বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের নূন্যতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকতে হবে। তবে এবার এ মানদণ্ড বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রকাশিত ৪৮ তম বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) মোট ৬ হাজার তিনশত ৮৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ২৬৬ জন। অর্থাৎ প্রতি ২৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন করে শিক্ষক রয়েছেন। সে হিসেবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২৪। ফলশ্রুতিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এর দরুণ শিক্ষার্থীদেরকে ভোগতে হচ্ছে সেশনজট, দেরিতে ক্লাস শুরুসহ বহুমুখী সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে দূর্বিষহ পড়ছে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন।
বিদেশে উচ্চ শিক্ষার আইন অনুযায়ী বিদেশে গমনকারী শিক্ষকরা বৈতনিক, অবৈতনিকসহ বিভিন্নভাবে সর্বোচ্চ ৪ বছর পর্যন্ত ছুটি নিতে পারেন। এ সময়ে কারও ডিগ্রি বা গবেষণা শেষ না হলে আরও ২ বছরের অবৈতনিক ছুটি দেয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১৯ জন সহযোগী অধ্যাপক, ৩১ জন সহকারী অধ্যাপক ও ১২ জন প্রভাষক শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন।কিন্তু তাদের এ ছুটির বিপরীতে নেই কোন অস্থায়ী পদ। ফলে প্রতিটি বিভাগে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত আরো কমে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের মোট ৩৯৮ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছে ৯ জন। সেই হিসেবে এই বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৪৪ অর্থাৎ ৪৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত শিক্ষার মানদণ্ডের ধারে কাছেও নেই এই বিভাগটি। এই বিষয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সরকার বলেন, শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষকদের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল এটা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। কর্তৃপক্ষ যদি পর্যাপ্ত পরিমানে শিক্ষক নিয়োগ না দেয় তাহলে এই মানদণ্ড বজায় রাখা কঠিন। এই মানদণ্ড বজায় রাখতে হলে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। প্রশাসন যদি শিক্ষক নিয়োগ দেয় তাহলে এই সংকটগুলো কমে আসবে।
একই পথে হেটেছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ২৯৮ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ৭ জন অর্থাৎ গড় অনুপাত ১:৪৩। অবস্থানে তৃতীয় আছে আইন বিভাগ ৩০৮ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছে মাত্র ৯ জন যার গড় অনুপাত ১:৩৯।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নেই মার্কেটিং , নৃবিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি, ব্যবস্থাপনা শিক্ষা, প্রত্নতত্ত্ব, এ আই এস, গনিত, রসায়ন, অর্থনীতি বিভাগে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের। এই বিভাগের ২৯১ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছে ১৭ জন যার গড় অনুপাত ১:১৭ ; তারপরে রয়েছে ফার্মেসি বিভাগ ১:১৮। এছাড়াও যেসকল বিভাগ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখেছেন তার মধ্য পদার্থবিজ্ঞান ১:২০, পরিসংখ্যান বিভাগ ১:২০ এবং লোক প্রশাসন বিভাগ ১:২০। অর্থাৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি অনুষদের অধীনে ১৯ বিভাগ রয়েছে যার মধ্য ১৪ বিভাগ এই অনুপাত বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান অপু বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবছরে ক্রমান্বয়ে ব্যাচ বাড়লেও শিক্ষকের সংখ্যা সে অনুপাতে বাড়েনি। যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অনেকটা পিছিয়ে। অপ্রতুল শিক্ষক নিয়ে বিভিন্ন টানাপোড়নে একেকটা ব্যাচ অনার্স শেষ করতে নির্দিষ্ট সময়েরও বেশি সময় লেগে যায় যার ফলে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন যেখানে ১২ তম ব্যাচের বাংলা এবং বিজনেস ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থীরা ৪৫ তম বিসিএসের আবেদন করতে পারলেও আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা তা পারে নি। শিক্ষক অপর্যাপ্ততার কারণে বেশিরভাগ ব্যাচ সপ্তাহে ৩-৪ টি ক্লাসও করার সুযোগ পায় না। বর্তমানে যারা শিক্ষক হিসেবে আছেন তারা ক্লাস নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের কিছু শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ দিলেও শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বরাবরের মতই অনেক পিছিয়ে। শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রম, যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের অনার্স শেষ করা এবং শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প আর কিছু হয়না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক ড. মোহা. হাবিবুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান প্রশাসন বদ্ধপরিকর। এক্ষেত্রে যেসব বিভাগে শিক্ষক সংকট রয়েছে তারা যদি প্রশাসনের কাছে শিক্ষক চাহিদা জানায় তাহলে প্রশাসন সে হিসেবে ব্যবস্থা নিবে। শিক্ষকের স্বল্পতার কারনে শিক্ষকদের যেমন অতিরিক্ত চাপ নিতে হয় তেমনি শিক্ষার্থীদেরও নানা রকম দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাই প্রশাসন এই বিষয়ে গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়ে পর্যাপ্তপরিমানে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমানো যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, প্রতিটি বিভাগে যে পরিমান প্রতি বছর শিক্ষার্থী ভর্তি হয় সেটা কমানোর সুযোগ নেই। শিক্ষক- শিক্ষার্থীর এই অনুপাত বজায় রাখার জন্য আমরা ইউজিসির কাছে ইতোঃপূর্বে আমাদের চাহিদা দিয়েছি এবং পুনরায় আবার দিব। যাতে করে আমাদের শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। তাহলে আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে পারব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন