শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ইহুদী বসতি স্থাপন বন্ধে নিরাপত্তা পরিষদের রায়

সম্পাদকীয়-১

| প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে ইহুদী বসতি স্থাপন বন্ধের পক্ষে রায় দিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে ইহুদী বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন এবং তা বন্ধ করতে হবে, এই দাবি সম্মিলিত ওই প্রস্তাবটি গত শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হয়। ১৫ সদস্যের এই পরিষদের ১৪ সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। ২০১১ সালে একই রকমের একটি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এবার সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র নীতিগতভাবে প্রস্তাবটি পাস হোক, চেয়েছে। গুঞ্জন ছিল,  প্রস্তাবটি যাতে নির্বিঘেœ পাস হয়, এমনটাই চাইছে ওবামা প্রশাসন। প্রস্তাব নিয়ে একটি নাটকীয়তাও তৈরি হয়। প্রস্তাবটি প্রথমে দিয়েছিল মিসর। সে অনুযায়ী নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বিকেলে ভোটাভুটির কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা আগে মিসর প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে এবং ভোটাভুটি স্থগিত হয়ে যায়। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, চাপের মুখে মিসর প্রস্তাবটি তুলে নেয়। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্পের আপত্তির কারণেই মিসর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। এর পরপরই একই প্রস্তাব নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভেনিজুয়েলা ও সেনেগালের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়। সেই প্রস্তাবের ওপরই এই ঐতিহাসিক রায় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতা প্রস্তাব পাসের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
নিরাপত্তা পরিষদের এই সিদ্ধান্ত বা রায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর তাৎপর্যবহ। এ প্রসঙ্গে ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রতিনিধির প্রতিক্রিয়া প্রণিধানযোগ্য। রয়টার্সকে দেয়া এই প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, আজ আন্তর্জাতিক আইনের বিজয়ী হওয়ার দিন। সুসভ্য ভাষা এবং সংকট নিরসন প্রক্রিয়ার জয়। এটি ইসরাইলী চরমপন্থার প্রত্যাখ্যান। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বার্তা দিয়েছে, দখল কায়েমের মধ্য দিয়ে শান্তি আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। শান্তি আনতে দরকার দখল বন্ধ করা এবং ১৯৬৭-এর সীমানা অনুযায়ী ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ইসরাইলী রাষ্ট্রের পাশাপাশি শান্তিতে থাকতে দেয়া। উল্লেখ আবশ্যক, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের এলাকা বিশেষ দখল করে নেয়। পরে দখলীকৃত এলাকায় ইহুদী বসতি স্থাপন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ পর্যন্ত ওই দুই অংশে ইসরাইল একশ’রও বেশী ইহুদী বসতি স্থাপন করে কয়েক লাখ ইহুদীর পুনর্বাসন সম্পন্ন করেছে। দখলীকৃত ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে ইহুদী  বসতি স্থাপন ফিলিস্তিনীরা কখনোই মেনে নেয়নি। তারা লাগাতার এর বিরোধিতা করে আসছে। নৈতিক ও আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে ওই বসতি স্থাপন অবৈধ হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরাইলের মিত্র দেশগুলোর নীরব  প্রশ্রয় ও সমর্থনের কারণেই ইসরাইল একের পর অবৈধ ইহুদী বসতি গড়ে তুলেছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবটি পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে ইসরাইলের গালে একটা বড় ধরনের চপেটাঘাত পড়েছে। যে প্রতিক্রিয়া অতঃপর সে ব্যক্ত করেছে, তাতে সভ্যতা-শালীনতার বালাই নেই। চরম ঔদ্ধত্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দফতর থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরাইল এই লজ্জাকর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছে। এর কোনো শর্ত মানতে সে বাধ্য নয়। জাতিসংঘে ইসরাইলী রাষ্ট্রদূত আল- জাজিরাকে জানিয়েছেন, তাদের সরকার আশা করছে, যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবে ভেটো দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসক এবং জাতিসংঘের নতুন মহাসচিব এসে নতুন কিছু করবেন।
নিরাপত্তা পরিষদে আলোচ্য প্রস্তাব পাস হওয়ার ফলে অবৈধ ইহুদী বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে কিংবা এ পর্যন্ত স্থাপিত ইহুদী বসতি সরিয়ে নেবে ইসরাইল, এটা বিশ্বাস করার সময় এখনো আসেনি। জাতিসংঘে ইসরাইলী দূত যে আশা প্রকাশ করেছেন, সেটাও বিবেচনার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কট্টর ইহুদীবাদী বলে পরিচিত। তিনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন যাতে প্রস্তাবটি পাস না হয়। তিনি আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রস্তাবে তিনি ভেটো দেবেন। প্রস্তাব পাসের পর এক টুইট বার্তায় তিনি অনেকটা হুমকির ভাষায় বলেছেন, ’২০ জানুয়ারির পর পরিস্থিতি ভিন্ন ধাপে রূপ নেবে।’ বলা বাহুল্য, ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতই বলতে পারে। এ মুহূর্তে যা বাস্তব তার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ফিলিস্তিনীদের একটা বড় রকমের নৈতিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। এ বিজয় বিশ্বের শান্তি ও স্বাধীনতাকামী মানুষেরও নৈতিক বিজয়। এর আগে আরো একটি নৈতিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। সে বিজয় এসেছে জাতিসংঘেরই একটি সংস্থা- ইউনেস্কোর মাধ্যমে। গত ১৩ অক্টোবর ইউনেস্কো একটি প্রস্তাব পাস করে যাতে বলা হয়, জেরুজালেমে অবস্থিত পবিত্র আল-আকসা মসজিদ শুধুই মুসলমানদের পবিত্র স্থান। এর সঙ্গে ইহুদী ধর্ম বা ইহুদীদের কোনো সম্পর্ক নেই। এ ধরনের নৈতিক বিজয় বাস্তবিক বিজয়ের ইঙ্গিতবাহী। এতে কোনোই সন্দেহ নেই, ইসরাইল যত শক্তিধরই হোক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শক্তির চেয়ে নিশ্চয় তার শক্তি বেশী নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি একাট্টা হয়, চাপ ও শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়, তবে ইসরাইল নতি স্বীকার করতে অবশ্যই বাধ্য হবে। এ যাবৎ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যথাযথ ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় নি। এখন সময় এসেছে, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিষ্কণ্টক করার পাশাপাশি ফিলিস্তিনের হৃত ভূখ- ফিরিয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যথোপযুক্ত সক্রিয়তা ও ভূমিকা কামনা করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন