শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইসলামি ব্যাংকিং : পৃথক আইন জরুরি

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

দেশের অর্থনীতিতে ইসলামি ব্যাংকসমূহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। প্রচলিত ব্যাংকগুলোও দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আর গত চারদশকে ইসলামি ব্যাংকসমূহ তাদের সেবা ও আস্থা নিয়ে গ্রাহকদের মাঝে একটি মজবুত অবস্থা তৈরি করে নিয়েছে। ইদানিং ইসলামি ব্যাংক নিয়ে, ব্যাংকের আমানত, বিনিয়োগ এমনকি ব্যাংক দেওলিয়া হওয়ার গুজব, ব্যাংকের অর্থ পাচারÑ এসব বিষয় নিয়ে নানা খবর মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। কিছু সাধারণ গ্রাহক গুজবের কারণে ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে কিছু পদক্ষেপ ও বিবৃতি দিয়েছে। ফলে জনগণের মাঝে ক্রমান্বয়ে স্বস্তি ফিরে আসছে। তাছাড়া ব্যাংকিং খাতে নানা দুর্বলতা, খেলাপী ঋণ বৃদ্ধি, সুশাসন ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও কাঠামোগত দুর্বলতার বিষয়টিও রয়েছে বলে গবেষকগণ মনে করেন।
দেশের বর্তমানে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দেশে প্রথম ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে এর কার্যক্রম শুরু। প্রতিষ্ঠানটির সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশে গড়ে উঠেছে আরো শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। প্রচলিত ধারার কিছু ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিং ধারায় রূপান্তরিত হয়। অনেক ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডো চালু করেছে। গত চার দশকে ইসলামি ব্যাংকগুলো দ্রুত বিকশিত ও প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। দেশের ব্যাংক খাতে প্রায় ৩০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে ইসলামি ব্যাংকগুলো। যদিও এ পর্যন্ত ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জন্য কোনো আইন প্রণয়ন হয়নি। শুধু ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা একটি গাইড লাইন ও কিছু নির্দেশনার উপরে ভর করে এসব ব্যাংক এগিয়ে চলছে।
বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকগুলোর মোট আমানত ৪ লাখ ২১ হাজার ৩৭৫ কোটি, যা ব্যাংকের মোট আমানতের ২৭ শতাংশ। ইসলামি ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতে মোট বিনিয়োগের ২৯ শতাংশ। রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে ইসলামি ব্যাংকগুলো অনেক অবদান রেখে চলেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা মোট রেমিটেন্সের ৩৮ শতাংশ আসছে ইসলামি ব্যাংকের মাধ্যমে। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানত, মুনাফায় ও অপারেটিং বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। দেশের মোট বিনিয়োগের প্রায় ১২ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ ইসলামি ব্যাংকের। বৈদেশিক মুদ্রার শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। সারা বিশ^ থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আসে তার ২৯ শতাংশ আসে ইসলামি ব্যাংকের মাধ্যমে। বিশে^র সেরা ১০০০ ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশের এক মাত্র ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের নাম রয়েছে। পল্লী উন্নয়নেও ইসলামি ব্যাংকসমূহ কাজ করে যাচ্ছে।
দেশের কৃষি, শিল্প, কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন, বীজ-সার সরবরাহ, গার্মেন্ট খাতে ইসলামি ব্যাংকসমূহ অনন্য অবদান রেখে চলেছে। কর্মসংস্থান, গ্রামের দরিদ্র শ্রেণির মাঝে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বিতরণেও নানা আর্থিক সাহায্য ইসলামি ব্যাংকসমূহ কাজ করে যাচ্ছে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি ও উন্নতির অন্যতম কারণ হলো মানুষের আস্থা ও ব্যাংককর্মীদের কর্মতৎপরতা। ধর্মপ্রাণ মানুষ দিন দিন শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে। ধর্মীয় অনুভূতি, ব্যবসাবান্ধব বিনিয়োগ ইসলামি ব্যাংককে এগিয়ে নিচ্ছে। ইসলামি ব্যাংকের বিনিয়োগ কাঠামো পণ্য বেচাকেনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় এসব ব্যাংকের খেলাপীঋণও কম। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপস চালু ও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটিয়েও ইসলামি ব্যাংকসমূহ তাদের সেবা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে অবদান রাখাসহ সামাজিক কর্মক-ে যেমন গরিব মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান, দরিদ্রদের মাঝে বিভিন্ন সময় নানা সাহায্য প্রদান হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারা প্রবর্তন, ভারসাম্য এবং শোষণমুক্ত সমাজ ও সম্পদের সুষম বণ্টনের কাজ করার ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ইসলামী ব্যাংকসমূহ কাজ করে যাচ্ছে। তবে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের সঠিক সুফল যেমন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুষম বণ্টন, ক্ষুদ্র বিনিয়োগ গ্রাহকদের বেশি প্রধান্য দেওয়া, সঠিকভাবে শরিয়াহ পরিপালন, কর্মীদের মাঝে শরিয়াহ জ্ঞানের ঘাটতি, সর্বপরি গ্রাহকদের মাঝেও শরিয়াহভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার বিষয়ে এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে।
আইএমএফ’র মতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ১ হাজার ৬১ দশমিক ৫৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে ছিল ৯৬৬ দশমিক ৪৮৫ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতি এ প্রেক্ষাপটে দেশের ব্যাংকিং খাতের অবদান ও গুরুত্ব অনেক। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুঁজি সরবরাহের অন্যতম খাত হলো ব্যাংকিং খাত। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত সংকট দেখা দিলে মোট অর্থনীতির উপর এর ঋণাত্বক প্রভাব দেখা দেবে। এক্ষেত্রে ইসলামি ব্যাংকসমূহ যেহেতু আমানতের ২৭ শতাংশ বহন করছে, সেখানে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের সঠিক হেফাজত অর্থাৎ সঠিক স্থানে বিনিয়োগ করা উচিত। ইসলামি ব্যাংকিং খাতের সমস্যা দেখা দিলে গোটা অর্থনীতির উপরে এর প্রভাব দেখা দেবে। বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকিং দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। শরিয়াহভিত্তিক পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ফলে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোও শরিয়াহভিত্তিক কার্যক্রমে ঝুঁকছে। বিগত চার দশকে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের দ্রুত বিকাশ ঘটলেও পূর্ণরূপে জনকল্যাণ বা মানুষের উপকার হচ্ছে না। ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার সুফল সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শুধু ইসলামি ব্যাংকিংকে সুনির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে রাখলে চলবে না। তার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। জাকাত, সুদ মুক্ত অর্থায়ন, ওয়াকফসহ সমাজকল্যাণমূলক ইসলামি টুলসের ব্যবহার ও ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ৩০ শতাংশ ইসলামি ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ করলেও ইসলামি ব্যাংকিংয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকাটা দুঃখজনক। ২০২০ সালে সুকুক নামে একটি ইসলামি বন্ড চালু হলেও আর কোনো প্রোডাক্ট তৈরি হয়নি। এই ব্যাংকগুলোর আমানতের সুরক্ষা ও বিনিয়োগের ঝুঁকি কমানোর জন্য রক্ষা কবজগুলো দুর্বল। আমানত ও বিনিয়োগের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করলেও সঙ্কট মোকাবেলায় কোনো টুলস নেই। তারল্য সঙ্কটে পড়লে ইসলামি ব্যাংকগুলো কলমানি বাজার থেকে প্রচলিত ধারার মতো ধার করতে পারে না। প্রচলিত ব্যাংকগুলো রিভার্স রেপো ও ট্রেজারি বিল বন্ড ক্রয়ের মাধ্যমে অলস তারল্য নিরাপত্তার সুযোগ পেলেও ইসলামি ব্যাংকগুলো এই ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ইসলামি ব্যাংকিংয়ের আমানত ও বিনিয়োগের নিরাপত্তার জন্য সুনির্দিষ্ট ইসলামি ফাইন্যানসিয়াল টুলস প্রণয়ন করা উচিত। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার মতো জনপ্রিয় এই ব্যাংকিংয়ের সুফল পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা থাকা উচিত। পাশাপাশি শরিয়াহ কার্যক্রম তদারকি করার জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শরিয়াহ বোর্ড থাকা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ইসলামি ব্যাংকসমূহের কর্মকর্তাদের শরিয়াহ পরিপালন বিষয়ের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত।
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মূলনীতির উন্নতম ভিত্তি হলো পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ২৭৫-২৭৭ নং আয়াত। এখানে বলা হয়েছে, ‘যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তির ন্যয়, যার উপর শয়তান ভর করে। এটা এই জন্য যে, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয়তো সুদের মতো। অথচ, আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন’। অর্থাৎ ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মূলনীতি হলো হারাম থেকে দূরে থাকা ও শরিয়াহ সম্মত ব্যবসা করা, সম্পদের সুষম বণ্টন করে জনকল্যাণ করা। এশিয়ান ডেভোলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ^ব্যাপী ইসলামি ব্যাংকিং জনপ্রিয়তা দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ^ব্যাপী ইসলামিক ফাইন্যান্সের আকার ২ দশমিক ৮৮ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মুসলিম দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, হংকং, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। পৃথক আইনও রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে পৃথক আইন থাকা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
main706@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন