শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ফ্লোর প্রাইস ও শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন দুঃসংবাদের শেষ নেই। বিশেষ করে, করোনা থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকালীন সময়কে মনে রাখতে চাইবে না কেউ। তরতর করে এগিয়ে চলা বিশ্ব অনেকটা গতি হারিয়েছে। সদ্য প্রকাশিত গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বিশ্ব অর্থনীতির যে চিত্র তুলে ধরেছে তা সত্যিই হতাশার। দুর্দশার এক কঠিন সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ, গত জুনে এই পূর্বাভাস ছিল ৩ শতাংশ অর্থাৎ বিশ্ব অর্থনীতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে, যেকোনো সময় পা হড়কে মন্দায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে বিশ্ব জুড়ে জনমানসে তৈরি হয়েছে এক অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো এত ঘণবসতিপূর্ণ, উচ্চ বৈষম্যের অসচেতন দেশে জনমনে উদ্বেগের দানা বাঁধা খুব স্বাভাবিক। তাই-তো আশা-নিরাশার এই কুয়াশাচ্ছন্ন গুমোট পরিবেশে গুজবের ডালপালা মেলে সহজেই। আর গুজব এমনই এক জিনিস, যা বাতাসের আগে ধায়। এ কথা অস্বীকারের করা যাবে না যে, আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা নেই। বিশেষ করে, অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বা অরাজকতা দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা কমে আসছে ক্রমাগত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার গুজব। শুরু হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের হিড়িক। বেগতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে সংশ্লিষ্ট মহলের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। পরিস্থিতি এ যাত্রায় নিয়ন্ত্রণে এলেওÑ যা রটে তা যে ঘটে না এমন মনে করার অবকাশ নেই। গুজবের সবচেয়ে উর্বর জায়গা হচ্ছে অর্থ সংস্থানের অন্যতম উৎস শেয়ারবাজার। যেখানে অতি সহজে বাম্পার ফলন পাওয়া যায়। মুহূর্তেই সব গতিশীলতাকে স্থবির করে দেয়। বিনিয়োগকারী দিগি¦দিক, তটস্থ, হিতাহিত জ্ঞানশূণ্যÑ বিবেচনার ঝুলি শিকেয় তুলে, সচেতন মনে গুজবকে কাঁধে নিয়ে মনের সুখে ঘুরে বেড়ায়। আর অবচেতন মনে এই ভার অন্যকে দিয়ে বেড়ায়। ফলে বাজার হয়ে ওঠে গুজবময়, অস্থিতিশীল। এই গুজবই এক সময় শেয়ারবাজারে গজবে পরিণত হয়। হামেশাই এমনই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের শেয়ারবাজার। যখনই বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পথ খুঁজে পায়, তখনই মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় কোনো না কোনো গুজব। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে এমনই এক গুজবের বিষয়বস্তু হচ্ছে, ফ্লোর প্রাইস। ফ্লোর প্রাইস তুলে ফেলা হবে কি হবে না, এটা বিনিয়োগকারীদের চিন্তার বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে ভেবে দেখা দরকার, ফ্লোর প্রাইস কেন আরোপ করা হয়েছে এবং কাদের জন্য? বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে শেয়ারদর যখন একেবারে তলানিতে এবং শেয়ারবাজারের সূত্র মতে, বাজারের নিজস্ব শক্তিতে ঘুরে না দাঁড়িয়ে উল্টো আচরণ করে অর্থাৎ সূচক যখন বারবার সূচনালগ্নের অবস্থানে ফিরে যায়, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিরূপায় হয়ে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। এযাবৎকালে শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এবার নিয়ে দুইবার ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়া হয়। যদিও এটি একটি সাময়িক সমাধান। ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আস্থা হারিয়ে ফেলা হতাশ বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। তারা নিশ্চয়তা দেয়, শেয়ারদর এর নিচে আর নামবে না। এটি দৃশ্যত বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। ফলে সূচকও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে যায়। ধারণা করা হয়, যারা সূচক দেখে বিনিয়োগ করে এর ফলে তারা আবার বিনিয়োগে ফিরে আসবে। বাজার চাঙা হবে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র বলছে অন্য কথা, বছর জুড়েই অস্থিরতায় কেটেছে শেয়ারবাজার। ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ডিএসইএক্স সূচক ছিলো ৭ হাজার ২৪ পয়েন্ট। লেনদেন হয় ১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। সেই অবস্থান থেকে সূচকের টানা ক্রমাবনতি হয়ে ২৯ ডিসেম্বর সূচক দাঁড়ায় ৬ হাজার ২০৬ পয়েন্টে। লেনদেনেরও একই হাল ৩৪৫ কোটি টাকা। অথচ, গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আবার নতুন বছরের ২ জানুয়ারি লেনদেন হয় ১৪৫ কোটি টাকা। এভাবেই চলছে আমাদের শেয়ারবাজার। এটি নতুন কিছু নয়। নতুন বছরেও দরপতন অব্যাহত আছে। হাজার কোটি টাকার লেনদেন নেমেছে ২০০ কোটি টাকার আশপাশে। বাজারে চরম তারল্য সংকট চলছে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা লেনদেনে অংশ নিচ্ছেন না। আরও দরপতনের অপেক্ষা করছে। বাজারে প্রায় ৪০০ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত। এরমধ্যে অনেক কোম্পানি ভালো মৌলভিত্তির। যেখানে যেকোনো বিবেচনায় বিনিয়োগ করা যায়। ডিভিডেন্ড ইল্ড অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় হচ্ছে, এসব কোম্পানিও ফ্লোর প্রাইসে পড়ে রয়েছে। আর লেনদেন হচ্ছে হাতে-গোনা নির্দিষ্ট ২৫ থেকে ৩০টি কোম্পানির। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। ফলে মোটের ওপর বাজারে এক ধরনের অচলায়তন চলছে। এ থেকে নিষ্কৃতির উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। কেউ কেউ বলছেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে বাজারে লেনদেন হচ্ছে না। বড় কোম্পানির শেয়ারে কোনো মুভমেন্ট নেই। ছোট কোম্পানির শেয়ার দিয়ে একটি কৃত্রিম সূচক দেখানো হচ্ছে। এইভাবে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে দিনের পর দিন বাজার অকার্যকর করে রাখার কোনো মানে হয় না। তাই তো অনেকের মতে, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া ১৬৯টি কোম্পানির নিচের দিকে যে ১ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে তা ২ থেকে ৩ শতাংশ করে পর্যবেক্ষণ করা যায় কিনা। পাশাপাশি ব্লক মার্কেটে শেয়ার কেনাবেচার পরিমাণ ৫ লাখ টাকার পরিবর্তে ২ লাখ নির্ধারণ করা। কারণ, যাদের পুঁজি কম তারাও যেনো লেনদেন করতে পারে। ফলে লেনদেন বাড়বে। অনেকের যুক্তি, সারাবিশ্বই তো যুদ্ধের উত্তাপে পুড়ছে। কিন্তু কোথাও তো ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হয়নি অথবা এ জাতীয় ঠেকনা দিয়ে শেয়ারবাজার ঠেকিয়ে রাখার কোনো একাডেমিক ভিত্তি নেই। শেয়ারবাজারে চাহিদা ও সরবরাহ মুক্তভাবে উঠানামা করতে দেওয়া উচিত। ধরে নিলাম কথাগুলো সবই যৌক্তিক। এই নজিরবিহীন ফেøার প্রাইসই যত সমস্যার মূল। তবে যারা যুদ্ধ করছে, সেই রাশিয়ার শেয়ারবাজার এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে অথবা দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কার বাজারও স্বাভাবিকের পথে। সমস্যা যত বাংলাদেশে। শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতা একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আজ ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলে, সূচক যে আবার ৩ হাজারের ঘরে আসবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? আমরা কি প্রতিবছর নতুন করে শুরু করব? শেয়ারবাজারের এই ন্যাক্কারজনক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আর কত? প্রতিটি দেশেরই উন্নয়নে যেমন ভিন্ন পন্থা থাকে, তেমনি প্রতিটি জাতিরই রয়েছে সুস্পষ্ট চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্য, যা তাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিফলিত হয়। দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, বাঙালির অর্থনৈতিক জ্ঞান সীমিত। আর শেয়ারবাজার তাদের মনোজগতে কখনো গুরুত্বই পায়নি। এর কারণ ঐতিহাসিকভাবেই শেয়ারবাজার কখনো সেভাবে ভরসার জায়গায় পরিণত হয়নি। এখানে কারসাজিকে একটি নান্দনিকতায় পরিণত করা হয়েছে বারংবার। ফলে বিনিয়োগকারীদের মানসিকতাও সেভাবে (নগদ পাওয়া) গড়ে উঠেছে। সবাই স্বল্পসময়ে ধনী হতে চায়। ধনী এক শ্রেণির লোক ঠিকই হয়, তবে বছর শেষে ফতুর হয় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে আমাদের বিনিয়োগকারীরাও সাহসী নয়। জ্ঞানের স্বল্পতা থেকে এই ভীরু মানসিকতা তৈরি হয়। না হয় ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারগুলোর পিই রেশিও এখন যথেষ্ট বিনিয়োগযোগ্য থাকার পরও কেউ বিনিয়োগ করছে না। সবাই অপেক্ষায় আরও দর কমবে। কোম্পানির শেয়ারের অন্তর্নিহিত যে একটি মূল্য আছে, সেটি কেউ বুঝতে চায় না। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে অভ্যস্থ নয়। সবাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে প্রথম দিন থেকেই লাভ করতে চায়। মনে রাখা দরকার, দ্রুত অর্থ উপার্জনের কোনো শর্টকাট নেই। প্রতিটি দ্রুত অর্থ উপার্জনের কৌশল অবশেষে অর্থ হারানোর কৌশল হিসাবে দেখা দেয়। ভালো মৌলভিত্তি বা উচ্চমানের শেয়ারের বিনিয়োগ এবং সঠিক সময়ের জন্য তাদের ধরে রাখা সম্পদ তৈরির একমাত্র উপায়। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দোষ দিয়ে কি লাভ। যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো এক নীতির উপর অটল থাকতে পারে না। সকাল-সন্ধ্যা নীতি পরিবর্তন করে। আর ফ্লোর প্রাইস তুলে ফেলার জন্য সবচেয়ে যাদের বেশি তাড়া বা লেনদেনের জন্য যে এত মায়াকান্না, সেই ব্রোকারহাউসদের কথা বললে, প্রথমে বলতে হয়, কিছুদিন আগেও যখন বিভিন্ন জাঙ্ক শেয়ারে অস্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছিল বা এখনো হয়, তখন কি এই ব্রোকাররা তাদের সোনার ডিম পাড়া হাঁস অর্থাৎ অসচেতন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কোথায় বিনিয়োগ করা উচিত বা অনুচিত, সে বিষয়ে সতর্ক করেছে? তারা সর্বদা নগদ কমিশন লাভে ব্যস্ত। ফলে আজ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নিঃস্ব। বাজারের কোনো নিজস্বতা নেই। লেনদেনের দীনতায় হাউসগুলোর লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। শেয়ারশুন্য বিও হিসাবের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। নতুন ট্রেক লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নাকি একেবারেই বিনিয়োগকারী খুঁজে পাচ্ছে না। এটি ব্রোকারহাউসের অতীত কর্মের ফল। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, ব্রোকারহাউস কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনের একটি কথা মনে রাখতে হবে, শেয়ারবাজার খুব বেশি দৌড়ানোর জায়গা নয়। এখানে আস্তে আস্তে ধৈর্য্য নিয়ে হাঁটতে হয়। তা হলেই গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ সুগম হয়।

লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।
monirulislammi888@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন