মাওলানা আব্দুল মান্নানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল ধৈর্যশীলতা ও শান্ত স্বভাবের দৃষ্টান্ত। তাকে প্রতিকূল পরিবেশেও কখনো ক্রুদ্ধ ও রাগান্বিত হতে দেখা যায়নি। কোনো প্রকার হামলায়ই তিনি বিচলিত হতেন না। অত্যন্ত শান্তভাবে যুক্তির সঙ্গে তিনি অবস্থার মোকাবিলা করতেন। মাওলানা আব্দুল মান্নানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় কখন হয়েছিল, তা মনে নেই। প্রথম পরিচয়ের সময় তিনি যে এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হবেন, সে ধারণা আমার হয়তো হয়নি। কিন্তু পরিচয়ের পর বহু বছর পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। বহু সময় দ্বিমত এবং তর্ক-বিতর্ক হতো। কখনও বিবাদ হয়নি।
আমি ছিলাম মাওলানা আব্দুল মান্নানের গুণমুগ্ধ সমালোচক। আমার সমালোচনার সঙ্গে তিনি দ্বিমত পোষণ করেছেন, কিন্তু কখনও ব্যথিত এবং আহত হয়েছেন মনে হয়নি। বরং আমার এমন একটি অনুভূতি ছিল যে, আমি তার যতই সমালোচনা করি না কেন, তিনি আমাকে ভালবাসতেন। আমাকে আপন মনে করতেন। ভিন্নমত পোষণকারী এবং সমালোচনাকারীকে ভালবাসা যদি মহত্বের একটি পরিচয় হয়, তবে মাওলানা আব্দুল মান্নান ছিলেন অবশ্যই একজন মহান এবং মহৎ ব্যক্তিত্ব।
মাওলানা আব্দুল মান্নান ভিন্নমত, এমন কি সমালোচনা শুনতে চাইতেন। তার আর একটি সহজাত গুণ ছিল বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা। আমাদের সামাজিক পরিবেশে উদ্দেশ্য সাধন ও কাজ করিয়ে নেয়ার গুণাবলী তার ছিল। তার জীবনপথ মসৃণ ছিল না। ছিল বিপদসংকুল। চরম বিপদেও তিনি ধৈর্যহারা হতেন না। ছবরের সাথে বিপদের মোকাবিলা করতেন এবং বিজয়ী হতেন।
মাওলানা আব্দুল মান্নান (রহ.) সম্পর্কে ইতোপূর্বে আমার একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রবন্ধে ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার আলোকে তার ব্যক্তিত্ব আমার নয়ন পথে যেভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে তার প্রতি আমি কিছু ইঙ্গিত করতে চাই।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার: প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মাওলানা আব্দুল মান্নানের এক সংক্ষিপ্ততম সাক্ষাৎকারের ক্ষুদ্র একটি ঘটনা বয়ান করেন, সেখানে উপবিষ্ট চট্টগ্রামের ব্যারিস্টার সুলতান আহমাদ চৌধুরী। ব্যারিস্টার সুলতান আহমাদ এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন সুলতান আহমাদ চৌধুরী ছিলেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার, পরবর্তীতে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এবং আরও পরে পরিকল্পনা মন্ত্রী। ব্যক্তিগত সম্পর্কে ব্যারিস্টার সুলতান আহমাদ ছিলেন আমার ভায়রা। তিনি ছিলেন মাওলানা আব্দুল মান্নানের একজন গুণগ্রাহী ও বন্ধুসুজন। ব্যারিস্টার সুলতান আহমাদের উপস্থিতিতেই এ সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। হঠাৎ মাওলানা আব্দুল মান্নানের ডাক পড়ল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানে কক্ষে। প্রবেশ করার পর সালাম বিনিময় হলো। মাওলানা আব্দুল মান্নান বসতে অনুরুদ্ধ হলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অন্য কোনো কথা না বলে মাওলানা মান্নানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দন করলেন হালকাভাবে। তারপর সরাসরি বললেন, ‘বের করুন, বের করুন, তাড়াতাড়ি বের করুন। পকেটে কী আছে। মাওলানা সাহেব কথা না বলে একটি কাগজ বের করে মহামান্য প্রেসিডেন্ট সম্মুখে পেশ করলেন। এর মধ্যে কিছু লিখে কাগজটা মাওলানা মান্নানের হাতে ফেরত দিলেন। হয়তো কোনো অর্ডার লিখে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে মার্ক করেছেন।
তারপর উপবিষ্ট মাওলানা মান্নানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা, মাওলানা সাহেব! আপনার কি এমন কোনো ঘটনা মনে পড়ে, যেদিন আপনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, কিন্তু পকেট থেকে কোনো একটি কাগজ বা একাধিক কাগজ বের করেননি? মাওলানা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, না, মনে পড়ে না। প্রেসিডেন্ট বললেন, তাহলে বুঝা যায়, আপনি সব সময় কোনো একটি মতলব নিয়ে আমার কাছে আসেন। মাওলানা আব্দুল মান্নান বললেন, ঠিকই বলছেন। তারপর মাওলানা আব্দুল মান্নান অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মহামান্য প্রেসিডেন্টকে বললেন, মহামান্য প্রেসিডেন্ট! আপনার খেদমতে আমি সবিনয়ে একটি প্রশ্ন পেশ করতে চাই। আপনার কি মনে পড়ে, আমি কখনও এমন কোন কাগজ পকেট থেকে বের করেছি, যা আমার ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট? মাওলানা আব্দুল মান্নান বলে চললেন, আমি যত কাগজ অর্থাৎ দরখাস্ত নিয়ে আপনার কাছে এসেছি ওইগুলো ছিল কোনো মাদরাসায় অনুদানের জন্য দরখাস্ত অথবা অনুদান বৃদ্ধির জন্য। কোনো মাদরাসা শিক্ষকদের অথবা কোনো অলি-কামেলদের দরখাস্ত, যারা সহজে আপনার কাছে আসতে পারেন না। তারা আপনাকে না দেখেও আপনার জন্য দোয়া করেন। আমাদের দেশের ওলামায়ে কেরাম, অলি, কামেল নিমকহারাম নন। তারা আপনার মঙ্গলাকাক্সক্ষী মহামান্য প্রেসিডেন্ট! আপনি এবার বলুন, আমি ঠিক বলছি কি না?
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মৃদু হেসে বললেন, কথায় আপনাকে হারাবে এমন কারও সঙ্গে আমার এখনও পরিচয় হয়নি। এই বলে হেসে উঠে দাঁড়ালেন, মাওলানা আব্দুল মান্নানের দিকে বিদায়ের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
মাওলানা সাহেবের বুদ্ধিমত্তা: একদিন কোনো একটি বিষয়ে পরামর্শের জন্য আমি মাওলানা সাহেবের মহাখালী জমিয়াতুল মোদার্রেছীন অফিসে গমন করি। আমার কাজ ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। আমি তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক। সময় তখন, সাড়ে বারোটা কী পৌনে একটা। মাওলানা আব্দুল মান্নান আমাকে লাঞ্চের দাওয়াত দিলেন। আমি রাজি হলাম না। তিনি ছিলেন মেহমানদারীতে দরাজদিল এবং উদারহস্ত। আমাকে বললেন, এই ভরা দুপুরে না খেয়ে আপনি যেতে পারবেন না। আমাকে গোনাহগার করবেন না। আমি জানালাম, আমি আসার আগেই আপনাকে টেলিফোন করেছি। বলেছি, ১০-১৫ মিনিটে আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে। আপনি আমাকে খাওয়ার দাওয়াত করেননি। আমি আপনার মেহমানদারী কবুল করিনি। এখন আমার উপর আপনার কোনো হক নেই। আমি মুক্ত, স্বাধীন। মাওলানা আব্দুল মান্নান বললেন, ঠিক আছে লাঞ্চ করবেন না, চলে যাবেন। দু’তিন মিনিটের মধ্যে তিনি একটি টেলিফোন কানেকশন পেয়ে গেলেন। আমার শ্রদ্ধেয় এক সিনিয়র সচিবকে বললেন, স্যার, বহুদিন আপনি গরীব মাদরাসা শিক্ষকদের অফিসে পদধূলি দেয়ার সময় পাননি। আপনি দাওয়াত কবুল করেছেন। কিন্তু ব্যস্ততার জন্য আসতে পারেননি। আপনার স্টাফ থেকে একটু আগে জেনেছি, আপনি এয়ারপোর্টে যাবেন। ফিরতে হয়তো ৪টা বেজে যাবে। যাওয়ার পথে আপনি যদি এই গরীব মাদরাসা শিক্ষকদের অফিসে দশ পনেরো মিনিটের জন্য পদধূলি দেন- আপনার কোনো গোনাহ হবে না বরং আমাদের দোয়া পাবেন। আরও বললেন, আপনার কনিষ্ঠ সহকর্মী তার এক কাজে এখানে কদম মুবারক রেখেছিলেন। তার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় এক মিনিটও বসতে রাজি হচ্ছেন না। আপনি আসতে সম্মতি দিলে আপনার গুণমুগ্ধ এবং ভক্ত এ. জেড. এম. শামসুল আলম সাহেব আপনার সম্মানার্থে অপেক্ষা করবেন। আপনার অনুমতি পেলে আমি তার প্রতি আপনার দোয়া তাকে জানিয়ে দেব। তারপর টেলিফোন রেখে দিয়ে আমাকে জানালেন, আপনার শ্রদ্ধাভাজন সিনিয়র ব্যক্তি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আপনি যেন থাকেন। আমি একজন ম্যাসেঞ্জারের মতো তার হুকুম আপনাকে জানালাম। এখন দেখি আপনি কী করেন। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখলেও সুশৃংখল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আপনার সিনিয়রের হুকুম অবশ্যই রাখবেন। মাওলানা আব্দুল মান্নান ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, কুশলী আলেম।
ব্যতিক্রমধর্মী মেহমানদারী: মাওলানা আব্দুল মান্নান একবার আমাকে তার বাসায় দাওয়াত দিলেন। আরব অতিথির সংখ্যা দু’জন। বাঙালি অতিথি আমিসহ পাঁচ-ছয়জন। মেহমানদারী ব্যবস্থা অতি সহজেই ঘরের ভিতর হতে পারতো। সময়টা ছিল বিকালবেলা চা পানের, তার বনানী চার নাম্বার রোডের বাগানের লনে। লাঞ্চ বা ডিনারের সময় নয়। তবুও লাঞ্চ-ডিনারের উপযোগী বহু ভোজ্যদ্রব্য প্রস্তুত ছিল। পুরো একটা খাসি- আরবী স্টাইলে কাবাব করা। এর চারপাশে কয়েক গ-া মোটা মোটা গোটা মুরগীর কাবাব। নিচে বিরিয়ানী। তদুপরি ছিল সালাদ, বহু সংখ্যক ফল, মিষ্টি, দধি ইত্যাদি অনেক কিছু। আরব অতিথির মধ্যে প্রধান অতিথি ছিলেন ড. আব্দুল্লাহ উমর নাসিফ। কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ ভাইস চ্যান্সেলর। রাবেতা আল আলাম আল ইসলাম-এর সেক্রেটারি জেনারেল। পরবর্তীতে সৌদি মজলিশশূরা বা পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার। আমার জানা মতে, তিনি একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ আরব সন্তান। ব্যবহারে নম্র, অমায়িক, শিশুর মতো সরল। স্নিগ্ধ হাসি তার মুখে লেগেই থাকে।
বাংলাদেশে সুযোগ পেলেই আসেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের চেষ্টা করে থাকেন। এরূপ লোকের সম্মান ও ইজ্জত করা জাতীয় গৌরব ও সম্মান। মাওলানা আব্দুল মান্নান বলে চললেন, ড. আব্দুল্লাহ উমর নাসিফ অত্যন্ত শরীফ ব্যক্তি। রাজ পরিবারের আপন লোক। কথা বলেন কম, শোনেনে বেশি। খাওয়া-দাওয়ায় তার উৎসাহ কোনদিন লক্ষ করিনি। বেশি লোক ডাকিনি। কারণ, তাকে এককভাবে সম্মান দেখাতে চেয়েছি।
খাওয়া-দাওয়া তথা প্রধান মেহমান হিসেবে হাজিরা দেয়ার পর প্রধান মেহমান ড. আব্দুল্লাহ উমর নাসিফ বিদায় হলেন। আমাকে থাকতে বললেন মাওলানা সাহেব। তার ড্রয়িং রুমের পুরো দেয়ালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রতিফলিত ওয়াল ম্যাট। তখন ঢাকা শহরে ওয়াল ম্যাট অন্তত আমি অন্য কারো বাসায় দেখিনি।
লোকজন বিদায় হলো। আমি আর মাওলানা সাহেব একা। বললাম, আপনার টাকা পয়সা বেশি হয়েছে। টাকা বেশি হলে আমরা ইংরেজি শিক্ষিতদের হুঁশ থাকে না। আপনার দেখছি শয়তানের সাথেও ভ্রাতৃত্ব কায়েম হয়ে গেছে। মাওলানা আব্দুল মান্নান মুচকি হেসে বললেন, ইংরেজির মাধ্যমে ইসলাম শিখেছেন, ফতোয়া দিচ্ছেন। কিন্তু, ফতোয়া ও মাসায়েলের নীতিমালা তো ইংরেজি ভাষার ইসলামে নেই। আপনার ফতোয়া তো ভুল হয়ে গেল। বললাম, ফতোয়ার নীতিমালা এবং উসূল সম্পর্কে কিছু বয়ান করুন।
মাওলানা বললেন, আপনি তো অতিথির সাথে কথাই বেশি বলেছেন। আপনাকে দাওয়াত দিয়েছি সে জন্যই। এখন ফল খান। তারপরে কথা হবে। কথা শুরু করে বললেন, আরবগণ মেহমান দু’জন হলে ৫০ জনের খানা তৈয়ার করে। খাবার অপচয় করা তাদের জন্য হালাল হয়ে গেছে। আমরা তা করি না। কিন্তু তারা আমাদেরকে মিসকিন ভাবে।
আমি আজকে যে মেহমানদারীর ব্যবস্থা করেছি তা আমার মায়ের আত্মার ছওয়াবের নিয়তে মেহমানদারী। লক্ষ্য হলো সেটা। উপলক্ষ্য হলো একজন মহান আরব ড. আব্দুল্লাহ উমর নাসিফ। মেহমানদারীর অবশিষ্ট সবটুকু খাবার এখন চলে যাবে এতিমখানায়। কিছুই আমার ঘরে ঢুকবে না। কড়া আদেশ আছে। যারা খেদমতের কাজ করেছেন, তাদের শুধু কিছুটা খাওয়ার অনুমতি আছে। এবার বলুন, অপচয় কিছু করেছি কিনা। বহু আরব মনে করে, আমরা মেহমানদারী জানি না। আমি যখন আরবদের দাওয়াত দেই, তাদের উপলক্ষে ভালো আয়োজন করি। কিন্তু আমার লক্ষ্য থাকে আমন্ত্রিত উলামায়ে কেরাম এবং দ্বীনদারদের আপ্যায়ন করা। উলামায়ে কেরামের ঋণ কি আপনারা কখনও পরিশোধ করতে পারবেন।
এবতেদায়ী মাদরাসা ও ইনকিলাব: কারো কারো থেকে এমন একটা অভিযোগ শোনা যায় যে, মাওলানা মান্নান বাংলাদেশে বহু এবতেদায়ী মাদরাসার টাকা দিয়ে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেশে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে, এমন একটি কথা ছেড়ে দিলে তা যে কোনো একটি পত্রিকা অপেক্ষা বেশি চলে।
কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানায় আমাদের নিজ বাড়িতে একটি প্রাইভেট এবতেদায়ী মাদরাসা কয়েক বছর চলেছিল। এ মাদরাসার স্বীকৃতির জন্য তদবিরে আমার শ্রদ্ধেয় পিতৃব্য অধ্যক্ষ মরহুম আব্দুর রশীদ একটি দরখাস্ত নিয়ে মাওলানা মান্নানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আমি তাকে পরবর্তীতে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠার জন্য মাওলানা আব্দুল মান্নান কি তার কাছ থেকে কোন অনুদান বা শেয়ারের টাকা নিয়েছিলেন কিনা। তিনি আমাকে বলেছেন, মাওলানা মান্নান এক বছরের জন্য দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার গ্রাহক হতে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। আমি গ্রাহক হতে সম্মত হয়েছি। তবে যেহেতু এবতেদায়ী মাদরাসার তদবিরের জন্য তার কাছে গিয়েছি, তাই আমি স্বেচ্ছায় আমাদের গ্রামের এবতেদায়ী মাদরাসার নামে পত্রিকাটির গ্রাহক হয়েছি। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পত্রিকা মাদরাসায় পৌঁছত কিনা। পোস্ট অফিস আমাদের বাড়িতেই ছিল। দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা পোস্ট অফিসে যেত। কিন্তু মাদরাসার সাথে সংশ্লিষ্ট যারা উপস্থিত থাকতেন- তারাই পত্রিকাটি নিয়ে নিতেন। পড়ে কখনও কখনও মাদরাসার শিক্ষকদের দিতেন। কখনও বলতেন, বাড়িতে নিয়ে গিয়েছি, নিয়ে আসবেন। বেসরকারি এবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকেরা পত্রিকা পাঠে ততটুকু আগ্রহী ছিলেন না। তাদের থেকে গ্রামের অন্যান্যরা ছিল অনেক বেশি আগ্রহী।
নিজ বাড়িতে গৃহহীন: মাওলানা আব্দুল মান্নানের বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার ইসলামপুর গ্রামে। আমার মামার বাড়ি একই থানার সোল্লা গ্রামে। আমি মাওলানা আব্দুল মান্নাননের বাড়ি দেখার জন্যই ইসলামপুর হয়ে আমার মামার বাড়ি যাওয়ার প্রােগ্রাম করি। মাওলানা আব্দুল মান্নানের বাড়ির সম্মুখভাগে এবং আলীয়া মাদরাসার পেছনে একটি সুদর্শন ডাকবাংলো টাইপের অতিথি ভবনে আমাকে বসানো হয়। উক্ত ভবনে কয়েকটি বেডরুম আছে। বসার ঘর আছে। শয়ন কক্ষে পর্দার ব্যবস্থা আছে। ঘরটির সামনে পাকা উঠান। উঠানের শেষে মাওলানা সাহেবের পিতা মাওলানা শাহ ইয়াছিনের মাজার। মাজার জিয়ারত করার পর আমি তার বাড়ির অন্দর মহলে যেতে চাইলাম। আমাকে অন্দর মহলে নেয়া হলো। মাওলানা সাহেবের বসতঘর দেখতে চাইলাম। আমাকে বলা হল যে, বাড়ির অন্দর মহলে তাঁর নিজস্ব বসতঘর নেই। জিজ্ঞাসা করলাম, মাওলানা সাহেব স্বস্ত্রীক বাড়িতে এলে তার স্ত্রী কোথায় থাকেন? আমাকে জানানো হলো যে, অতিথি ভবনের ভিতরের কক্ষটিতে তার স্ত্রী থাকেন।
ঢাকায় এসে আমি মাওলানা সাহেবকে তাদের বাড়িতে নিজস্ব ঘর না করার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। মাওলানা মান্নান বললেন, অন্দর মহলে ঘর করা হলে ঘর পাহারার জন্য আলাদা লোক রাখতে হয়। সময়মত রক্ষণাবেক্ষণ না করলে ঘর নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমি মাদরাসার জন্য গেস্ট হাউজ জাতীয় একটি ইমারত করে দিয়েছি। মাদরাসার অতিথিরা এখানে থাকেন। জেলা হেড কোয়ার্টারের কর্মকর্তারা থানার ভিজিটে এলে কেউ থানা হেড কোয়ার্টারে স্থান সংকুলান না হলে এখানে এসে থাকেন। মাদরাসার কর্তৃপক্ষ তাদের দেখাশোনা করেন। এতে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাদরাসার সম্পর্ক নিবিড় হয়। এর সুবিধা মাদরাসা পেয়ে থাকে। তার এই দ্বীনি কল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি আমার কাছে অনুকরণীয় মনে হয়েছে।
অনন্য পাকা ঘাটলা: মাওলানা আব্দুল মান্নানের বাড়ি ও মাদরাসার পুকুরটিতে একটি বিরাট পাকা ঘাটলা আছে। স্থানীয় লোকদের কাছে শুনলাম, এই ঘাটলাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঘাটলা। কিন্তু বাহ্যিকভাবে উপরদিকে কোনো কারুকার্য অথবা বিলাসিতার কোনো নমুনা দেখলাম না। ব্যয় বা বিলাসিতার খাত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ঐ দীঘির ঘাটলায় ইট ব্যবহার করা হয়নি। পুরো ঘাটলাটি কংক্রিটের। তবে সিমেন্টের ভাগই বেশি।
এরূপ মজবুত এবং ব্যয়বহুল ঘাটলা তৈরির কারণ মাওলানা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বললেন পল্লী অঞ্চলের দীঘির ঘাটলা প্রায় সারাদিনই ব্যবহার হয়। ভালো ঘাটলা হলে এমন ঘণ্টা যায় না যেখানে রাতের বেলাও কেউ না কেউ এসে থাকে। ঘাটলায় গরমের মওসুমে রাতের বেলা অনেকে শুয়ে থাকে। মসজিদ ও মাদরাসার পরেই পল্লী অঞ্চলে সমাজ সেবামূলক অতি উত্তম কাজ হলো বড় দীঘি এবং পুকুর খনন এবং উত্তমমানের ব্যয় বহুল ঘাটলা তৈরি করে দেওয়া। এতে অপচয় হয় না।
তার ধারণা ও পরিকল্পনা মতে, গ্রামের ঐ মজবুত ঘাটলাটি কয়েক বছর নয়, ৫০০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার উপযোগী থাকবে। যারা এরূপ ঘাটলা নির্মাণের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সংযুক্ত থাকবেন- তারা সাদকায়ে জারিয়ার ছওয়াব ৫০০ বছর ধরে পেতেই থাকবেন।
আরবি ভাষায় মাওলানা আব্দুল মান্নানের দক্ষতা ছিল অনেকের মতে অসাধারণ। তিনি আরবি সাহিত্যিক ছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু আরবদের সাথে ধীর, স্থিরভাবে অনর্গল আরবিতে কথা বলতে পারতেন। বাংলাদেশি মাদরাসা শিক্ষিতদের মধ্যে মরহুম হযরত মাওলানা আব্দুল মান্নান ছিলেন এক অসাধারণ ও এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণের আশু সম্ভাবনা নেই।
লেখক: সাবেক ধর্ম, বস্ত্র ও নির্বাচন কমিশন সচিব
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন