আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র অতি সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর বোধগম্য কারণে বাংলাদেশের সর্ব শ্রেণির মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং গণমাধ্যমও তার ব্যাপক কাভারেজ দিয়েছে। এমনকি মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর শেষ হওয়ার পরেও প্রায় সপ্তাহখানেক প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এর রেশ চলতে দেখা যায়। অথচ, গত বছরের মার্চ মাসে আমেরিকার রাজনৈতিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুলান্ড যখন বাংলাদেশ সফর করেন তখন মি. ডোনাল্ড লু মি. ভিক্টোরিয়ার টিমে ছিলেন। এবার তিনি এসেছেন নিজেই মার্কিন প্রতিনিধি হয়ে। বস্তুত ডোনাল্ড লু নামটি বাংলাদেশে এত পরিচিত ছিল না। কারণ, কত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারিই তো (মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারিকে বাংলায় সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলা হয়) মার্কিন প্রশাসনে এলেন আর গেলেন। কিন্তু ডোনাল্ড লু তাদের মধ্যে অত্যন্ত মশহুর হয়ে গেছেন। কারণ, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গদিচ্যুত করায় পাক সেনাবাহিনী, মুসলিম লীগ এবং পিপিপি যুথবদ্ধ হয়েছিল আমেরিকার জোরে। আর এই চক্রে আমেরিকার হয়ে খেলেছেন ডোনাল্ড লু। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর লক্ষ লক্ষ লোকের একাধিক জনসভায় ইমরান খান প্রকাশ্যে বলেছেন, ডোনাল্ড লু তাকে ক্ষমতাচ্যুত করায় পাকিস্তানের তৎকালীন বিরোধী দলসমূহ এবং সেনাবাহিনীকে প্রভাবান্বিত করেছিলেন।
ডোনাল্ড লু আরেকটি কারণেও দক্ষিণ এশিয়াতে সবিশেষ পরিচিত। পাকিস্তানে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে মি. লু আমেরিকার সাথে নেপালের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন কমপ্যাক্ট স্বাক্ষরে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। যদিও চুক্তি মোতাবেক নেপাল তার ওয়াদা পালন করতে পারেনি। তৎসত্ত্বেও ডোনাল্ড লু গত বছর নেপাল সফর করেন এবং নেপালি পার্লামেন্টকে দিয়ে ঐ চুক্তি র্যাটিফাই করান। আরো বলা হয় যে, শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রনিল উইকার মেসিঙ্গেকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর পেছনেও প্রধান কন্ট্রিবিউশন ছিল এই ডোনাল্ড লুর।
মি. লুর বাংলাদেশ সফরের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য বুঝতে হলে গত ২ বছরে ঘটে যাওয়া কতকগুলি ঘটনার প্রতি আমাদের নজর ফেরাতে হবে। দেখা যাচ্ছে, জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকার নজর অতীতের তুলনায় বহু গুণ বেড়েছে। এর মধ্যে ১৭টি ছোট বড় প্রতিনিধি দল আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসেছে। আর বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা গেছে ১০টি প্রতিনিধি দল। ডোনাল্ড লুর সফরের কয়েক দিন আগেই হোয়াইট হাউজের (মার্কিন প্রেসিডেন্টের অফিস কাম রেসিডেন্স) নিরাপত্তা বিষয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লাউবাচার বাংলাদেশ সফর করে যান। বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার এই ঘনঘন এনগেজমেন্টের পেছনে রয়েছে স্পষ্টত দুটি কারণ। একটি হলো স্বল্প মেয়াদে যেসব বিষয়ে মতানৈক্য হয় সেগুলো দূর করা এবং দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশকে ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে (আইপিএস) অন্তর্ভুক্ত করা। এই আইপিএসে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে আমেরিকার রয়েছে সুদূরপ্রসারী জিও-স্ট্র্যাটেজি বা ভূকৌশল।
এগুলো ছাড়াও বাংলাদেশ অনেক দিক দিয়ে আমেরিকার ওপর বিরাটভাবে নির্ভরশীল। ২০২২ সালে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৩ বিলিয়ন ডলার। আমেরিকা বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক পার্টনার। রোহিঙ্গা সমস্যায় আমেরিকা এপর্যন্ত ১ দশমিক ৯ অর্থাৎ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে বৃহত্তম ডোনার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। করোনার সময় আমেরিকা বাংলাদেশকে বিনামূল্যে ১০ কোটি ডোজ টিকা দিয়েছে। সমগ্র বিশে^ আমেরিকা বিনামূল্যে যত টিকা দিয়েছে, তার ৭০ শতাংশ দিয়েছে বাংলাদেশে।
এসব ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি রয়েছে কিছু নেতিবাচক দিক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হাল হকিকত আমেরিকার পছন্দ নয়। আবার বাংলাদেশের রাজনীতির হাল হকিকত সম্পর্কে আমেরিকা যা বলে বাংলাদেশ সরকার সেটিকে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বলে মনে করে। আমেরিকার বাংলাদেশের সাথে এত ঘন ঘন দেন দরবার করার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। সেটি হলো, দুটি দেশের মধ্যে এক ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি। বাহ্যত এটি সরাসরি সামরিক চুক্তি নয়। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হলো সেটিই। ঢাকার রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং পর্যবেক্ষক মহলে একটি শক্তিশালী গুজব বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ঐ গুজবে বলা হচ্ছে যে, আমেরিকার মনে মনে খায়েশ হলো, বাংলাদেশকে সামরিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী করা। এমনভাবে শক্তিশালী করা যাতে করে সামরিক দিকে তাকে অর্থাৎ বাংলাদেশকে চীন, ভারত বা রাশিয়ার মুখোপেক্ষি হতে না হয়। বিভিন্ন ডিফেন্স জার্নালে যেসব তথ্য পাওয়া যায় সেখান থেকে দেখা যায়, এই মুহূর্তে মিয়ানমারের জনসংখ্যা ৬ কোটি হওয়া সত্ত্বেও সেই দেশটি ১৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের চেয়ে সামরিকভাবে অধিকতর শক্তিশালী। এক শ্রেণির রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, যদি মার্কিন অস্ত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট শক্তিশালী হতো তাহলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে এই খেলা খেলার সাহস পেত না।
॥দুই॥
সকলেই প্রশ্ন করছেন, ডোনাল্ড লু’র এই সফরে বাংলাদেশ কী পেল? এ ব্যাপারে সঠিক মূল্যায়নের পূর্বে আমাদের জানতে হবে, এই সফরকে ঘিরে কার কী প্রত্যাশা ছিল। বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল ৩টি। একটি হলো, র্যাবের ওপর থেকে স্যাংশন প্রত্যাহার। দ্বিতীয় হলো, জিএসপি সুবিধা ফেরত দেওয়া। তৃতীয় হলো, রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত হিল্লা করা। কিন্তু মার্কিনীদের এজেন্ডা অনেক লম্বা। এর মধ্যে রয়েছে সর্বাগ্রে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন, বিরোধী দলের ক্রমহ্রাসমান গণতান্ত্রিক অধিকার ফেরত দেওয়া, ক্রম সংকোচনশীল বাকস্বাধীনতা পুনরুদ্ধার, আন্তর্জাতিক মানের অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং সেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়া। অর্থাৎ সব দল যাতে সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে এবং নির্বাচনী ক্ষেত্রে সমস্ত রাজনৈতিক দল যেন সমান সুযোগ-সুবিধা পায়। এছাড়া কিছুক্ষণ আগে আমরা উল্লেখ করেছি, মার্কিনীদের অগ্রাধিকারে রয়েছে আইপিএসে বাংলাদেশের যোগদান এবং দুটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন। এই সফরের পটভূমিতে রয়েছে আরেকটি ঘটনা, যেটিকে আমেরিকা খুব গুরুত্ব দেয়। সেটি হলো, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তা। এই বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, শাহিনবাগে পিটার হাসকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনায় ডোনাল্ড লু’র ঊর্ধ্বতন অফিসার মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইন্ডি শেরম্যান বাংলাদেশ সরকারকে ফোন পর্যন্ত করেছিলেন। এই তথ্য দিয়েছেন মার্কিন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিশটিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রিয়াজ। পিটার হাসকে বিব্রত করার পরেও জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল শাহিনবাগ গিয়েছিল। তখন কিন্তু ‘মায়ের কান্না’ বা এই ধরনের সংগঠনের লোকজনদের দেখা যায়নি। পিটার হাসের ঘটনাটিকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দেওয়া হয়েছিল। আর সেটিও করেছিল রাশিয়া। মস্কো থেকে এবং রাশিয়ার ঢাকা দূতাবাস থেকে রাশিয়ার বিবৃতি দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?
॥তিন॥
এসম্পর্কে অনেক কথা বলা যায়। ডোনাল্ড লু’র সফরের মূল্যায়ন এভাবে করা যায় যে, আমেরিকা বাংলাদেশের ব্যাপারে তার আগের অবস্থান এতটুকু বদলায়নি। তারা শুধুমাত্র র্যাবের মানবাধিকার লংঘনের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় বিপুল প্রশংসা করেছে। এরমধ্য দিয়ে কিন্তু অন্য একটি বার্তাও পাওয়া যায়। সেটি হলো, আমেরিকা মনে করে যে তাদের কথায় কাজ হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও সম্ভবত হবে। ইংরেজি ডেইলি স্টারের সাথে একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড লু বলেছেন যে, স্বয়ং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করায় তিনি মুগ্ধ। আসলে এটি ডিপ্লোম্যাটিক প্রোটোকলে পড়ে না। কারণ, ডোনাল্ড লু ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও নন, আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও নন। আব্দুল মোমেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বয়ং বিমান বন্দরে গিয়ে রিসিভ করেছেন। আবার চীনের পরারাষ্ট্রমন্ত্রী যখন আফ্রিকা গমনের পথে ঢাকা বিমান বন্দরে মধ্য রাতে যাত্রা বিরতি করেন, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সেই মধ্যরাতে বিমানবন্দরে গিয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলেন। দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা এবং চীন এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে বাংলাদেশ ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। এটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। এর আগেও আমি আরেকটি কলামে বলেছিলাম, বাংলাদেশ সেই সার্কাসের খেলার মতো টান টান দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছে। তবে এই সফরে কোনো পক্ষই কংক্রিট কিছু পায়নি। বাংলাদেশ আইপিএস এবং দুইটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর যেমন এড়িয়ে গেছে তেমনি আমেরিকাও জিএসপি ফেরত দেয়নি এবং স্যাংশন তুলে নেয়নি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব অধ্যাপক শহিদুল হক বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশি^ক যে মেরুকরণ গড়ে উঠতে যাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশকে পাশে চায় আমেরিকা। এ কারণে আমেরিকা গরম গরম কথার পাশাপাশি নরম নরম কথাও বলছে, যাতে করে বাংলাদেশ রুশ-ভারত-চীন বলয়ে না যায়। কিছুটা আওয়ামীপন্থী বলে পরিচিত ওয়াশিংটনে সাবেক বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন যে, ডোনাল্ড লু’র সফরের ইতিবাচক দিক হলো এই যে, গত দুই মাসে দুই দেশের বিশেষ করে বাংলাদেশের কণ্ঠ যেভাবে মার্কিন বিরোধী হয়ে উঠছিল, সেখানে দুইটি দেশের অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ে ডায়ালগ বা সংলাপ শুরু হয়েছে। আরেকটি হলো, এটি এখন ওপেন সিক্রেট, র্যাব যদি তাদের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় রাস টেনে না ধরতো তাহলে আরো স্যাংশন আসতো।
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য যন্ত্রপাতি বহন করে যে রুশ জাহাজটি বন্দরে আসছিল সেটিকে ঘুরিয়ে দেওয়ায় বাংলাদেশ নতুন স্যাংশনের হাত থেকে বেঁচে গেছে। ১৭ জানুয়ারি ডেইলি স্টারকে ডোনাল্ড লু যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সেই সাক্ষাৎকার থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে আমেরিকার অবস্থান এতটুকু বদলায়নি। ডেইলি স্টারের ঐ ইন্টারভিউয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ঢাকা থেকে বলা হচ্ছিল যে, বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কথা বলে আমেরিকা ভিয়েনা কনভেনশনের নীতিমালা লংঘন করছে। এসম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? উত্তরে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘আমি ৩৩ বছর ধরে সরকারি চাকরিতে আছি। যতগুলো স্থানে আমি চাকরি করেছি তার প্রত্যেকটি স্থানে আমি সংশ্লিষ্ট সরকারসমূহকে বলেছি যে, আপনারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মেনে চলুন। একজন মার্কিন কূটনীতিকের সঠিক পরিচয় এটাই।’
ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফরের ফলাফল খোঁজার জন্য বেশি দূর যেতে হবে না। ওপরের স্তবকেই সেটি পাওয়া যায়।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন