নগরবাসী যাদের রাতদিন পরিশ্রম করতে হয় তাদের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা গণপরিবহন। দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে, গণপরিবহনে নিয়ম-শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। যত ধরনের বিশৃঙ্খলা হতে পারে তার সবগুলোই এই খাতে বিদ্যমান। একদিকে বিরতিহীন, সিটিং সার্ভিস, কমস্টপেজ, সময় নিয়ন্ত্রণ, ডাইরেক্ট ইত্যাদি সার্ভিসের নামে যাত্রী হয়রানী। অন্যদিকে রয়েছে লক্কর-ঝক্কর মার্কাবাস, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত আসন সংক্রান্ত জটিলতা। গণপরিবহনের বিদ্যমান বাস্তবতা হচ্ছে যেহেতু যাত্রীদের যাবার আর কোন ব্যবস্থা নেই সে কারণে তারা পুরোটাই চালক-কন্ডাকটরের কাছে জিম্মি। কেন এ অবস্থা সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমত, এটাই বলতে হবে যে, মূলত বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং কোন কোন মহলের অবৈধ অর্থ গ্রহণ। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক দৈনিক ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, যাত্রীদের সমস্যাগুলো দেখার দায়িত্ব নগর বা মেট্রো আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির। সেই কমিটি দখল করে আছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক কমিটির নেতারা। এ প্রসঙ্গে বুয়েটের শিক্ষক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর শামসুল হকও মনে করেন, পৃথিবীর কোন দেশে গণপরিবহন আঞ্চলিক কমিটিতে মালিক শ্রমিক সদস্য থাকেনা। আমাদের দেশেই এর ব্যতিক্রম। একারণে এখানে যাত্রী স্বার্থের চেয়ে মালিকের স্বার্থরক্ষা বেশি করে আসছে। প্রাসঙ্গিক অলোচনায় তিনি বলেছেন, পরিস্থিতির উন্নতিতে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা প্রয়োজন। একই সাথে পদ্ধতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন। তা না হলে পরিবহন সেক্টরের এই বিশৃঙ্খলা যুগ যুগ ধরে থেকেই যাবে। তার মতে, নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রয়োজন নেই। উন্নতবিশ্বের পরিবহন সেক্টরের সিস্টেম ফলো করলেই এখানে শৃঙ্খলা ফিরয়ে আনা সম্ভব।
প্রকৃত অর্থেই খোদ রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনে যা চলছে তা দেখলে যে কেউ অনুভব করবেন এটা কোন সভ্য দেশে ঘটে না। প্রতিদিনের ঘটনাবলী যদি পত্রিকায় ঠাঁই পেত তাহলে দৈনিকে হয়ত আর কোন খবর ছাপার জায়গা থাকত না। রাজধানীতে এখন এমন কোন পরিবহন নেই যেখানে প্রতিদিন ভাড়া বা অন্য প্রসঙ্গে যাত্রীদের অপদস্থ হতে হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ ইচ্ছে মত ভাড়ার তালিকা তৈরি করে নেয়া। সরকারি তালিকায় যাই থাক, প্রায় প্রতিটি পরিবহনের মালিকরা নিজেদের মতো করে একটি ভাড়ার তালিকা তৈরি করে তা যাত্রীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এর সাথে মূল তালিকার কোন সম্পর্ক নেই। আবার প্রতিটি পরিবহনেই সরকারি ভাড়ার তালিকা লটকানো রয়েছেÑ যা দেখার অধিকার সাধারণ যাত্রীদের নেই। ফলে দেখাযায়, একই রুটে একেক পরিবহন একেক হারে ভাড়া দাবি করছে। দাবিকৃত ভাড়া যাত্রী দিতে অস্বীকার বা অপারগতা প্রকাশ করলে তার ভাগ্যে ঘটে চরম বিড়ম্বনা। এর আগে এক টাকা দু’টাকার জন্য যাত্রী মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এর কোন বিচার হয়েছে বলে আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। বিশৃঙ্খলা শুধু ভাড়াতেই নয়। অনুমতি নেয়ার সময়ে যে ধারণ ক্ষমতা লেখা থাকে রাজধানীর কোন পরিবহনেই তা মানা হয় না। এরপর আসন সংখ্যা বাড়িয়ে এমন এক অবস্থা করা হয় যেখানে কোন যাত্রীর পক্ষে বসা অসম্ভব। এ নিয়ে কথা বলেও কোন লাভ হয় না। উপরন্তু নাজেহাল হতে হয়। মূলত প্রতিটি গণপরিবহনে ভাড়ার হার নির্ধারণ করা হয় তার যাত্রীবহনের বিবেচনায়। নিয়মানুযায়ী আসনের বেশি যাত্রী পরিবহন করার কথা নয়। বাস্তবে দেখা যায় পরিবহনের দু’সারির মাঝখানে হাঁটার সামান্য পথটুকুতে দাঁড়িয়ে থাকে আসনের চেয়ে দ্বিগুণ। কেন এ অবস্থা তা জানতে চাইলে চালক-কন্ডাকটররা তুলে ধরেন একভিন্ন চিত্র। তাদের ভাষ্যানুযায়ী অধিকাংশ মালিকই ট্রিপ অনুযায়ী আসনের পুরো পয়সা বুঝে নেন। তাদের জন্য কোন বরাদ্দ থাকে না। সে বিবেচনায় যাত্রী ভোগান্তির নামে যেটুকু আয় সেটুকুই তারা ভাগাভাগি করে নেয়। ভোগান্তির আরো একটা বড়দিক হচ্ছে, অফিস আওয়ার। এ সময়ে দীর্ঘ যানজটের কারণে পরিবহনগুলো যেমনি থাকে প্রচ- চাপের মুখে তেমনি যাত্রীদেরও কোন বিকল্প থাকেনা। বাস্তবত, সব সংকটের মূলে রয়েছে, রাজধানীর ট্রাফিক জ্যাম। রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রগুলোতে পৌঁছতে যতগুলো পয়েন্ট রয়েছে সবগুলোতেই লেগে থাকে দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যাম। দৈনিক বাংলা, প্রেসক্লাব, শাহবাগ, মালিবাগ, বিজয় সরণি, কাকলি, বনানী, মহাখালী সবখানেই দেখা যাবে কেবলমাত্র ভিআইপি যাত্রীদের চলাচলের জায়গাটুকু ছাড়া সর্বত্রই কেবল যানবাহন আটকাই পড়ে আছে। এসব রুট দিয়েই গণপরিবহন যাতায়াত করে। ফলে এই দীর্ঘসময় আটক থাকায় যে আর্থিক ক্ষতি হয় তাও তারা কোনো না কোনোভাবে তুলে নেয় যাত্রীদের উপর কাছ থেকেই। কেন এবং কি কারণে সর্বসাধারণের চলাচলের রুটগুলোতেই কেবল দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যাম হয় এর কোন ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায়নি। সবকিছুর উপরে গণপরিবহনে নৈরাজ্যের পিছনে যে সত্যটি বিদ্যমান তা হচ্ছে এ খাতে শত শত কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনÑ যার ভাগ নাকি নানা পর্যায়ে যায়। একথাও সত্যি বর্তমানে দেশের একশ্রেণীর আমলা, সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও গণপরিবহন ব্যবসার সাথে বিশেষভাবে যুক্ত।
বাস্তবতা হচ্ছে, গণপরিবহনের দুর্গতি ভোগান্তি নিয়ে এযাবৎকাল কম লেখালেখি হয়নি। সময়ে সময়ে সংশ্লিষ্টদের উদ্বিগ্নতাও দেখা যায়। গাড়ীর ধরপাকড়ও হয়। কার্যত মূল যে সমস্যা তার কোন সমাধান হয়েছে সেকথা বলা যাবেনা। বছর শুরুর আগেই অনেক রুটে নতুন করে বর্ধিত ভাড়া নেয়া শুরু হয়েছে। এসব পরিবহন সড়কেই চলাচল করছে। কার্যত যাদের দেখার কথা তারা দেখছেন না বলেই ভোগান্তির অবসান হচ্ছে না। গণপরিহনের শুধু সংস্কার নয়, আমূল পরিবর্তন দরকার। পুরনো নিয়মে আর চলার কোন অবস্থা নেই। বিশেষজ্ঞরা অর্থনৈতিকভাবে উন্নতদেশগুলোতে চালু হওয়া নিয়ম প্রবর্তনের পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এটা সকলেরই মনে রাখা দরকার কেবল গণপরিবহনের অনিয়মের কারণেই শত শত কর্মঘণ্টার অপচয় হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে শত শত কোটি টাকার। আমরা মনে করি, গণপরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন করা গেলে তার ইতিবাচক প্রভাব সব জায়গায় পড়তে বাধ্য। সময়, অর্থ এবং সর্বসাধারণের নিরাপত্তার বিবেচনাকে সামনে রেখে গণপরিবহনে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে সকলে আন্তরিক হবেন, এটাই কাম্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন