দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রে সিস্টেম এখনো সেকেলে ও ক্রিটিকালই রয়েছে। ফলে মানুষের পদে পদে ব্যাপক হয়রানি ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সে সুযোগ দুর্নীতি বাড়ছে। দেশের সার্বিক উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে। আয় বৈষম্য বাড়ছে! সম্প্রতি টিআইয়ের দুর্নীতির ধারণা সূচক-২০২২ মতে, বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২তম, স্কোর ২৫, যা গত বছরের চেয়ে একধাপ অবনমিত হয়েছে। স্কোরের ক্রম অনুসারে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৭তম (আগের বছরও একই ছিল)। বিবিএক্স ২০২২-২৩ জরিপ মতে, বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি, বরং গত এক বছরে তিনটি সূচকে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে অবস্থা আরো খারাপ! এ জন্য যতটা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববানরা দায়ী, তার চেয়ে অধিক দায়ী সিস্টেম। যেমন: আমার এক বন্ধুর আত্মীয় আব্দুর রশিদ প্রামাণিক সোনালী ব্যাংক, নওগাঁ শাখায় চাকরি করতেন। তিনি উক্ত ব্যাংকের সিবিএ’র জেলা শাখার সেক্রেটারি ছিলেন। সর্বোপরি তিনি শ্রমিক লীগের নওগাঁ জেলারও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি খুব পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি তাঁর অফিসের পেনশনসহ যাবতীয় পাওনার নমিনি করেছিলেন স্ত্রীকে। উপরন্তু ব্যাংক একাউন্টেরও নমিনি করেছিলেন স্ত্রীকে। অবসর গ্রহণের কিছুদিন পর তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বগুড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দলীয়ভাবে তাঁর দ্বিতীয় জানাজায় আ’লীগের এমপি, নেতৃবৃন্দ ও ব্যাংকের লোকরাসহ শহরের বিপুল সংখ্যক মানুষ শরীক হন। জনাব রশিদের মৃত্যুর পর তাঁর পেনশন ও ব্যাংক একাউন্টের মালিক হন নমিনিধারী ব্যক্তি তথা স্ত্রী। তিনি মরহুম স্বামীর পেনশন ও ব্যাংকের একাউন্টের টাকা তার একাউন্টে স্থানান্তর করার আবেদন করেন স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেটসহ। কিন্তু এখনো গত ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা মঞ্জুর হয়নি। ব্যাংক থেকে আজ বলছে, অমুক কাগজ দেন, কাল বলছে ওয়ারিশানের যাবতীয় কাগজপত্র দেন ইত্যাদি। মরহুম রশিদের দু’ ছেলে। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকায় ব্রিটিশ কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছোট ছেলে ডাক্তার। বগুড়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষক। তারা যাচিত কাগজ পত্র জমা দিয়েছেন। উপরন্তু মা ও ছেলেরা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে বহুবার সাক্ষাৎ করে তাদের সমস্যার কথা বলেছেন। তবুও উক্ত আবেদন মঞ্জুর হয়নি। ফলে তারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। উপরন্তু দু’ ছেলে ঢাকা ও বগুড়া থেকে নওগাঁ যাতায়াতের ব্যয় বহন করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে চলেছে। ছুটি পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। তবুও তারা সহসাই কামিয়াব হতে পারবেন কি-না বলা কঠিন। কারণ, ফাইল নওগাঁ-রাজশাহী-ঢাকা চালাচালি হচ্ছে। অথচ, মরহুমের ক্রয়কৃত একটি জমির দলিল রেজিস্ট্রি করা আছে স্ত্রীর নামে। তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। স্ত্রী ভোগ করছেন। তাহলে পেনশনের ও ব্যাংকের একাউন্টের ক্ষেত্রে ভোগান্তি হচ্ছে কেন? কারণ, সিস্টেম। এই সিস্টেমের কারণে শুধু মরহুম রশিদের পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, সে সাথে চাকরিজীবীদের মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাদের প্রায় সকলেরই একই অবস্থা হচ্ছে। এছাড়া, অনেক মানুষ চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পরও দীর্ঘদিন পাওনাদি পাচ্ছেন না।
অপরদিকে, ব্যাংকে একাউন্টধারীদের মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাদের নমিনিগণও মরহুমের একাউন্টের টাকা তুলতে গিয়ে চরম হয়রানির শিক্ষার হচ্ছেন। সম্প্রতি একটি ব্যাংকে গিয়েছিলাম এক কাজে। সে সময় হেলপ ডেস্কে এক ছেলে এসে বললেন, আমার মায়ের একটি একাউন্ট ছিল এখানে। তিনি মারা গেছেন কিছুদিন আগে। তার একাউন্টের নমিনি হচ্ছেন আমার বাবা। এখন তিনি টাকাটা তুলে নিয়ে একাউন্টটি ক্লোজ করতে চান। এ জন্য কি করতে হবে? প্রতিত্তোরে বলা হলো, কি নাম তার? ছেলেটি নাম বলতেই একাউন্ট খুঁজে বের করে বলা হলো, একাউন্টে চার হাজার টাকা আছে। নমিনি স্বামী। এই টাকা তুলতে হলে ফরম পূরণ করতে হবে বলে তা দিলেন এবং বললেন, নমিনির জাতীয় পরিচয় পত্র, ছবি, মরহুমার মৃত্যুর ডেথ সার্টিফিকেট এবং শ্বশানে দাহ করার সনদ লাগবে (মরহুমা হিন্দু মহিলা)। ছেলেটি বললেন, মাকে দাহ করা হয়েছে পাবনার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেখানে শ্বশানে দাহ করার সনদের কোনো ব্যবস্থা নেই। বলা হলো, সেটা লাগবেই। তারপর ছেলেটি বললেন, বাবা থাকেন পাবনায়। তিনি ঢাকায় এসে একদিনেই কি টাকা তুলতে পারবেন? ব্যাংক থেকে বলা হলো, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন ছেলেটি বললেন, চার হাজার টাকা তোলার জন্য যদি পাবনা থেকে ঢাকায় ২-৩ বার আসতে হয়, তাহলে পাওনার দ্বিগুণ টাকা ব্যয় হয়ে যাবে!
বর্ণিত অবস্থা শুধু ব্যাংকেই নয়, সব ক্ষেত্রেই একই অবস্থা। এর জন্য দায়ী সিস্টেম। তাই সিস্টেম পরিবর্তন করে মানবিক করতে হবে। কারো মৃত্যুর পর তার নমিনিকে পাওনাদি দিতে হবে আবেদন করার এক সপ্তাহের মধ্যে। এতে যে কর্মকর্তা ব্যর্থ হবে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার বিধান করতে হবে। অথবা নমিনি করার পদ্ধতি বাতিল করতে হবে! মূলা ঝুলিয়ে রেখে লাভ কি? অন্যদিকে, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার ৭ দিনের মধ্যে তার পেনশনের পাওনাদি পরিশোধ করার বিধান করে কার্যকর করতে হবে। ব্যর্থতায় সংশ্লিষ্টদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
ব্যাংকে একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রেও হয়রানির অন্ত নেই। এটাও সিস্টেমের অভাবে। এ জন্য জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি, ছবি, স্বাক্ষর এবং নমিনির জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি, ছবি এবং স্বাক্ষরই যথেষ্ট। সেখানে অন্য একজন একাউন্টধারীর স্বাক্ষর ও একাউন্ট নম্বর লাগবে কেন? বিকাশ, নগদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তো এসব লাগে না। কারণ, সেসব আধুনিক। তাই শুধু জাতীয় পরিচয় পত্রের নম্বর দিলেই একাউন্ট খোলা এবং বিপুল টাকা যখন তখন লেনদেন করা যায়। এমনকি কিছুদিন আগে সরকারি ব্যাংকে ১০ টাকা দিয়ে শিক্ষার্থী ও কৃষকদের একাউন্ট খোলার নিয়ম করা হয়েছিল জাতীয় পরিচয় পত্রের/জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি ও ছবি দিয়েই। এরূপ ব্যবস্থা সবার ক্ষেত্রেই করতে হবে। তাহলেই মানুষের ভোগান্তি দূর হবে।
চাকরির আবেদনের সাথে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, ছবি, ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিকত্ব সনদ, গেজেটেড অফিসার কর্তৃক চারিত্রিক সনদ, জাতীয় পরিচয় পত্র ইত্যাদির ফটোকপি গেজেটেড অফিসার কর্তৃক সত্যায়িত করার রীতি রয়েছে। কিন্তু এসব গ্রাম-গঞ্জের প্রার্থীদের করা খুব কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। দ্বিতীয়ত: জাতীয় পরিচয় পত্র হওয়ার পর তাতে যেহেতু ছবি এবং পিতা-মাতার নামসহ স্থানীয় ও স্থায়ী পূর্ণ ঠিকানা রয়েছে, সেহেতু ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিকত্বের সনদের দরকার কেন? তৃতীয়ত: গেজেটেড অফিসার কর্তৃক চারিত্রিক সনদের দরকার কী? এ পর্যন্ত কোন অফিসার কি কারো সনদে বলেছে, চরিত্র খারাপ? বলেনি। তাহলে দরকার কী? চতুর্থ শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের ফটোকপি এবং ছবি সত্যায়িত করতে হবে কেন? ভাইবা পরীক্ষার সময় অরিজিনাল সার্টিফিকেট তো দেখাতেই হয়। উপরন্তু তখন তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকেন। তাহলে এসব সত্যায়িত করতে হবে কেন? তাই এসব সিস্টেম পরিবর্তন করে সহজ তথা শুধু ছবি, শিক্ষাগত যোগ্যতার এবং জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি দেয়ার নিয়ম করতে হবে। তাহলে চাকরি প্রার্থীরা হয়রানি থেকে মুক্ত হবে। সর্বোপরি চাকরির আবেদন করার তারিখ শেষ হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। কারণ, সময় বেশি অতিবাহিত হওয়ায় অনেকের বয়স শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন পদ শূন্য থাকায় কাজের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তবুও সরকারি অফিসে শূন্য পদের সংখ্যা ব্যাপক। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গত ১৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেছেন, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য মতে, ‘সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও অফিসে বেসামরিক জনবলের ৩,৫৮,১২৫টি পদ শূন্য রয়েছে’। এই ব্যাপক পদের শূন্যতা নতুন নয়। বছরের পর বছর থেকে শূন্য রয়েছে। এতে কাজের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে, বেকারের দিক দিয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তারা গলগ্রহ হয়ে জীবন যাপন করছে। অনেকেই বিপথে যাচ্ছে! তবুও সরকারি অফিসে নিয়োগ হচ্ছে না, যা দেশের উন্নতির চরম অন্তরায়। তাই কোন পদ শূন্য হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে পূরণ করতে হবে অথবা তা বিলুপ্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যে ব্যর্থ হবে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার বিধান করে তা কার্যকর করতে হবে। তবেই প্রশাসন গতিশীল হবে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিয়োগ পত্র দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পুলিশ ভেরিফিকেশন করার নিয়ম রয়েছে (পাসপোর্ট করতেও)। কিন্তু এতে সময় নষ্ট, ভোগান্তি ও দুর্নীতি হয়। সর্বোপরি এতো কিছু করার পরও নিয়োগপ্রাপ্তরা কি অপরাধ করে না? নিশ্চয় করে অনেকেই। অথচ বেসরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয় না। তাই বলে কি তাদের চাকরির পারফরমেন্স খারাপ? নিশ্চয় নয়। অপরদিকে, পদ শুন্য থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি না পেয়ে অনেক কর্মচারী একই পদে থেকে অবসর গ্রহণ করছে বিপুল আর্থিক ক্ষতি ও বুক ভরা জ্বালা নিয়ে। ফলে অনেকের মধ্যে কর্মস্পৃহা লোপ পাচ্ছে। এ জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চরম অদক্ষতা, কাজের প্রতি অবহেলা ও জবাবদিহির অভাব। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। পদ শূন্য হওয়ার সাথে সাথে তা নিয়োগ অথবা পদোন্নতি দিয়ে পূরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
জমি বা সম্পদ ক্রয় করার পর দলিল রেজিস্ট্রি করতে হয়।তাতে ছবি, জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি ইত্যাদি লাগে। উপরন্তু দলিলের নকল পেতে অনেক সময় লাগে। সেই সাথে কিছু উপঢৌকন, মহুরীর ফি ও অনেক ঘোরাঘুরি করতে হয়। কিন্তু দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার সাথে সাথেই তার ফটোকপি করে তা স্বাক্ষর ও সিল দিয়ে ক্রয়কারীকে দেওয়ার নিয়ম করা হলে হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতির অবসান ঘটবে। রেজিস্ট্রি অফিসে নকল নবিশেরও দরকার হবে না। ফলে ব্যয় কমবে। এভাবে দেশের সব ক্ষেত্রেরই সিস্টেম পরিবর্তন করে আধুনিক, মানবিক ও সহজ এবং প্রতিটি কাজ মানস্মতভাবে সম্পন্ন হওয়ার সময় নির্ধারণ করে তা কার্যকর করতে হবে। তবেই দুর্নীতি ও হয়রানি কমবে। মানুষের কল্যাণ হবে। দেশের সার্বিক ও টেকসই উন্নতি হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
sardarsiraj1955@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন