শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বৈদেশিক সহায়তা বাড়াতে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

দেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সিংহভাগ ভূমিকা পালন করে বৈদেশিক ঋণ বা সহায়তা। বড় ও মাঝারি ধরনের প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থ সহায়তা অনিবার্য হয়ে পড়ে। নিজস্ব অর্থে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বৈদেশিক সহায়তায় চলমান রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ সহায়তার পরিমাণ কমে গেছে। একটি দৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে বৈদেশিক সহায়তার ছাড় ও প্রতিশ্রুতি দুটোই কমেছে। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীরা ৩৭৮ কোটি ৫ লাখ ডলার ছাড় করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ কোটি ডলার কম। গত অর্থবছরে ঐ সময়ে অর্থছাড়ের পরিমান ছিল ৪১৭ কোটি ডলার। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, গত ছয় মাসে মাত্র ১৭৬ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৪০ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত অর্থ কম এসেছে ২৬৪ কোটি ডলার। প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় কমলেও বাড়ছে ঋণ পরিশোধের পরিমান। গত ছয় মাসে সরকার ১০৫ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে। অর্থনীতিবিদরা এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলেছেন, যেসব প্রকল্পের বিপরীতে বৈদেশিক সহায়তা আসার কথা, সেগুলোর বাস্তবায়নের গতি কম থাকায় অর্থ ছাড় কম হচ্ছে।
সাধারণত বৈদেশিক সহায়তার গতি বাড়ে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে সহায়তাকারি সংস্থাগুলো সহায়তা কমিয়ে দেয় বা অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হয়। আমাদের দেশে যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধীরগতি একটি স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। কোনো প্রকল্প হাতে নেয়া হলে তার যথাযথ বাস্তবায়নের সময়সীমা ঠিক থাকে না। পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সময় বাড়ানো হয়। এর মূল কারণ হিসেবে সবসময়ই চিহ্নিত হয়, প্রথমত প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা কিংবা দক্ষতার অভাব। দ্বিতীয়ত দুর্নীতি। এই দুই কারণেই প্রকল্প যথাসময়ে সম্পন্ন হয় না, হলেও তার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। উন্নয়নের প্রথম শর্ত হচ্ছে, যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা এবং সময়মতো তা বাস্তবায়ন করে জনগণের উপকারে কাজে লাগানো। এসব ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই পিছিয়ে আছি। এক প্রকল্পের কাজ শেষ হতে হতে এক জেনারেশন পর্যন্ত পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। এমনও দেখা গেছে, বৈদেশিক সহায়তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে না পারায় অর্থ ফেরত গেছে। সাধারণত যেসব প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর মতো প্রতিষ্ঠান সহায়তা করে, সেসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে তাদের তীক্ষè নজরদারি থাকে। কড়ায়-গন্ডায় হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয়। এক্ষেত্রে প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প থাকে না। প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘসূত্রীতা বা দুর্নীতির সুযোগ খুব কম থাকে। কিছু কিছু দেশ রয়েছে, যারা নিজেরা অর্থ নিয়ে নিজেরাই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। কিছু সংস্থা ও দেশ রয়েছে, যারা অর্থ সহায়তা দিয়ে দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর ছেড়ে দেয়। সেখানে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া কিংবা দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে যথাযথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না। পরিতাপের বিষয়, দেশে এখনও প্রকল্প বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত সক্ষম ও দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো এবং জনবল তৈরি করা সম্ভব হয়নি। প্রচুর সহায়তা পাওয়ার পরও তা ঠিকমতো ব্যয় করে প্রকল্প সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। এতে উন্নয়নের গতি ধীর হয়ে পড়ছে। অথচ সরকার যতই দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে, উল্লেখিত কারণগুলো পেছনে টেনে ধরছে। অর্থ পাওয়া যাচ্ছে, অথচ কাজে লাগানো যাচ্ছে না, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। এতে বিদেশি সহায়তাকারিরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে অর্থসহায়তা কমে যাওয়ার কারণ, তাদের আগ্রহে ভাটা পড়া। অথচ বৈশ্বিক সংকট এবং দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে প্রতিটি প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় ও যথাসময়ে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অধিক তৎপর হওয়া জরুরি।
দেশে এখন চরম ডলার সংকট চলছে। এই সংকটে আমদানির গতিও শ্লথ হয়ে পড়েছে। অনেকে এলসি খোলা বন্ধ রেখেছে। সরকারের তরফ থেকেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেশ ধীর হয়ে পড়েছে। উৎপাদন ব্যহত হওয়াসহ পণ্যমূল্যও অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈদেশিক সহায়তা কমে যাওয়া দুঃসংবাদই বটে। এ সময়ে বিদেশি সহায়তা বৃদ্ধি পেলে দেশের ডলার সংকটও অনেকটা কেটে যেত। বৈদেশিক সহায়তা কমায় সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠবে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, বৈদেশিক অংশের অর্থের খরচ বাড়ছে না। এর মূল কারণ হতে পারে, প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দক্ষতার অভাব। তার এ কথা থেকে বোঝা যায়, বৈদেশিক অর্থ ব্যবহারে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের যথাযথ দক্ষতা নেই। বেশ কিছুদিন ধরে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিপুল বৈদেশিক অর্থসহায়তা পাইপ লাইনে রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অর্থ এলেও যদি তা যথাযথভাবে ব্যবহার না করা যায়, তাহলে তা অর্থহীন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। বৈদেশিক সহায়তা বৃদ্ধি করতে হলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দক্ষ করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থ বরাদ্দ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে না পারা দেশের জন্য বদনামেরও বিষয়। এ বদনাম ঘুচাতে প্রত্যেক প্রকল্পে দক্ষ ও সক্ষম জনবল গড়ে তুলতে হবে। যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে হবে না কিংবা বৈদেশিক সহায়তা কমে যাবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন