রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

যুদ্ধের অস্ত্র এখন জ¦ালানি তেল

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ইউরোপ এক সন্ধ্যায় যতটা অশোধিত তেল রাশিয়া থেকে আমদানি করে, গোটা মাসে ভারত করে তার থেকে কম। ওয়াশিংটনের মাটিতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। আর জি-৭ মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, জ¦ালানির ব্যবহার ধনী ব্যক্তিদের একচেটিয়া নয়। দরিদ্রদেরও অধিকার আছে জ¦ালানি ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করার। নাম না-করেই বুঝিয় দিয়েছেন, রাশিয়া-বিরোধী দেশগুলি যতই চাপ দিক না কেন, জাতীয় স্বার্থে কম দামে রুশ তেল কিনবে ভারত। তাতে অবশ্য ভারতের গরিব জনতা কী সুবিধা পাচ্ছে তা কেউ জানে না। তবে মোদি নিশ্চিত বুঝে গিয়েছেন, যুদ্ধের ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠেছে জ¦ালানি। এই তেলই হয়ে উঠতে পারে ভারতের নির্বাচনী সাফল্যের অস্ত্রও।

ইউক্রেন হামলার পর ভøাদিমির পুতিনকে শিক্ষা দিতে রাশিয়াকে ‘ভাতে মারা’র পরিকল্পনা করেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ অন্যান্য শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। সেই প্ল্যান কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। তথ্য বলেছে, ইউক্রেনে হামলার পরবর্তী ১০০ দিনে ৯ হাজার ৭৭০ কোটি ডলারের জীবাশ্ম জ¦ালানি রপ্তানি করেছে রাশিয়া। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি দিন প্রায় ৯৮ কোটি ডলারের জ¦ালানি অন্য দেশে রপ্তানি করেছে পুতিনের দেশ। এই রপ্তানি হওয়া জ¦ালানির অর্ধেকের বেশিই অপরিশোধিত। প্রশ্ন হচ্ছে, কারা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জ¦ালানি কিনছে রাশিয়া থেকে?

সমীক্ষা বলছে, এই তালিকায় সবার আগে রয়েছে চীন, তারপরেই জার্মানি এবং ভারত। রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোও। ইউক্রেন হামলার পর যে আড়াই হাজার কোটি ডলারের পাইপলাইনে গ্যাস রাশিয়া অন্য দেশে রপ্তানি করেছে, তার ৮৫ শতাংশ গিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে। বিস্ময়ের কথা হলো, এই আমদানিকারক দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডের মতো বহু ন্যাটোভুক্ত দেশের নাম, রাশিয়ার সঙ্গে লড়ার জন্য যাদের সাহায্যপ্রার্থী ইউক্রেন। জানা গিয়েছে, গত দু’মাসে উরাল ক্রুডের গুণগত মানোন্নয়ন করেছে রাশিয়া। জ¦ালানি তেলকে আরও বেশি লাইট অ্যান্ড সুইট ০.৫ শতাংশেরও কম সালফারযুক্ত জ¦ালানি তেল করার কারণে এশিয়ার ক্রেতাদের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

শুনলে অবাক হওয়ার কথা, রাশিয়ার ‘সস্তার তেল’ কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সৌদি আরবের মতো দেশও। এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে রাশিয়া থেকে দ্বিগুণ জ¦ালানি তেল আমদানি করেছে সৌদি আরব। রেফিনিটিভ এইকন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ‘শিপ ট্র্যাকিং ডেটা’ বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানা গিয়েছে সংবাদ সংস্থা সূত্রে। রেকর্ড অঙ্কের তেলের ক্রেতা মিশরও। আর যে আমেরিকা রাশিয়ার তেল না-কেনার জন্য বিশ^কে চাপ দিচ্ছে, সেও মার্চ-এপ্রিলে রেকর্ড পরিমাণ রাশিয়ার তেল আমদানি করে রিজার্ভার ভরে ফেলেছে।

আসলে যে প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি তা হলো, রাশিয়ার তেলের বিকল্প কোথায়? ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এ একই প্রশ্ন তুলেছেন এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের সহ-সভাপতি এবং ‘দ্য নিউ ম্যাপ’ গ্রন্থের রচয়িতা ড্যানিয়েল ইয়েরগিন। অথচ, এই জ¦ালানি তেলের সঙ্কটে আজ দেশে-বিদেশে শোরগোল। পণ্য পরিবহন ও উৎপাদনের খরচ বাড়ছে তাতে। চড়া মূল্যস্ফীতির আঘাতে ক্ষুব্ধ জনতা, অনেক দেশেই চলছে বিক্ষোভ। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মতো খাদের কিনারায় প্রায় এক ডজন দেশ। রাশিয়ার জ¦ালানি নিয়ে বর্তমান অচলাবস্থা বিশ^জুড়ে ‘মহামন্দা’ ডেকে আনতে পারে। সেই আতঙ্কও ক্রমশ বাড়ছে।

ইউরোপ তার পূর্ব দিকের প্রতিবেশী রাশিয়া থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে করে দুই তৃতীয়াংশ জ¦ালানি আমদানি করে। সেটা তারা বন্ধ করে দিতে চায়। পোল্যান্ড ও জার্মানিও পাইপলাইনের মাধ্যমে জ¦ালানি আমদানি বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে। এই দুটি সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে রাশিয়ার জ¦ালানি ইউরোপে প্রবেশে একটি পথই খোলা খাকবে। সেটা দক্ষিণ দিকের দ্রুজবা পাইপলাইন। এই পাইপলাইন দিয়ে ¯েœাভাকিয়া, চেক রিপাবলিক এবং ক্রেমলিন-সমর্থিত হাঙ্গেরিতে জ¦ালানি সরবরাহ হয়। কিন্তু তাতেও কি রাশিয়াকে ‘ভাতে মারা’ সম্ভব?

পশ্চিমের ক্রেতারা যখন রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করছে, রাশিয়া তখন তার তেলের বাজার এশিয়াতে সম্প্রসারণ করছে। বিশেষ করে ভারত, এখন বাংলাদেশের নামও শুনা যাচ্ছে। এর আগে রাশিয়ার জ¦ালানির প্রধান ক্রেতার তালিকায় ভারত ছিল না। এশিয়ায় জ¦ালানি বিক্রি বাড়াতে রাশিয়া ব্যারেল প্রতি ৩০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে যুদ্ধ শুরুর আগেই রাশিয়া জ¦ালানি রপ্তানি করে বিপুল আয় করে ফেলেছে।

আপাতত রাশিয়ার কাছে এশিয়ায় নতুন বাজারকে নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে। রীতিমতো দর-কষাকষি করে চুপিসারে রাশিয়ার তেল কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে চীনও। তেল কিনেছে চীনের ইউনিপেক ও ঝেনহুয়া অয়েল। ইউনিপেক হলো এশিয়ার সর্ববৃহৎ তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি সিনোপেক কর্পোরেশনের বাণিজ্যিক শাখা। আর ঝেনহুয়া চীনের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংস্থা নরিনকোর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ব্যারেল প্রতি প্রায় ২৯ ডলার কমে রাশিয়ার তেল পাচ্ছে তারা। গত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত তিন মাসে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল, গ্যাস ও কয়লা কিনতে ১ হাজার ৮৯০ কোটি ডলার খরচ করেছে চীন, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। পশ্চিমারা যদি এশিয়ার বাজারে সমুদ্রপথে রাশিয়ার জ¦ালানি আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে চীন, ভারতের মতো আমদানিকারকদের মধ্যেও ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। এটা এড়াতে গেলে ইরান ভেনেজুয়েলার তেলের উপর কয়েক বছর ধরে যে নিষেধাজ্ঞা চলছে সেটা তুলে নিতে হবে। সেটা কি সম্ভব? না হলে এখন বিশ^ তেলের দাম যতটা উঁচুতে উঠেছে, সেটাকে আরও উঁচুতে উঠতে দেওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই।

জার্মানিতে অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধানরা রাশিয়ার তেল যাতে নির্দিষ্ট একটা দামের উপরে আমদানিকারকরা কেনে, সেই জন্য ‘প্রাইস ক্যাপ’ বসানোর ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এতেই নাকি রাশিয়াকে শায়েস্তা করা যাবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা অত সহজ নয়। ‘দ্য মিথ অব দ্য অয়েল ক্রাইসিস’ বইয়ের লেখক রবিন মিলস বলছেন, রাশিয়ার তেলের উপর প্রস্তাবিত ‘প্রাইস ক্যাপ’ অনেক বেশি। তারা পশ্চিমা দুনিয়ার চাপানো ‘প্রাইস ক্যাপ’ মানবে কেন? প্রাইস ক্যাপ বসানো কিংবা শুল্ক আরোপ তখনই কার্যকর হবে, যখন রাশিয়া চুপ করে সেটা মেনে নেবে। কিন্তু জ¦ালানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মস্কো তো অন্য খেলা শুরু করেছে।

১৯৯০-এর দশকে ইরাকেও ‘তেলের বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রাইস ক্যাপ বসানো হয়েছিল। কিন্তু তা টেবিলের নিচের লেনদেনের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। এটা ক্রেমলিনের অজানা নয়। প্রাইস ক্যাপ বসানো হলে রাশিয়া তার ভুরাজনৈতিক স্বার্থে তেল বিক্রির ক্ষেত্রে ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতিতে এগোবে। আবার তেল রপ্তানি রাশিয়া নিজ থেকেই কমিয়ে দিতে পারে। ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির ক্ষেত্রে এরই মধ্যে রাশিয়া এই কৌশল প্রয়োগ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে রাশিয়া জাপানকে সতর্ক করে দিয়েছে যে, প্রাইস ক্যাপ বসানোর প্রস্তাবে সমর্থন করলে জাপানে তেল সরবরাহ কমিয়ে দেবে রাশিয়া। তাতে জাপানে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ৩০০-৪০০ ডলারে গিয়ে ঠেকবে।

রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি রাখার খেসারত হিসাবে শীতে ব্রিটেনের অন্তত ৬০ লাখ পরিবারকে হাড় হিম করা ঠান্ডায় সকাল-সন্ধ্যা, যখন-তখন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় কাটাতে হতে পারে। শুধু ব্রিটেন নয়, গোটা ইউরোপের বিদ্যুৎ গ্রাহকরা এই অবস্থায় পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা। যে নিষেধাজ্ঞাগুলো পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার উপর চাপিয়েছে, তা ব্যুমেরাং হয়ে আঘাত করেছে গোটা ইউরোপেই। ইতোমধ্যে জ¦ালানির অভাবে হাঙ্গেরি জানিয়ে দিয়েছে, রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে প্রকারান্তরে হাঙ্গেরির উপর ‘পারমাণবিক বোমা’ ফেলা হয়েছে। হাঙ্গেরির নেতারা মনে করছেন, নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য অস্পষ্ট। কত দিনের মধ্যে এর সুফল পাওয়া যাবে, তার কোনও সময়সীমা অনুমান করা যাচ্ছে না। জ¦ালানি তেলকে রীতিমতো প্রতিরোধের অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছেন পুতিন। নিষেধাজ্ঞার সহজাত প্রবণতা, দিন যত যায় তা তত কঠিন হতে থাকে এবং তা এক সময় ভেঙে ফেলা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই যদি হয়, বিশে^র আগামীর দিনগুলো যাবে আরও খারাপের দিকে।


লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন