শীত মানেই ঠোঁট ফেটে যাওয়া, ঠোঁটে খসখসে হয়ে থাকে। ফলে হাসতে গেলে ঠোঁটে চাপ পড়ে ও ফেটে গিয়ে রক্ত বের হয়। এতে ব্যথা হয় ও অস্বস্তি লাগে। আর তাই দেখা যাচ্ছে শীতের শুষ্ক ও ঠান্ডা আবহাওয়ার প্রভাব শুধু শরীরের ওপরই পড়ে না, ঠোঁটের ওপরও পড়ে ভীষণভাবে। এতে এ সময় শিশু, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই ঠোঁট শুষ্ক থাকে এবং ঠোঁট ফাটতে শুরু করে। অনেকের আবার শুধু শীতকালই নয়, সারা বছরে ঠোঁট শুষ্ক থাকে ও ফাটে।
ঠোঁট ফেটে যাওয়া কোনো হতাশাজনক ঘটনা নয়। তবে অনেকেই ঠোঁট ফেটে যাওয়াকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না। তারা ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন মনে করে। আবার অনেকেই ঠোঁট ফেটে যাওয়া বন্ধ করতে ঠোঁটের আলাদা যতœ নিতে শুরু করেন, যার বেশীরভাগই বিফলে যায়।
কিছু মানুষ যারা মনে করে শুধুমাত্র শীতে চামড়ার শুষ্কতার জন্য বুঝি ঠোঁট ফাটে। তারা বারবার জিহŸা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রাখেন। কিন্তু এতে ঠোঁট ফাটা বন্ধ হয় না, বরং আরও বাড়ে। তাই ঠোঁট ফেটে যাওয়ার আসল কারন জানতে হবে, তারপর ঠোঁট ফাটা বন্ধের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
সিবেসিয়াস গ্রন্থি নামক আণুবীক্ষণিক এক্সক্রাইন গ্রন্থি রয়েছে আমাদের ত্বকে বা চামড়ায়। যা থেকে একধরনের তৈলাক্ত বা মোমের মত রস ক্ষরিত হয় যাকে বলে সিবাম, যা আমাদের ঘামের সাথে মিশে পুরো চামড়ায় ছড়িয়ে যায় এবং চামড়াকে মসৃণ, নরম ও পানি রোধী রাখে। এর ফলে চামড়া ফাটে না।
কিন্তু শীতকালে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যাবার ফলে আমাদের ঘাম কম হয়। এ কারনে সিবেসিয়াস গ্রন্থি থেকে বেরিয়ে আসা তেলতেলে পদার্থ শরীরের চামড়ায় ঠিকমতো ছড়িয়ে পড়তে পারে না। শরীরের শুকনো জায়গাগুলো তখন শক্ত হয়ে কুঁচকে গিয়ে ফেটে যায়। শরীরের অন্য জায়গার তুলনায় আমাদের ঠোঁটের চামড়া পাতলা। তাছাড়া ঠোঁটের অবস্থান নাকের ঠিক নিচে থাকার জন্য নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসা গরম বাতাস ঠোঁট দুটোকে আরও শুকিয়ে দেয়। যার ফলে শরীরের অন্য জায়গার তুলনায় ঠোঁট বেশী ফাটে।
ঠোঁট ফাটার অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে ঠোঁট ও শরীরে আর্দ্রতার ভারসাম্যের অভাব। শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে বলে ঠোঁট আর্দ্রতা হারায় খুব তাড়াতাড়ি। খেয়াল করে দেখবেন, কোনো কারণে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়লে যে কোনো ঋতুতেই ঠোঁট ফেটে থাকে আমাদের। শীতের আগের মৌসুমী ঠান্ডা হাওয়া ছায়াও আরও কিছু বিষয় আছে, যা ঠোঁট ফাটাকে ত্বরান্বিত করে বা বাড়িয়ে দেয়। যেমন বারবার জিব দিয়ে ঠোঁট চাটার অভ্যাস, পুষ্টিহীনতা ও ভিটামিনের অভাব, প্রখর সূর্যের তাপ ও পানিশূন্যতা, বিভিন্ন প্রকার ওষুধ সেবন।
*শীতে ঠোটের যতœঃ
শীতে শুষ্ক হয়ে পড়ে ত্বক ও ঠোঁট। শুষ্ক ঠোঁট হারায় সজীবতাও। তাই এ সময় ত্বকের যতেœর পাশাপাশি ঠোঁটের জন্যও চাই বিশেষ যতœ। ‘ঠোঁট ফাটার কারণ হচ্ছে ঠোঁট ও শরীরে আর্দ্রতার অভাব। শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে বলে ঠোঁট আর্দ্রতা হারায় খুব তাড়াতাড়ি। তাই প্রয়োজন ঠোঁটের যতœ নেওয়া। ’ ‘ফাটা ও অপরিষ্কার ঠোঁট নিজেরও অস্বস্তির কারণ। একটু খেয়াল রাখলে এবং সামান্য যতœ নিলেই এ সময় ঠোঁট সুন্দর রাখা যায়।
প্রচুর পানি পান করুন।
প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে বেরোবেন না, বিশেষ করে যখন ঠান্ডা বাতাস থাকে অথবা খুব তীব্র শীত পড়ে, তখন ঘরে থাকতে চেষ্টা করুন।
বাইরে গেলে মুখের উপরিভাগে স্কার্ফ বা কোনো কাপড় ব্যবহার করতে পারেন; যা আপনার ঠোঁটকে শীতের হাওয়া থেকে আড়াল করে রাখে।
কখনোই জিহŸা দিয়ে ঠোঁট ভেজাবেন না, আলোর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ঠোঁটকে বাঁচাতে লিপবাম ব্যবহার করতে পারেন।
আর্দ্রতাকারক যন্ত্র হিউমিডিফায়ার ব্যবহার পারেন। কারণ, শীতে ঘরের ভেতরটাও শুষ্ক থাকে। হিউমিডিফায়ার আপনার ঘরের আর্দ্রতা ফিরিয়ে দেবে।
ফাটা ঠোঁটের আর্দ্রতা ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন। চেষ্টা করুন ফাটা ঠোঁটকে যতটা সম্ভব আর্দ্র রাখতে।
ঠোঁট ফাটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত শুষ্ক বাতাস থেকে ঠোঁটকে সুরক্ষিত রাখুন।
ফাটা ঠোঁটে কখনো কখনো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে, তাই ঠোঁট ফাটার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
নিয়মিত ঠোঁটে ময়েশ্চারাইজার লাগাবেন। শীতকালে পানি যেমন কম খাওয়া হয়, মুখও কম ধোয়া হয়। তাই কথা বলার সময় অনুভব করেন, আপনার ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে। যখনই এমন অনুভব করবেন, তখনই ঠোঁটে ময়েশ্চারাইজার লাগাবেন।
বাইরে বেরোলে সঙ্গে লিপবাম রাখতে পারেন। শীতে বাইরে গেলে ঠোঁট বেশি ফাটে এবং ঠোঁটে ধুলাও লেগে যায়। তখন মাঝেমধ্যে ঠোঁট একটু ধুয়ে নিয়ে লিপবাম লাগিয়ে নিন। ঠোঁট ধোয়ার সুযোগ না পেলে প্রথমে একটু লিপবাম লাগিয়ে সেটি মুছে ফেলুন। এতে আপনার ঠোঁট পরিষ্কার হবে। তারপর আবার লিপবাম লাগান।
মহিলারা লিপস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ময়েশ্চারাইজারযুক্ত লিপস্টিক বেছে নিন। যদি ম্যাট লিপস্টিক লাগাতেই চান, সেক্ষেত্রে সম্ভব হলে প্রথমে তুলা বা টিস্যুর সাহায্যে সামান্য একটু লিপবাম ঠোঁটে লাগিয়ে নিন এবং তারপর লিপস্টিক লাগান।
শীতে অনেকের ঠোঁট কালো হয়ে যায় এবং খুব বেশি ফেটে যায়। তারা ঘরোয়া পদ্ধতিতেই নিতে পারেন বাড়তি যতœ। গোলাপের পাপড়ির সঙ্গে মধু বা মাখন মিশিয়ে ঠোঁটে লাগিয়ে রাখুন সারা রাত।
ঠোঁটের গড়ন মোটামুটি চার ধরনের। পুরু ঠোঁট, পাতলা ঠোঁট, চওড়া ঠোঁট আর ছোট ঠোঁট। এই মৌসুমে ঠোঁটে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। কখনো ঠোঁট ফাটে, কখনো বা কালচে ভাব চলে আসে। ঠান্ডার কারণে নাক বন্ধ থাকে। এ কারণে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। ঠোঁট ফাটলে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস কম নিতে হবে। তাহলে ঠোঁট ফাটা কমে যাবে। ঠোঁট ফাটলে অনেক সময় ত্বকের মরা অংশ জমে থাকে ঠোঁটের ওপর। এটা আটকাতে রাতে ঘুমানোর সময় বাদাম তেল লাগাতে হবে ঠোঁটে। মরা অংশ কখনোই টেনে তোলা যাবে না।
ঠোঁট কালচে হয়ে গেলে সেটাও হালকা করার উপায় আছে। এক টেবিল চামচ গোলাপের পাপড়ির পেস্ট আর এক টেবিল চামচ গিøসারিন এই সমস্যার সমাধান এনে দেবে। নিয়মিতভাবে ঠোঁটে মাখলে কালচে ভাব দূর হয়ে হালকা গোলাপি আভা চলে আসবে। মিশ্রণটি বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন। মাখনের সঙ্গে জাফরান মিশিয়েও ঠোঁটে লাগাতে পারেন। এতে করে লালচে আভা চলে আসবে ঠোঁটে। ঠোঁটকে মসৃণ রাখতেও সাহায্য করবে। খুব বেশিক্ষণ ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে রাখা উচিত না। সব সময় ভালো ব্র্যান্ডের লিপস্টিক ব্যবহার করবেন।
শাক-সবজি, ফলমূল খান পর্যাপ্ত: শীতকাল মানেই শাক-সবজি ও ফলমূহের সমাহার। এই ঋতুতে বাজারে থাকে নানারকম ফলমূল ও শাক-সবজি। আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে শাক-সবজি ও ফলমূল থাকতে হবে। কারণ প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণের অভাবেও ঠোঁট ফ্যাকাশে বা কালচে হয়ে যেতে পারে। দিনে দুইবার ফল এবং তিনবার কয়েকরকম শাক-সবজি খেতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, শীতকালে ত্বক ও ঠোঁটের বাড়তি যতœ নিতে হয়। ত্বক ও ঠোঁটের সুস্থতার জন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ও পর্যাপ্ত ঘুমানো দরকার। কখনও কখনও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার দরকার হতে পারে। ওপরের টিপসগুলো খেয়াল করার পরেও যদি প্রতিকার না পান তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যান।
কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল: drmazd96@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন