্রিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও বিদ্যুৎ খাতের অদক্ষতা হ্রাস পায়নি, দক্ষতা বাড়েনি। দুর্নীতি বন্ধ করা যায়নি। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, অদক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, অদক্ষ ও ত্রুটিপূর্ণ সঞ্চালন লাইন, এসব সমস্যার সমাধান না করে ভোক্তার ওপর একতরফাভাবে দায় চাপানো হলো। আরেকটি বিষয় হলো, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির টাকার একটি রড় অংশ এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও কিছু ব্যবসায়ী ভোগ করছে। যেসব কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে সেগুলো আমলে নেওয়া জরুরি।
জ্বালানি নির্ভরশীল বিদ্যুৎ থেকে বেরিয়ে এসে সোলার বিদ্যুৎকেন্দ্র বা নবায়নযোগ্য এনার্জির যুগে দ্রুত প্রবেশ করার উদ্যোগ জরুরি ছিল। এই পরিস্থিতিতে সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকা উচিত। সরকার জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ বা সীমিত করে দিয়ে সৌরশক্তি ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। বিদ্যুৎখাতে শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস রাষ্ট্রীয় অপচয় বন্ধ করা জরুরি। সেসব না করে সকল দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সবচেয়ে সহজ কাজ মনে করে, সরকার সেটাই করেছে।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
drhasnat77@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন