প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, আধ্যাতিকতায় পরিপূর্ণ উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ও দেশের মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের পেশাজীবী অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর আজ ১৭তম ইন্তেকালবার্ষিকী। ইন্তেকালবার্ষিকীর এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাঁকে। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতায় দ্বীনি শিক্ষাসহ দেশের ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুন সমুন্নত হয়েছে। তার প্রতিটি কর্ম জাতীয় জীবনে মাইলফলক হয়ে আছে। সারাটি জীবন তিনি দেশ, জাতি, শিক্ষা ও ধর্মের সেবায় অতিবাহিত করে গেছেন। যৌবন থেকে বার্ধক্য, জীবনের প্রতিটি বাঁকে ও স্তরে নানা মহৎ কর্মে, নানা পরিচয়ে তিনি নিজেকে সমুজ্জ্বল ও ভাস্বর করে গেছেন। তাঁর জীবন ও অবদান সম্পর্কে স্বল্পপরিসরে বর্ণনা করা অসম্ভব। তদুপরি কিছু কথা না বললেই নয়। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের জন্ম ১৯৩৭ ইংরেজিতে হলেও ১৯৭৬ সালে মাওলানা এম এ মান্নান সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সাংগঠনিভাবে এর দৃঢ় ভিত্তি রচিত হয়। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে এ দেশের চিরঅবহেলিত মাদরাসা শিক্ষা জাতীয় শিক্ষার অন্যতম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তাঁর অব্যাহত চেষ্টায় মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীগণ জাতীয় পেস্কেলের আওতায় আসে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে তাঁরই নেতৃত্বে ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠা হয় দেশের সর্বপ্রথম ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে দেশের আলীয়া নেসাবের মাদরাসাসমূহের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ও তারই স্বপ্নের বাস্তবায়ন। মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে, শিক্ষকদের মান উন্নয়নের প্রয়াসে আমরা পেয়েছি স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, স্বতন্ত্র মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় বেতন স্কেলসহ উন্নত জীবনযাত্রা। সুবিধা বঞ্চিত বেসরকারি মাদরাসা শিক্ষকগণ আজ যে সম্মানের আসনে আসীন হয়েছেন তা মরহুম মগফুর মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর অবদান। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসেবে দেশের মাদরাসা শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষক সমিতির নেতা হিসেবে শিক্ষকদের আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি যে ভূমিকা ও অবদান রেখে গেছেন তার তুলনা বিরল। তিনি শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর উন্নয়নের প্রয়োজনে সকল সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধ করে গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন, যার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফসল বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেল। তিনি দলমত নির্বিশেষে সকল আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ফলে আলীয়া, কওমিসহ সকল স্তরের আলেম-ওলামা সুদিনে-দুর্দিনে ছুটে আসতেন তাঁর সান্নিধ্যে। উত্তম আতিথিয়তা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণে সকলকেই মুগ্ধ করতেন তিনি।
মাওলানা এম এ মান্নান হুজুরের স্বপ্ন ছিল মাদরাসার শিক্ষার্থীগণ খাঁটি ওয়ারেছাতুল আম্বিয়া হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করবে। তাঁর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাঁরই সুযোগ্য জেষ্ঠ্য পুত্র আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে চলছে। আজ বাংলাদেশের সকল উপজেলা, জেলা, মহানগরী ও জাতীয় পর্যায়ে সংগঠনের ঐক্য-সংহতি সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়। সকল ভেদাভেদ ও ইখতিলাফ ভুলে গিয়ে সর্বস্তরের শিক্ষক-কর্মচারী জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছেন আন্তরিকতার সাথে। শিক্ষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে তিনি দেশ-বিদেশে বহু সেমিনার ও সভায় অংশ নিয়েছেন। অনেক শিক্ষক নেতা ও আলেম-ওলামাসহ সরকারি কর্মকর্তাকে পবিত্র হজ্জব্রত পালনের ব্যবস্থা করে প্রকৃত মুমিন হিসেবে অনেককেই গড়ে তুলেছেন।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পর্যায়ক্রমে শিক্ষা, ধর্ম, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৮৮ সালে স্মরণকালের ভয়াবহতম বন্যা ও দুর্যোগের সময় তিনি ধর্ম এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেম ও চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি সারাবিশ্বে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। তাঁর এই পরিচিতি, খ্যাতি ও যোগাযোগদক্ষতা কাজে লাগিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ সাহায্য-সহযোগিতা আদায় করতে সক্ষম হন, যা বন্যাপীড়িত মানুষের কল্যাণ ও পুনর্বাসনের নিমিত্বে ব্যয় হয়।
মাওলানা এম এ মান্নান হুজুরের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মধ্যে আরো একটি হচ্ছে আধুনিক ছাপাখানা ও দৈনিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করা। যখন দেশে ইসলাম ও মুসলমানদের সংবাদ, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কাব্য, রচনা, মুসলিম মনীষীদের জীবনী পর্যালোচনা, কুরআন-হাদিসের আলোকে জীবনদর্শন সম্পর্কে জানার জন্য কোনো গণমাধ্যম ছিল না, ঠিক তখন হুজুর প্রতিষ্ঠা করলেন ‘দৈনিক ইনকিলাব’, যা অল্প দিনেই মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। শুধু দেশ ও জনগণের পক্ষে সংবাদ প্রকাশের কারণে আজও দৈনিক ইনকিলাব তাঁর একক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সমুন্নত রয়েছে। হুজুরের অনন্য সৃষ্টির মাঝে আর একটি হলো মহাখালীস্থ বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও মসজিদে গাউছুল আজম বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) কমপ্লেক্স। তৎকালীন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সহযোগিতায় বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর ওয়াকফ স্টেটের অর্থায়নে ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের সুদৃষ্টিতে হুজুর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ কমপ্লেক্স। সেখানে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এসে নামাজ আদায় ও বিভিন্ন ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। বিশেষ করে জুম্মার সালাত পূর্বে বিষয়ভিত্তিক খুতবা সকলকে করে তৃপ্ত। দৃষ্টি নন্দন এ কমপ্লেক্সের পার্শ্বেই হুজুর তাঁর সহধর্মীনিসহ চির নিদ্রায় শায়িত।
হুজুরের প্রাণপ্রিয় সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইনকিলাব নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশ-জাতির খিদমতে কাজ করে যাচ্ছে। তাঁর সুযোগ্য পুত্র এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতায় জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের দীর্ঘ সংগ্রাম ও প্রচেষ্টায় ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ মাদরাসা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেক দাবি আদায় হয়েছে। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর একটি বড় স্বপ্ন ছিল এই ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখন বাস্তব রূপ পেয়েছে। দৈনিক ইনকিলাবও তার দেখানো পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। দেশ ও জনগণের পক্ষে দৈনিক ইনকিলাব নির্ভীক ও আপসহীন। তার প্রতিষ্ঠিত সকল প্রতিষ্ঠান দেশ-জাতির কল্যাণে আগামীতেও একই অবদান রেখে যাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। হুজুর ইল্ম, আকিদা, বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ছিলেন আপোসহীন। শিক্ষার্থীদের আদর্শবান, সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে তিনি সর্বদাই সচেষ্ট থাকতেন।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর মতো বিদ্বান, দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও কর্মীপুরুষ বাংলাদেশে খুব বেশি জন্মাননি। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাঁর মতো সর্বদর্শী, দেশ-জাতিপ্রেমী মানুষ এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। দেশ সব দিক দিয়েই এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে একটা দুঃসময় চলছে। বিভেদ, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, অপরিণামদর্শিতা, হটকারিতা দেশকে একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ মুহূর্তে তাঁর মতো মানুষের খুবই প্রয়োজন। আজ হুজুর নেই কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর বহু কর্ম ও অবদান। আছে লক্ষ লক্ষ নিবেদিতপ্রাণ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন নেতাকর্মী, আছে তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরীগণ। এ বিশাল বাহিনী ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস নিলে একটি সুখী সমৃদ্ধ ইসলামী আকিদানির্ভর সমাজ গঠনে বিরাট অবদান রাখতে পারে। হুজুরের ইন্তেকালবার্ষিকীর এ দিনে আমরা তাঁর রূহের মাগফিরাত ও জান্নাতের উচ্চমাকাম কামনা করছি।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন