শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

উপযুক্ত সচেতনতা ও আইনি ব্যবস্থা মানবপাচার রোধ করতে পারে

সেলিনা আক্তার | প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

মানব পাচার একটি ঘৃণ্য অপরাধ। পাচারের শিকার শিশু ও নারীর মানবাধিকার নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের সংকটের কারণে নারী, শিশু ও বিভিন্ন বয়সি মানুষের পাচারের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের ব্যাপক সংকট থাকায় অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত নারী, পুরুষ ও শিশুরা প্রলোভনে পড়ে পাচারকারীদের চক্রান্তের শিকার হয়। প্রেম, বিয়ে কিংবা বিদেশে চাকরি দেওয়ার আকাশকুসুম প্রলোভন দেখিয়ে দালালরা পাচারের ফাঁদ পাতে। ভিকটিমের সঙ্গে প্রতারণা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও মুক্তিপণ আদায় পাচারের অন্যতম কারণ। তাছাড়া পাচারকারীরা মানব পাচারের সম্ভাব্য শিকারদের প্রলুব্ধ করার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেমন- টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে।

জোরপূর্বক শ্রম, যৌন দাসত্ব অথবা পাচারকৃত মানুষদের অমানবিক কাজে নিয়োজিত করার জন্য পাচারকে মানব পাচার বলা হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কতো মানুষ পাচারের শিকার হয়, তার সঠিক কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। তবে ইউরোপীয় কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে প্রবেশ করেছে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ। অভিবাসন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে ৫,০০০ মানুষ বাংলাদেশ থেকে উন্নত দেশগুলোয় যাওয়ার চেষ্টা করে।


ভৌগোলিক কারণে মানব পাচারকারীদের জন্য বাংলাদেশ একটি সুবিধাজনক স্থান। এটি উপসাগরীয় অঞ্চলের কাছে অবস্থিত যা দক্ষিণ এশিয়ার সাথে সংযুক্ত। পাচারকারীরা সীমান্তবর্তী ১৬টি জেলাকে মানব পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করে। ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কম বেশি ২৫ হাজার পাচারের শিকার হয়েছে শুধু কক্সবাজার জেলায় থেকে। উচ্চ বেকারত্ব, সীমিত কর্মসংস্থান শিক্ষা ও সচেতনতা এবং দারিদ্র্যের কারণে এ অঞ্চলে মানব পাচারকারীরা অসহায় মানুষকে মিথ্যা প্ররোচণার মাধ্যমে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে পাচার করে থাকে। নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি পাচারের ঝুঁকিতে থাকে। তাদের সুরক্ষা খুব কম।

একাধিক গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাদক ব্যবসা ও অস্ত্রপাচারের পর মানবপাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম। মানবপাচারের সঙ্গে প্রথম দুটি অপরাধও প্রায়ই জড়িয়ে থাকে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রগুলোর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল কার্যক্রম হচ্ছে মানব পাচার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এই অপকর্মের জন্য ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। সম্প্রতি ইন্টারপোল ‘অপারেশন লিবারটেররা’ নামক অভিযানের বিস্তারিত জানিয়েছে, যেখানে বেশ কয়েকটি দেশের কর্তৃপক্ষ একসঙ্গে কাজ করে মানব পাচারের শিকার ৪৩০ জনকে উদ্ধার ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অপরাধে ২৮৬ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম এবং অনুচ্ছেদ ১৮ অনুযায়ী পতিতাবৃত্তিরোধ এবং দমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং অনুচ্ছেদ (২৭-৪৪) এ বেশ কয়েকটি মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সে কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র মানবপাচার প্রতিরোধ ও প্রতিকারে দায়বদ্ধ। ঝউএ তিনটি লক্ষ্য সরাসরি মানব পাচার দমন এবং প্রতিরোধের সাথে সংশ্লিষ্ট। সেগুলি হলো, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন (অভীষ্ট-৫); সকলের জন্য পূর্ণও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং সহনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন (অভীষ্ট-৮) এবং উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা তৈরি,সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ তৈরি করা এবং সকল পর্যায়ে কার্যকর জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গঠন (অভীষ্ট-১৬)। কয়েক বছরে বাংলাদেশ সরকার মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ভালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে এবং পাচারের শিকার অনেককে উদ্ধারও করতে পেরেছে। একটি মার্কিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সাফল্যের কারণে মানব পাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে দুই ধাপ উন্নীত করা হয়েছে। এ অবস্থায় উন্নীত হওয়ার কারণ হচ্ছে মানব পাচার প্রতিরোধে বিভাগীয় জেলা ও মহানগরের জন্য ৭টি ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ।

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন প্রণীত হয়েছে ২০১২ সালে, যেখানে একই সাথে অপরাধ ও বিচার পদ্ধতির বিস্তারিত বিধান আছে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে জাতীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি রয়েছে। তাছাড়া, জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক সভাপতি, প্রবাসী কল্যাণ কর্মকর্তা সদস্য সচিব, উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও সভাপতি, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সদস্যসচিব এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে চেয়ারম্যান সভাপতি, ইউপি সচিবকে সদস্য সচিব করে কমিটি গঠন করা হয়েছে, যাদের দায়িত্ব মূলত নিয়মিত বৈঠক করাসহ সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনি সহায়তা প্রদান ও সার্ভাইভের পুনর্বাসন, নিরাপত্তাবিধান প্রভৃতি। নিরাপদ অভিবাসনের প্রচারণা বাড়ানোর মাধ্যমে মানব পাচারের ঝুঁকি কমানোর উপযোগিতা এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের উচিত সম্ভাবনাময় অভিবাসীদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ করা এবং তাদের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দেশ ত্যাগের আগে অভিবাসীদের আরও উন্নত ও প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহায়তা করা এবং বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যও বিনিয়োগ করা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দিনশেষে, এই অপরাধের প্রকৃতি বিচারে এবং পাচারকারীদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক বিবেচনায়, সরকারকে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সুসংগঠিত মানবপাচার ও চোরাচালানের নেটওয়ার্কগুলোকে অকার্যকর করে এই অপরাধকে দমন করতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভিক্টিমস অব ট্রাফিকিং অ্যান্ড ভায়লেন্স প্রোটেকশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানব পাচার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছর পাঁচটি ধাপে ‘ট্রাফিকিং ইন পারসন’ (টিআইপি) শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। প্রতিবেদনে মানবপাচার মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের উদ্যোগ ও সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর ১৮৮টি দেশের র‌্যাংকিং করে থাকে। তাদের র‌্যাংকিংয়ের মানদ- অনুযায়ী, যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণকারী দেশগুলো স্থান পায় প্রথম ধাপে (টায়ার ওয়ান) পাচার রোধে সব উদ্যোগ না নিতে পারলেও উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণকারীদের স্থান হয় দ্বিতীয় ধাপে।

বাংলাদেশের জন্য মানব পাচারের বিষয়টি অনেক উদ্বেগজনক। মানবপাচার সংক্রান্ত সংবাদ যেন মিডিয়ার নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। ছয় হাজারের বেশি মানব পাচার মামলা রয়েছে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দেশে গত ৮ বছরে ৬ হাজার ১৩৪টি মামলা হয়েছে। তবে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৩৩টি। বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৫ হাজার ৯০১টি মামলা। এর মধ্যে ৩৩টি মামলায় মাত্র ৫৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। জীবিকার মান উন্নয়ন ব্যতীত মানবপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেডে যেমন-মৎস্য চাষ, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালন, গবাদি পশু হৃষ্টপুষ্টকরণ, ভ্রাম্যমাণ কম্পিউটার প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করছে। উপবৃত্তি প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা অর্জনে সহায়তা করছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা বা স্বামী নিগৃহীত ভাতা এবং অসচ্ছল শনাক্তকৃত প্রতিবন্ধী ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভিজিডি আওতায় দুঃস্থ, অসহায় ও হত-দরিদ্র, স্বামী পরিত্যাক্তা এবং বিধবা মহিলাদের প্রতিমাসে পুষ্টি সমৃদ্ধ চাল বিতরণ ছাড়াও আয় বর্ধনমূলক প্রশিক্ষণসহ ভাতা প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প আমার বাড়ি আমার খামারের সমিতির মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে সাধারণ ঋণ দেওয়া হচ্ছে, যাতে সমাজের কেউ পিছিয়ের না পড়ে। তাছাড়া, ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। যেগুলো সার্বিকভাবে নিঃসন্দেহে মানব পাচার হতে রক্ষা পেতে অবদান রাখছে।

তবে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস আরও শক্তিশালী করা জরুরি। সকল পর্যায়ের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জনবল বৃদ্ধিসহ, যানবাহন সংখ্যা এবং বিশেষ করে কোস্টগার্ডের টহল বোট সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তদুপরি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের মানবপাচার বিষয়ক কর্মশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা গেলে মূল্যবান ভূমিকা পালন করবে। যেসকল পথে বা পয়েন্টগুলো দিয়ে সাগর পথে মানব পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে সে সকল জায়গা আলোকিত করে সিসিটিভির আওতায় আনা যেতে পারে। মানব পাচার বিষয়ক নিয়মিত সভা এবং এতে সংশ্লিষ্ট সকলের আরও কার্যকর অংশগ্রহণ দরকার। মানব পাচার চক্রান্তে জড়িতদের ট্রাইব্যুনালের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালের জনবলও বাড়ানো প্রয়োজন।


লেখক: নিবন্ধকার

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন