শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জেলা পরিষদ : এমন নির্বাচন কাম্য নয়

সম্পাদকীয়-২

| প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচন। তিন পার্বত্য জেলা বাদ দিয়ে দেশের ৬১টি জেলায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচনের জন্য জেলার অন্তর্গত সকল স্তরের স্থানীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা এই নির্বাচনে ভোট দেবেন। বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিকদল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় নির্বাচনটি কার্যত একতরফাভাবেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় এরই মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশী জেলায় (২২টি) আওয়ামীলীগ প্রার্থীদের বিনাভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচন নিশ্চিত হয়েছে। অর্থাৎ দেশের ৩৯টি জেলায় চেয়ারম্যান পদে ১২৪ জন এবং সব জেলায় সাধারণ সদস্য পদের জন্য প্রায় ৩ হাজার এবং সংরক্ষিত মহিলা সদস্যদের জন্য ৮০৫ জন প্রার্থী অংশ গ্রহণ করছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। চেয়ারম্যান পদে ২২ জনের পাশাপাশি সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত পদেও ইতিমধ্যে ২ শতাধিক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করেছেন। আজ সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত প্রত্যেক জেলায় নির্ধারিত ১৫টি ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা ভোট দেবেন। সারাদেশে জেলা পরিষদের ভোটার সংখ্যা ৬৩ হাজার ১৪৩ জন। বিরোধীদলের অংশগ্রহণ না থাকায় বেশীরভাহ জেলায় সরকারী দলের চেয়ারম্যান, সদস্য ও সংরক্ষিত পদের প্রার্থীরা নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হচ্ছেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া এবং অবশিষ্ট আসনগুলোতে নামমাত্র ভোট অথবা প্রকাশ্য সিলমারা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার যে চিত্র দেখা গেছে পরবর্তী প্রায় সব স্থানীয় নির্বাচনেই তার ধারাবাহিক প্রবণতা দেখা গেছে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় অথবা ক্ষমতার জোরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরাই জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার হওয়ার কারণে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট অর্থহীন মনে করে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রয়েছে। মূলত এভাবেই তৈরী হয়েছে জেলা পরিষদে আরেকটি একদলীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপট। সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে চায়, সরকারের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য হরহামেশা শোনা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সর্বসম্প্রতি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি’র অংশগ্রহণ এবং সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের একটি মডেল হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। তবে নাসিক নির্বাচনের মাত্র ৬ দিনের মাথায় জেলা পরিষদ নির্বাচন শুধু একদলীয়, একতরফাই নয়, এই নির্বাচনেও টাকার খেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের এন্তার অভিযোগ দেখা যাচ্ছে। প্রার্থী ও সমর্থকদের নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের শত শত অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে জমা পড়লেও এসব অভিযোগের সুরাহা বা বিরোধ নিষ্পত্তিতে নির্বাচন কমিশনকে কোন কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। বিশেষত, স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নিজেদের সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে প্রভাব কাজে লাগাচ্ছেন। তবে নির্বাচন কমিশন এমপিদের নিজ নিজ এলাকা ছাড়ার নির্দেশনা জারি করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে।
নিরুত্তাপ জেলা পরিষদ নির্বাচনেও ব্যাপক টাকার খেলা চলছে বলে গতকাল কয়েকটি সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে টাকার খেলা কোন নতুন বিষয় না হলেও মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভোটে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও টাকা দিয়ে ভোট কেনাবেচার ঘটনা অপ্রত্যাশিত, অনাকাক্সিক্ষত। প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, সরকারীদল ও বিদ্রোহী প্রার্থীরা নিজেদের পক্ষে ভোট নিশ্চিত করতে স্থান ও পাত্রভেদে একেকজন ভোটারকে দিচ্ছেন ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এমনকি টাকা দিয়ে কেনা ভোট নিশ্চিত করতে প্রকাশ্য ভোট দেয়ার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। কালো টাকার মালিকরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্য হয়ে জনগণের কি সেবা করবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। একদলীয় এবং টাকা দিয়ে ভোট কেনার নির্বাচন আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতির ভয়াবহ অবক্ষয়ের নিকৃষ্ট উদাহরণ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নাসিক নির্বাচন সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এই নির্বাচনকে মডেল করে সরকার পরবর্তী সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বললেও কার্যত একদলীয় ও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার জেলা পরিষদ নির্বাচনেও সে ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন। জনপ্রতিনিধিদের ভোটে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে যোগ্য, দক্ষ ও সৎ প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে আসলে সেটি হতো জাতির সামনে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সাংবিধানিক আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সীমিত সংখ্যক নির্বাচিত জনপ্রধিনিধিকে মোটা অংকের টাকা খেয়ে ভোট দেয়ার সুযোগ অবারিত রাখার নির্বাচন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও সুষ্ঠু নির্বাচনী সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের নির্বাচন দেশের মানুষ প্রত্যাশা করেনা। স্থানীয় সরকারের সকল নির্বাচনকে টাকার খেলা ও ক্ষমতার প্রভাবমুক্ত রেখে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্য জেলা পরিষদ নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন