পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আবারও বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছে বাসা-বাড়ির গ্যাসের দাম। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মাত্র ছয় দিনের মাথায় শিল্প পর্যায়ে অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। বর্তমান সরকারের আমলে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১০ বার এবং গ্রাহক পর্যায়ে ১১ বার বাড়ানো হয়েছে। আগামী মাসে সরকারের নির্বাহী আদেশে এই দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। এ ইংগিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, এতে মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। জ্বালানির দাম যেভাবেই বাড়ানো হোক না কেন একসময় তা ভোক্তাকে পরিশোধ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তানুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে হবে। ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই এ কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এর আগে জ্বালানি বিভাগের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একলাফে ১৭৮ ভাগ এবং শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ ভাগ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত আট বছরের হিসাবে এবার গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ল।
স¤প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ১৭৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বাড়ানো হয়, যা আগামী ফেব্রæয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে কার্যকর হবে। এই দাম বাড়ানোর ফলে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১১ টাকা। এতে করে সংস্থাটির বিদ্যুৎ কেনাবেচার ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানান। এদিকে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী দাঁড়াবে তা বিবেচনায় না নিয়ে কেবল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) তুষ্ট করতে সরকার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করেছে বলে মনে করছে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
গত ১৮ জানুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়, কেনাবেচার বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে আসে। এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি সার-সংক্ষেপ বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সার-সংক্ষেপে বিদ্যুৎ কেনাবেচায় ঘাটতি কমাতে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে ইউনিটপ্রতি ব্যয় হয় ৯ টাকা। আর বিতরণ কোম্পানিগুলোর পিডিবি ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ বিক্রি করে ৬ টাকা ২০ পয়সা। গেল বছরের নভেম্বরে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য প্রায় ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়। পরে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। বর্তমান সরকারের আমলে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১০ বার এবং গ্রাহক পর্যায়ে ১১ বার বাড়ানো হয়েছে। আগামী থেকে নতুন এই দাম কার্যকর হবে। অর্থাৎ মার্চ মাসের বিলের সঙ্গে বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ, শিল্প এবং বাণিজ্যে বাড়তি বিল পরিশোধ করতে হবে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে সরকার ভর্তুকি সমন্বয় করতে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে।
সরকারি এক তথ্য-পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ৩ টাকা ১৫ পয়সা। ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১১ দফায় দাম বাড়ানোর ফলে বর্তমানে ইউনিটপ্রতি গড় মূল্য দাাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ৫৬ পয়সা। অর্থাৎ এরই মধ্যে বর্তমান সরকার ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১২৬ দশমিক ৪০ শতাংশ বাড়িয়েছে। এবার ইউনিটপ্রতি ১৯ পয়সা বাড়ানো হলে আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদ মিলিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ার হার দাঁড়াবে ১৬১ দশমিক ৭ শতাংশ। আগামী এক বছরে সরকার বিদ্যুতের দাম আর না বাড়ালেও প্রতি পাঁচ বছর মেয়াদে গড়ে মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে প্রায় ৫৪ শতাংশ।
অপদিকে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, আমরা সব সময় বলে এসেছি যে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেলের দাম এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে বাড়লে যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু সরকারের এই মূল্যবৃদ্ধি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়াতে হয়েছে।
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব জানান, গত ১৮ জানুয়ারি বিদ্যুতে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে পিডিবির ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাবে। এই ঘাটতি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে হবে। ফলে বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভর্তুকি দেবে না। তাই ঘাটতি কমাতে দাম সমন্বয় করা হবে। এজন্য পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম কত সমন্বয় বা বাড়ানো হবে, তা নিয়ে কাজ চলছে। আগামী মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের ঘোষণা আসতে পারে।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি ৫ টাকা দুই পয়সা। আগামী মাসে তা বেড়ে দাড়াঁবে ১৪ টাকা। প্রতি ঘনমিটারে দাম বাড়ছে ৯ টাকা। এই দাম বাড়ার কারণে মাসে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে বর্তমানের চাইতে ৮০০ কোটি টাকার বেশি। পিডিবির হিসাবে, আগামী ফেব্রæয়ারি মাস থেকে আগামী বছরের ২০২৪ সাল জুন পর্যন্ত ১৭ মাসে মোট উৎপাদন ব্যয় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে গ্যাসে মোট বিদ্যুতের ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ উৎপাদন হয়। আগামী মাসের শুরুতে নতুন দাম কার্যকরের পর গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় দাঁড়াবে ১০ টাকা ৯২ পয়সা।
এ ছাড়া আগামী মাসে বিদ্যুৎে উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন দামে এই পরিমাণ গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হবে ১ হাজার ৫২ কোটি টাকা। পরের মাস মার্চে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ২ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন দামে এই পরিমাণ গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ হবে ১ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আগের চেয়ে এতে ব্যয় বাড়বে ৭৬৪ কোটি টাকা। এর পরের মাস এপ্রিলে ১ হাজার ৬৪ এমএমসিএফডি, মে মাসে ১ হাজার ১৩ এমএমসিএফডি এবং জুনে ৯৯৬ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহের প্রাক্কলন করা হয়েছে। নতুন দামে এ পরিমাণ গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হবে যথাক্রমে ১ হাজার ২৬৫ কোটি, ১ হাজার ২০৪ কোটি ও ১ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এপ্রিলে ব্যয় বাড়বে ৮১১ কোটি টাকা, মে মাসে ৭৭২ কোটি ও জুনে ৭৬০ কোটি টাকা। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে জুলাইয়ে ১ হাজার ৪০ এমএমসিএফডি, আগস্টে ১ হাজার ৩৬, সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ১২, অক্টোবরে ৯৯৩, নভেম্বরে ৮৯৫, ডিসেম্বরে ৮৩৭, জানুয়ারিতে ৮০৩, ফেব্রæয়ারিতে ৮৪০, মার্চে ৯৩৭, এপ্রিলে ১ হাজার ৩৩, মে মাসে ৯৮৩ ও জুনে ১ হাজার ৯ এমএমসিএফডি। এতে উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে যথাক্রমে জুলাইয়ে ৭৯৪ কোটি, আগস্টে ৭৯০ কোটি, সেপ্টেম্বরে ৭৭২ কোটি, অক্টোবরে ৭৫৮ কোটি, নভেম্বরে ৬৮৩ কোটি, ডিসেম্বরে ৬৩৮ কোটি, জানুয়ারিতে ৬১২ কোটি, ফেব্রæয়ারিতে ৬৪১ কোটি, মার্চে ৭১৫ কোটি, এপ্রিলে ৭৮৮ কোটি, মে মাসে ৭৫০ ও জুনে ৭৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছর ব্যয় বাড়বে মোট ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। এতে ১৭ মাসে চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত ব্যয় বাড়বে মোট ১২ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। এখানে উল্লেখ্য, গ্যাস সরবরাহ হ্রাস বা বৃদ্ধি করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও কমে বাড়ে।
এ বিষয়ে পিডিবির সদস্য (অর্থ) সেখ আকতার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। দাম বাড়ার কারণে আমাদের ঘাটতি ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, ঘাটতি কমাতে দুটি উপায় আছে। একটি হলো মূল্য সমন্বয় করা এবং অন্যটি হলো সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেওয়া। এখন সরকারই ঠিক করবে কীভাবে এই ঘাটতি মোকাবিলা করবে। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন