শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভূমিকম্পের ভয়াবহতা রোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

গত ৬ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টা ১৭ মিনিট। তুরস্ক ও সিরিয়ার মানুষ যখন গভীর ঘুমে, তখন যেন সবকিছু দোলনার মতো দুলতে থাকে। তারপরই যেন তাসের ঘরের মতো ধুলোয় মিশে যেতে থাকে বিভিন্ন ভবন। মুহূর্তে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চল ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল। ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাতে ঘুমের মধ্যেই চাপা পড়ে মৃত্যু হয় দুই দেশের পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের। মৃতের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুধু একবার নয়, প্রথম আঘাতের পর আফটার শক হিসেবে ৭.৫ মাত্রায় দ্বিতীয়বার আঘাত করে। পরপর দুইবার ভূমিকম্পে পুরো এলাকা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বিগত ৮৪ বছরের মধ্যে তুরস্কের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প এটি। ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল নেপালে ৭.৯ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। সে সময়ে ৮০ বছরের মধ্যে এমন ভূমিকম্প হয়নি। ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যা কখন হবে কেউ জানে না। ভূমিকম্প হবে, এমন পূর্বাভাস দেয়ার মতো কোন যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি। কেবল ভূমিকম্প হওয়ার পর কত মাত্রায় হয়েছে, তা মাপার যন্ত্র রিখটার স্কেল আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ভূমিকম্প হওয়ার আগে প্রাকৃতিক কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন কুকুরের অস্বাভাবিক ডাক, পাখির অস্থির উড়াউড়ি দেখে ধারণা করা যায় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে এসব লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার মতো সময় মানুষের হয়ে উঠে না। নেপালে ভূমিকম্প হওয়ার আগে পশু-পাখির এমন আচরণ দেখা গেছে। তুরস্কে ভূমিকম্প হওয়ার আগে পাখির উড়াউড়ি দেখা গেছে বলে কেউ কেউ বলছেন। এমন একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শক্তিশালী মাত্রার ভূমিক¤প আঘাত হানার আগে প্রাণীদের উদ্ভট আচরণ করার ধারণাটি অনেক পুরোনো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৩-এ গ্রিসে ভয়াবহ ভূমিক¤েপর কয়েক দিন আগে ইঁদুর, বেজী, সাপের মতো প্রাণীরা এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পুরনো ধারণা মতে, পশুপাখিরা বিভিন্নভাবে ভূমিক¤েপর আভাস পেতে পারে। কিছু প্রাণী ভূমিক¤েপর আগে মাটিতে তড়িৎচুম্বকীয় পরিবর্তন বুঝতে পারে। কোনো কোনো প্রাণী বায়ুম-লীয় চাপের পরিবর্তন শনাক্ত করতে পারে। ভূমিক¤েপর আগে বায়ুম-লীয় চাপের পরিবর্তন হতে পারে। যেসব প্রাণী মাটির কাছাকাছি বসবাস করে তারা ভূমিক¤প হওয়ার আগে মাটির গতিবিধি অনুভব করতে পারে। মানুষ ভূমিক¤প টের পাওয়ার আগেই মৃদু ধরনের ক¤পন হয় যেটা শুধু কুকুরের মতো কিছু প্রাণী বুঝতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলেছে, পশুপাখিরা আসলেই ভূমিক¤েপর আভাস দিতে পারে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্প হবে তা তিন দিন আগে জার্মানির একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সোলার সিস্টেম জিওমেট্রি সার্ভে আভাস দিয়েছিল বলে জানা যায়। সংস্থাটি জানিয়েছিল, দক্ষিণ তুরস্ক, জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। অবশ্য এ ধরনের আভাস সবসময় দেয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই।

দুই.
তুরস্ক ও সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্প কয়েকশ’ কিলোমিটার পর্যন্ত অনুভূত হয়। ২০১৫ সালে নেপালে ৭.৯ মাত্রার যে ভূমিকম্প আঘাত করে, তার ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছিল। বাংলাদেশে এর মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫। এতেই বাংলাদেশে কেঁপে উঠে। এক ভয়াবহ আতঙ্ক তখন সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। যদি ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে আঘাত করে, তাহলে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা কল্পনাও করা যায় না। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বুয়েটের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ৭.৯ মাত্রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে শুধু রাজধানীতেই মৃত্যুবরণ করতে পারে আড়াই লাখ মানুষ। চারশ’রও বেশি ভবন মাটির সাথে মিশে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডু থেকে ৮১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবং পোখরা থেকে ৮০ কিলোমিটার পূর্বের লামজুং এলাকায় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে ঢাকা ৭৪৫ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় ভূমিকম্পের প্রভাব কম ছিল। এই উৎপত্তিস্থল যদি ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে এমনকি ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে হতো, তাহলে ঢাকা শহরের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেত। ভূতত্ত্ববিদরা বহুদিন ধরেই বলছেন, ঢাকায় একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শেষবার এ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। এরপর ১৩৭ বছর পার হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে ভূঅভ্যন্তরভাগে বিপুল শক্তি সঞ্চিত হয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে যে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়েছে, তা বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বাভাস। যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। ভূতত্ত্ববিদরা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে রয়েছে। বাংলাদেশ অবস্থান করছে ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মায়ানমারের টেকটনিকপ্লেটের মধ্যে। ভারতীয় ও ইউরেশীয় প্লেট দুটি ১৯৩৪ সালের পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে। অপেক্ষা করছে বড় ধরনের নড়াচড়ার জন্য। নেপালে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল তা প্লেট দুটির বড় ধরনের নড়াচড়ার কারণেই হয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশ ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোনে রয়েছে। এগুলো হলো বগুড়া, রাজশাহীর তানোর, সীতাকু-, টেকনাফ, হালুয়াঘাট, ডাওকী, চট্টগ্রাম, সিলেটের শাহজীবাজার, রাঙামাটির বরকল চ্যুতি এলাকা এবং ভারতের ত্রিপুরা। ১৯১৮ সালে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার এবং ২০০৭ সালের নভেম্বরে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। এ ভূমিকম্পের আতঙ্কে ৬ জন মারা যায়। ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ৫৭টি ভূমিকম্প হয়েছে। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ২ মিনিটে ৫৩ সেকেন্ড স্থায়ী ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। বুয়েটের মানমন্দিরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে ৪ মাত্রার ৮৬টি ভূমিকম্প হয়। এ সময়ের মধ্যে ৫ মাত্রার চারটি ভূমিকম্প ধরা পড়ে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭-এর জুলাই থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৯০টি ভূ-কম্পন হয়। এর মধ্যে ৯টিরই মাত্রা ছিল ৫-এর উপরে। এগুলোর ৯৫ ভাগের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা শহরের ৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে। এসব রেকর্ড থেকে দেখা যায়, মাত্রা না বাড়লেও ১৯৬০ সালের পর থেকে ভূমিকম্পের হার বাড়ছে। অর্থাৎ ঘন ঘন স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। ভূতাত্ত্ববিদরা বলছেন, এসব স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের শক্তি সঞ্চয় করছে। যেকোনো সময় ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মতো ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদি এই মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে তবে বাংলাদেশ বিশেষ করে ঢাকা শহরের অবস্থা কি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। ২০০৩ সালে ইরানে ৬.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ২৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। ২০০৫ সালে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের মুজাফফারবাদের কাছের উৎপত্তিস্থলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় এক লাখ লোক মারা যায়। ২০১০ সালে হাইতিতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ভূমিকম্পের এসব মহাদুর্যোগের ঘটনা থেকে বোঝা যায়, এই মাত্রায় ভূমিকম্প বাংলাদেশে হলে কী ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি অনুযায়ী, যদি রাত ২টায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তবে ঢাকা শহরে ৮৮ হাজার মানুষ মুহুর্তেই মৃত্যুবরণ করবে।

তিন.
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে ইরানের তেহরানের পর সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিবেচিত। তারা আশঙ্কা করছেন, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেই ঢাকা শহর পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে পারে। এর অন্যতম কারণ, ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে বিল্ডিং কোড মান হয় না। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে ৭৮ হাজারের বেশি। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসেবে প্রায় ৭০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ভবন জরুরি ভিত্তিতে ভেঙ্গে ফেলার ঘোষণা দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। চি‎িহ্নত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙ্গে ফেলা দূরে থাক, যেভাবে বিল্ডিং কোড না মেনে অট্টালিকা গড়ে উঠছে, সেগুলোর বিরুদ্ধেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। বুয়েটের করা জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ এবং সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীর প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। মাঝে মাঝে বহুতল ভবনের হেলে পড়া ও ফাটল ধরার খবর পাওয়া যায়। এসব ভবন ভেঙ্গে ফেলা ছাড়া কোনো গতি থাকে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এসব চকচকে-ঝকঝকে বহুতল ভবন নির্মাণ করে কি লাভ? অথচ নির্মাণের সময় এগুলো ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তোলা হলে এই ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। ভবন গড়ে তোলার সময় খরচ বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট মালিকরা ভূমিকম্প সহনীয় প্রক্রিয়া অবলম্বন করে না। কিংবা ভূমিকম্প সচেতনতা নেই। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা ভবন ফাটল ও হেলে পড়ার মুখোমুখি হলে যে পুরো অর্থ বিফলে যাবে, তা চিন্তা করে না। অথচ প্রতি বর্গফুটে মাত্র ১০ টাকা বেশি ব্যয় করলেই ভূমিকম্প প্রতিরোধক ভবন গড়ে তোলা যায়। তারা এ বিষয়টি মাথায় নেয় না, যেভাবে ক্রমাগতভাবে মৃদু ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এমনিতেই রাজধানীর ভূগর্ভস্থ মাটির মান খারাপ ও নরম হওয়ায় ভূমিকম্প ছাড়াও ভবন দেবে যাওয়ার অনেক নজির রয়েছে। তার উপর ভূমিকম্প হলে কী অবস্থা দাঁড়াবে, তা কল্পনা করা যায় না। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা বদলে গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে, ৭৬ শতাংশ সড়ক সরু হওয়ায় ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এলাকায় প্রবেশ এবং উদ্ধার কার্যক্রম চালানো যাবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে এখন বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্প ভয়াবহ হয়ে উঠছে। উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায়ই ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এতে বিপুল জানমালের ক্ষতি হয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত করলে তা কতটা ভয়াবহ হবে, তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না।

চার.
যখন কোন বড় ধরনের দুর্যোগের ঘটনা ঘটে, তখনই কেবল আমরা এ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলি। টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় এর প্রতিকার ও কি করণীয় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিস্তর আলাপ-আলোচনা করেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলও নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন যেতেই সব থেমে যায়। আর কোন খবর থাকে না। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আরেকটি দুর্যোগের মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত টনক নড়বে না। অথচ এখনই যে সচেতনতা ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, তা আমলে নেয়া হচ্ছে না। ঢাকা শহর যে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে, তা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ভূমিকম্প মোকাবেলার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রানা প্লাজা। এক রানা প্লাজার ভেতরে আটকে পড়া মানুষ উদ্ধার ও সবকাজ শেষ করতেই সময় লেগেছে ২৩ দিন। আর ভূমিকম্পে কয়েক হাজার ভবন ধ্বসে পড়লে কী অবস্থা হবে, তা ভাবা যায় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে, সেগুলো ভেঙ্গে ফেলা জরুরি। পাশাপাশি নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যাতে বিল্ডিং কোড মেনে ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেসব ভবনে ভূমিকম্প প্রতিরোধক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি, সেগুলোতে রেট্রোফিটিং-এর মাধ্যমে ভূমিকম্প সহনীয় করে তোলা বাধ্যতামূলক করা উচিত। এ ব্যাপারে বাড়িওয়ালা ও ভবন মালিকদের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে এবং তা কার্যকর হয়েছে কিনা সরেজমিনে তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। সারাদেশে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে বাসাবাড়ি ভূমিকম্প সহনীয় কিনা তা যাচাই করতে হবে। কোনো বাসা খারাপ অবস্থায় থাকলে তা মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, ভূমিকম্পে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মারা যায় বাসাবাড়ি ধসে। ফায়ার সার্ভিসকে এখন থেকেই দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে। তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শত শত বছর ধরে যে ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে তা রক্ষার ক্ষেত্রে তেমন কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। ভূমিকম্পের মতো মহাদুর্যোগ পরবর্তী সময়ে যেসব উদ্ধার সরঞ্জামাদির প্রয়োজন, সেদিকে খুব কমই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কেবল করব, করছির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ ধরনের উদাসীনতা ও শৈথিল্য কাম্য নয়। গত সপ্তাহে দুই দুইবারের ভূমিকম্প এ বার্তাই দিয়ে গেল, যে কোন সময় আবার আঘাত হানতে পারে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করে সরকারসহ সকলকেই এখন থেকে সচেতন হতে হবে।

darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন