শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

ব্যতিক্রমী এক মাওলানা

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) কেবল মাত্র একজন ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা কঠিন সাধনার বিষয়। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) সাধনায় সিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠানে উত্তীর্ণ করেছিলেন। তাঁর মতো কর্মযোগী মাওলানার সাক্ষাৎ আমাদের দেশে কমই পাওয়া যায়। ৭১ বছরের জীবনসীমায় তিনি আমাদের জাতীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। রাজনীতি, শিক্ষা, ধর্মচর্চা, সমাজকল্যাণ, সংবাদপত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর বিপুল অবদান রয়েছে।
তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষক হিসেবে। প্রথমে মাদরাসার মুহাদ্দিস, পরে প্রিন্সিপাল। শিক্ষক হিসেবে ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে অভূতপূর্ব সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। তার অনেক ছাত্র ও সহকর্মী এখনও তা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, সমাজের জন্য আরও বেশি করে ভূমিকা রাখতে হলে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া দরকার। তিনি যোগ দিয়েছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। কয়েক দশকের রাজনৈতিক জীবনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দলীয় নেতৃত্ব ছাড়াও একাধিক মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি বিরল কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন।
তিনি মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। মাদরাসার শিক্ষক ও প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা কত অবহেলিত, এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কতটা উপেক্ষিত। এই শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবস্থা এবং অবস্থানের পরিবর্তন সাধনকে তিনি তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মাদরাসা শিক্ষকদের সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং অচিরেই তাঁর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বগুণের বদৌলতে এই সংগঠন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংগঠনে পরিণত হয়। তিনি এই সংগঠনের মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন এবং এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবস্থানগত উন্নতির জন্য দুর্বার গঠনমূলক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর আন্দোলনের সুফল হিসেবেই বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষা তার কাক্সিক্ষত মর্যাদা অর্জন করেছে এবং এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ পেয়েছেন। আমাদের শিক্ষা ও সামাজিক ইতিহাসে তার এ অবদান অনাগত বহুকাল কীর্তিত হতে থাকবে। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন কিংবা তুলতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন। তার এই কীর্তিকর্মের মধ্যে রাজধানীর মহাখালীতে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক স্থাপত্য কলার অপূর্ব নিদর্শন মসজিদে গাউসুল আজম ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কমপ্লেক্সের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ইসলামিক শিক্ষা ও ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দিকদর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
আজ দেশে ইসলামী শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা গুরুতর হুমকিতে। উপমহাদেশ ও এই বাংলাদেশে মুসলিম ইতিহাস বিকৃত ও ধিকৃত করার অপচেষ্টা চলছে পাঠ্যপুস্তকে। এ সময় বেঁচে থাকলে প্রতিবাদে গর্জে উঠতেন, আন্দোলন গড়ে তুলতেন। তিনি যে এখনো প্রাসঙ্গিক, বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি ও অবদান দৈনিক ইনকিলাব। সংবাদপত্রের ভূমিকা, গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাবের কথা বিবেচনায় রেখে বহু আগেই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশের। তিনি উপলব্ধি করেছিলেনÑ ইসলাম, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং নিজস্ব সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী মুখপত্র দেশে প্রয়োজন। তাঁর এ স্বপ্ন ও প্রত্যাশার বাস্তবায়ন ঘটে ১৯৮৬ সালে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সংবাদপত্র দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশিত হয় সে বছর। তিনি দৈনিক ইনকিলাবের ব্যাপারে ছিলেন খুবই স্পর্শকাতর এবং আমরা এই পত্রিকায় যারা কাজ করি তারা সবসময় তার অভাব অনুভব করি। আদর্শের নৈরাজ্য ও অবক্ষয় প্রতিরোধ করে মানবতায় ইনকিলাব চায় দৈনিক ইনকিলাব। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)ও তাই চাইতেন। এখনো ইনকিলাব তার ঘোষিত নীতি, আদর্শ, লক্ষ্য ও অভিপ্রায় সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) মাওলানা হয়েও ছিলেন আলাদা ধরনের মাওলানা। তাঁর সুনির্দিষ্ট মিশন ছিল, ভিশন ছিল। তিনি তাঁর মিশন-ভিশন বাস্তবায়নে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর জীবন সংগ্রামের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে এ সত্য সহজেই অনুধাবন করা যায়। তাঁর জীবন চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তাতে নানা ঘাত-প্রতিঘাত ছিল, চড়াই-উতরাই ছিল। কিন্তু প্রবল আত্মবিশ্বাসী এই মানুষটির সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করার দুর্বার শক্তি ছিল। এই শক্তি তাকে নিরন্তর সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তাঁর আদর্শ, বিশ্বাস ও মানবকল্যাণ চিন্তা থেকে তিনি শেষ দিন পর্যন্ত সরে আসেননি। এরকম মিশনারি চেতনায় উজ্জীবিত নিরাপস মানুষ আমাদের এই দেশ ও সমাজে এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের শাসক, সরকার প্রধানদের সঙ্গে তাঁর ছিল অকৃত্রিম সখ্য। সউদী বাদশাহ, ইরাকের প্রেসিডেন্ট, আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট প্রমুখের সঙ্গে তাঁর ছিল সুহৃদসম্পর্ক। তিনি কার্যত ছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে সম্মানিত দূত। বাংলাদেশের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্কোন্নয়নে তাঁর রয়েছে অবিস্মরণীয় অবদান।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এক সফল পুরুষের প্রকৃতি। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। মাওলানা রূহুল আমীন খান তার এক প্রবন্ধে তাকে ক্ষণজন্মা প্রতিভা বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর প্রতিভার আলোক বিচ্ছুরণে আমাদের জাতীয় ও সামাজিক জীবনের অনেক দিক আলোকিত হয়েছে। মুসলিম বিশ্ব বা বিশ্বমুসলিম উপকৃত হয়েছে। তাঁর এই বিভিন্নমুখী অবদান যুগ যুগ ধরে স্মরিত ও উচ্চারিত হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন