ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই বিচারকের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ ও আইনজীবীদের কর্মবিরতির কারণে আদালত পাড়ায় টানা কয়েক দিন যে অচলাবস্থা চলেছে, একে কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বিচ্ছিন্ন বা আঞ্চলিক ঘটনা বলা যায় না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতের জেলা জজসহ দুই বিচারকের অপসারণ ও নাজিরের শাস্তির দাবিতে আইনজীবীরা কর্মবিরতিসহ কী না করেছেন? কী সব ভাষা ও আচরণ না দেখিয়েছেন? এজলাস চলাকালে বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে আইনজীবীদের আচরণ ও ভাষার কয়েক মিনিটের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারাদেশের মানুষের দেখা হয়েছে। এতে যে যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন।
এক পর্যায়ে দেশের এই আলোচিত বিষয়টি গড়ালো উচ্চাদালতে। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ তিন আইনজীবীকে দেয়া হয় আদালত অবমাননার রুল। এরপর ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজিরা। দিনটিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ও বাক্য বাংলাদেশের বিচারালয়ের ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে থাকবে। আদালত বলেছেন, ‘ওই বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীরা যে আচরণ করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে বিচার বিভাগ ও আইন-আদালত বলে কিছু থাকবে না। সবাই মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আগুন না থামালে আমাদের সবাইকে জ্বলতে হবে।’
কেবল উপরোক্ত তিনটি বাক্যের মাঝে যে বেদনা ও শঙ্কার কথা বলা হয়েছে, বিবেকবান যে কারো জন্য এতে ভাবনার অনেক উপাদান রয়েছে। তবে, একে ‘বাত কা বাত’ কথা বা ‘এমন কথা তো কতোই শুনেছি’ মনে করলে সমস্যাই নেই। কারণ ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। সেখানকার এমপি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি আবার একজন আইনজীবীও। তার বাবা মরহুম অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকও ছিলেন বাংলাদেশের আইন ও বিচার অঙ্গনের তারকা ব্যক্তিত্ব।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলোচিত এই ঘটনার বিষয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দুই কথার তোড়ে সব ঠিকঠাক করে দিয়েছেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এজলাসে হট্টগোল, বিচারক ও আদালতের কর্মচারীদের ‘গালিগালাজ ও অশালীন আচরণকে ‘ভাইবোনের ঝগড়ার মতো’ বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় আইনমন্ত্রী কোনো কিছু ঠিক করে দিলে আর কিছু লাগে না। কিন্তু, কথার পিঠে কিছু কথা তো থেকেই যায়। বিচারক-আইনজীবী-আদালত-বিচার তথা আইন কি ভাইবোনের বা মাছ-সব্জি বাজারের কাইজ্জার বিষয়? এখন অবশ্য উকিল-বিচারক গোলমাল থেমে গেছে। আইনজীবীরা এখন সেখানকার আদালতে যাচ্ছেন। আদালতও চলছে। ভাবটা এমন, মানুষ মাত্রেরই টুকটাক গ-গোল তো হয়েই থাকে। ডেক-ডেকচিতে একটু টুংটাং শব্দ তো হয়ই। হাতের পাঁচ আঙুল তো এক সমান হয় না, এ ধরনের ‘জ্ঞানী’ কথা আমলে নিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাহলে তেমন কিছুই হয়নি। হয়ে থাকলেও মিটে গেছে।
স্বামী-স্ত্রী বা ভাই-বোন মিলে দল চালানো যায়। রাজনীতি বা দেশও চালানো যায়। কূটনীতিতেও এখন চালানো হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্কের কথা। কিন্তু সেটা বিচার বিভাগেও নিয়ে ঠেকালে আর বাকি থাকে কী? সাফাই গাওয়ার অন্তরালে এ ধরনের আস্কারা একটি দেশের বিচার ব্যবস্থাকে কোন তলানিতে নিয়ে যেতে পারে, তা বিবেকবান যে কারো জন্য উদ্বেগের। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ ফারুক আহমেদের সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অপসারণের নির্দেশও দিয়েছেন হাইকোর্ট। এরই মধ্যেই সংশ্লিষ্টরা এ অপসারণের কাজ হয়তো সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু, যারা সংরক্ষণ করে রেখেছেন তা কি সরানো যাবে? অথবা যেই লাখ-কোটি মানুষ ওই ভিডিও ফুটেজ দেখেছেন, গালমন্দগুলো শুনেছেন তাদের মনের হার্ডডিস্ক থেকে কি সরানো যাবে? বিচারকের সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনায় আদালত অবমাননার ব্যাখ্যার পরবর্তী তারিখ পড়েছে সামনের বিশ্বভালোবাসা দিবস ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। ওই দিন তিন আইনজীবী সশরীরে লিখিত ব্যাখ্যা দেবেন বলে ধার্য করা হয়েছে। যেখানে স্বয়ং আইনমন্ত্রী ‘ভাই-বোন’ তত্ত দিয়ে ফেলেছেন, সেখানে ব্যাখ্যার ভাষা-বর্ণনা কী হবে বা হতে পারে তা সাধারণ কা-জ্ঞানের মানুষ মাত্রই জানে। পাশাপাশি হাইকোর্ট কী রুলিং বা নির্দেশ দিতে পারে, এ নিয়েও আলোচনা আছে। চলছে কিছু বিশ্লেষণও।
যেমন, আদালত এ বিষয়ে রেফারেন্স পাবে কোথায়? বিশ্বের কোনো দেশে কোনো আদালত কক্ষে এ রকম ঘটনা কি ঘটেছে? না ঘটে থাকা মানে রেফারেন্সও নেই। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের আইন ও বিচারাঙ্গনের জন্য একটি মস্ত বোঝার মতো ঘটনাটি। তাদের নির্দেশনাই এখন গোটা বিশ্বের দেশে-দেশে রেফারেন্স হবে, যদি কোনো দেশের কোনো আদালত কক্ষে কোনো কালে এ ধরনের কা- ঘটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বার সভাপতিকে উদ্দেশ করে হাইকোর্ট উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, আপনি শুধু আইনজীবী নন, আপনি আইনজীবীদের নেতা। মানুষ যখন বড় পদে যায়, তখন আরও বিনয়ী হয়। তাঁর দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। এ সময় আদালতে পিন পতন নীরবতা থাকতে পারতো। কিন্তু, থাকেনি। বার সভাপতির পক্ষ নিয়ে তার আইনজীবী মোমতাজউদ্দিন বলে ওঠেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার সভাপতি নির্দোষ। তিনি আইনজীবী সমিতির সদস্যেদের পক্ষে কথা বলেছেন। এটা বারের সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে এটা করেননি।
তাহলে এই দশায় সাধারণ মানুষই বা কী বার্তা পেল? আদালতের উষ্মার জবাবে আইনজীবীরা এমন আচরণ সাধারণ মানুষ বা বিচারপ্রার্থীরা কী ভাবছেন? রাজনীতিকরা একে অন্যের সমালোচনা করতে গিয়ে পরস্পরের বহু কুকর্মের জানান দেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় আইনজীবীরা একেবারে কম করেননি। হাইকোর্ট কেন কেবল আইনজীবীদের তলব করলেন, বিচারকদের প্রতি কেন আদালত অবমাননার রুল জারি করলেন না, এ নালিশও এনেছেন তারা। বিচারকদের আচরণ ও ক্রিয়াকলাপ বলতেও ছাড়েননি তারা। এ সময় আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা উচ্চঃস্বরে ‘ঠিক ঠিক’ বলে ওঠেন।
এতো ঠিকের মাঝে আইন-বিচার ও আদালতের ভবিষ্যত পরিষ্কার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিচারক বিচার চেয়েছেন। এর আগেও অসদাচরণের শিকার বেশ ক’জন বিচারকও বিচার চেয়েছিলেন। কিন্তু এতে সবসময় আদালতে তলব করে দুর্বিনীত আইনজীবীকে তাদের সাথে সমঝে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আদালতে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে তারা হাসিমুখে বের হয়ে বেপরোয়া আচরণের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বিখ্যাত’ হয়েছেন। ঝালকাঠি, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর বা খুলনার ঘটনা অনেকের মনে আছে, যা আইন পেশার মানের নি¤œগামিতার সঙ্গে আরো নানান কিছু নির্দেশ করে। এটিকে আইনজীবীদের অতিমাত্রায় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার কুফলও বলছেন কেউ কেউ। আইন ও বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত অন্যরাও কিন্তু এর বাইরে থাকছেন না। টিআইবি একবার তাদের খানা জরিপে এদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়ে ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল। টিআইবির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিচার বিভাগ ‘সব চেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সার্ভিস সেক্টর’। সুপ্রিম কোর্ট ক্ষুব্ধ হয় এতে। সেই সময় বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব মিয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি বলেছিল, এই জরিপ সঠিক নয়। টিআইবি বলেছিল, এটা দৃষ্টিভঙ্গিগত একটি বিষয়। তবে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের মনোভাব কী, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বিচার বিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক সময় অল্পসংখ্যক বিচারকদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
বড় দামি কথার প্রকাশ ঘটেছে বিচারপতির উপরোক্ত বক্তব্যে। আইনজীবী, জজ-বিচারপতি মিলিয়ে সংখ্যা গুনলে নি¤œ আদালত বা উচ্চ আদালতে আপত্তিকর ব্যক্তি ‘অল্পসংখ্যক’ই হবেন। তাদের দায় কেন নেবে গোটা বিচার বিভাগ, সরকার এবং গোটা বাংলাদেশ? কিছু অভিযোগ-অনিয়মের পরও বিচার বিভাগ ডুবুডুবু নয়, নাক উঁচু করে না থাকলে আশার অবশিষ্ট ভরসাস্থল কোথায়? তাই হাইকোর্টের দেয়া শঙ্কা (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো ঘটনা অব্যাহত থাকলে বিচার বিভাগ ও আইন-আদালত বলে কিছু থাকবে না, এ আগুন না থামালে আমাদের সবাইকে জ্বলতে হবে) যেন অমূলক হয়, সেই আরাধনা কায়োমনবাক্যে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন