‘আদর্শ প্রকাশনী’ বলে যে বই প্রকাশনার একটি প্রতিষ্ঠান আছে, সে কথা আমি জানতাম না। বস্তুত আদর্শ প্রকাশনী কেন, শত শত প্রকাশনীর নাম আমি জানি না। শুধু আমি কেন, আমার মতো অনেক কলামিস্ট এবং লেখক এই শত শত প্রকাশনী সংস্থার নাম জানেন না। জানা সম্ভবও নয়। পত্রপত্রিকার পাতায় দেখলাম, এবারের বইমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি ৬০০ স্টল বরাদ্দ করেছে। এখন আপনারাই বলুন, এই ৬০০ স্টলের নাম মনে রাখা কি সম্ভব? আসলে এই ৬০০ প্রকাশনীর নাম জোগাড় করাই তো একটি দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই আদর্শ প্রকাশনীর নাম আমি জানতাম না, এটি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এখনো এই সংস্থাটির অবস্থান, কর্মকর্তাবৃন্দের নাম এবং টেলিফোন নাম্বার, কিছুই আমি জানি না। কিন্তু তারপরেও দেখছি, আদর্শ প্রকাশনীর নামে বইমেলায় কোনো স্টল বরাদ্দ না হওয়া সত্ত্বেও এই সংস্থাটির নাম যেন এবার অন্য সব সংস্থাকে ছাপিয়ে গেছে। কারণ, পত্রিকার খবর থেকে জানা যায় যে, অতীতে গত ৪/৫ বছরে এই সংস্থাটি রেগুলার স্টল বরাদ্দ পেয়েছে এবং তারা নিয়মিত ব্যবসাও করেছে। কিন্তু এইবার তাদের কোনো স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এই খবরটি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর স্টলের মালিক বাংলা একাডেমির কাছে বরাদ্দের জন্য পুনরায় আবেদন করেন। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, দ্বিতীয় বার আবেদন করা সত্ত্বেও তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তখন আদর্শ প্রকাশনী বরাদ্দের আবেদন জানিয়ে হাইকোর্টে রিট করে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী হাইকোর্ট তাদের স্টল বরাদ্দ করার জন্য বাংলা একাডেমিকে নির্দেশ দিয়েছে। তবে শর্ত দিয়েছে যে ৩টি বই তাদের স্টলে অর্থাৎ এবারের বইমেলায় বিক্রি করা যাবে না। এই ৩টি বইয়ের নাম কি? বই ৩টিতে কী বিষয় আছে? এসব ব্যাপারে একটু পরে কথা বলছি। তার আগে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা।
যে ৩টি বই বইমেলায় বিক্রি করা যাবে না বলে বলা হয়েছে, সেই ৩টি বই কি মেলার বাইরে ঢাকা এবং বাংলাদেশের অন্যত্র বিক্রি করা যাবে কি না। বিক্রি না করার তো কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। সাধারণত সরকার কোনো বই নিষিদ্ধ করলে বা বাজেয়াপ্ত করলে একমাত্র তখনই সেই বইটি বিক্রি করা যায় না। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ফলে বাজারে ঐ নামে যেসব বই আছে সেগুলো উঠিয়ে নেয়া হয়। এর পরেও যদি কেউ বই বিক্রি করার চেষ্টা করেন তাহলে আইন অনুযায়ী তার দ- হয়।
কিন্তু এর বিপরীতেও আরেকটি কথা আছে। সরকার কোনো বই নিষিদ্ধ করলে সেই বই নিষিদ্ধ করার সপক্ষে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখাতে হয়। এবং সেই বইয়ের লেখক বা প্রকাশনী সংস্থাকে সেই সব সুনির্দিষ্ট কারণ জানাতে হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট প্রকাশনী সংস্থা বা লেখক নিষিদ্ধের সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারেন। আদালতেও তারা নি¤œ আদালত, উচ্চ আদালত এভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেয়ে ন্যায়বিচার চাইতে পারেন।
বই নিষিদ্ধ করা বা বাজেয়াপ্ত করার অনেক ঘটনা দেশে বা বিদেশে রয়েছে। সেই সব নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি বা সংস্থাসমূহ আইনের আশ্রয় নিয়েছেন এবং আদালত নিষিদ্ধ ঘোষণার আদেশকে বেআইনী ঘোষণা করেছেন এবং বইটির মার্কেটিংয়ের ওপর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছেন। আপনারা সকলেই এসব ঘটনা জানেন। তবে এই ধরনের ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো একটি বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা। বইটির নাম হলো খধফু ঈযধঃঃবৎষু’ং খড়াবৎ. আমাদের পাশের দেশেও আছে। বইটির নাম হলো ‘রাত ভরে বৃষ্টি’। আমাদের দেশেও তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ নামের বইটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। প্রথম ৩টি বইয়ের মধ্যে প্রথম দুইটি বইয়ের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। কিন্তু লজ্জার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়নি।
॥দুই॥
যে ৩টি বইয়ের বিরুদ্ধে আপত্তি উঠেছে সেগুলো হলো, (১) ফাহাম আবদুস সালামের লেখা, ‘মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’, (২) জিয়া হাসানের, ‘উন্নয়ন বিভ্রম’, এবং (৩) ফয়েজ আহমেদ তৈয়বের ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’। এই ৩টি বই বাদ দিয়ে আর্দশ প্রকাশনী মেলায় স্টল দিতে পারে। এখন সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, সেটি হলো, এই যে ৩টি বইকে বাদ দিতে বলা হলো এই ৩টি বইকে কি সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে? এই কলাম লেখার সময় পর্যন্ত আমরা যতদূর জানি, সেই খবর মোতাবেক এই বইগুলোকে সরকার এখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। তাহলে কোনো পুস্তক নিষিদ্ধ ঘোষণা না করে সেই পুস্তক বিক্রিতে বাধা দেওয়া হয় কীভাবে? কোন আইনে?
তিনটি বইয়ের মধ্যে ফাহাম আবদুস সালামের লেখা মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে নামক পুস্তকটি সম্পর্কে আমার বা আমাদের কিছু জানা নাই। বইটি পড়ারও সুযোগ হয়নি। এটির কেন্দ্রীয় উপজীব্য যে কী সেটিও আমাদের জানা নাই। অবশিষ্ট যে দুটি বইয়ের নাম দেওয়া হয়েছে সেই দুটি বই তো অর্থনীতি সম্পর্কে। এসব বইও আমি বা আমরা হাতে পাইনি। তাই বইয়ের কন্টেন্ট সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বই দুটির নাম দেখে মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে এই সরকার যে বয়ান দিচ্ছে সেই বয়ানের সাথে লেখকরা একমত নন। সেটি হতেই পারে। তাই বলে সেজন্য বইগুলোকে স্টলে না রাখার নির্দেশটি কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে সেটি পরিষ্কার হচ্ছে না। আমার তো মনে হচ্ছে যে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে, তারপর বই বিক্রি বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এখানে করা হয়েছে উল্টোটি।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে এই সরকার যে বয়ান দিচ্ছে সেসম্পর্কে শুধুমাত্র আলোচ্য এই দুই লেখকই যে একমত নন তাই নয়, বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দল, অনেক অর্থনীতিবিদ এবং অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও একমত নন। তাই আমরা মনে করি যে, সরকারের উচিত আগে বইগুলি নিষিদ্ধ করুক। তারপর বইমেলায় বিক্রি বন্ধ করুক। সরকার নিষিদ্ধ করলে লাভ হবে এই যে, প্রকাশক বা লেখকরা আদালতে যেতে পারবেন। সেখানেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে, যে সরকারের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে সমালোচনা করা কোনো অপরাধ কিনা।
আমাদের সাধারণ জানা মতে, কয়েকটি বিষয় লঙ্ঘন করলে বই প্রকাশ বা মতামত প্রকাশ আইন এবং সংবিধানের লঙ্ঘন হতে পারে। এগুলো হলো (১) কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষোদ্গার, (২) দেশের সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ কথা বলা, (৩) দেশের আদালত তথা বিচার বিভাগের সমালোচনা বা নিন্দা করা এবং (৪) সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলা। মোটামুটি এই ৪ ক্যাটাগরির যে কোনো একটি ক্যাটাগরিতে পড়লে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। এখন সরকার আলোচ্য ৪ ক্যাটাগরির যে কোনো একটি ক্যাটাগরিতে ফেলে বই প্রকাশ বা মতামত প্রকাশ নিষিদ্ধ করলেই হবে না। নি¤œ আদালত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত এর চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। তারপরেই সে সম্পর্কে মহামান্য আদালত তাদের রায় দেবেন।
॥তিন॥
আসলে এটিই হলো বইমেলার মৌসুম। কলকাতাতেও এখন বইমেলা হচ্ছে। আমরা জেনে তাজ্জব হয়েছি যে, আদর্শের ঐ ৩টি বই কলকাতা বইমেলাতেও যেন বিক্রি করা না হয় তার জন্য কলকাতা বইমেলা কর্তৃপক্ষের কাছেও নাকি বাংলাদেশের বইমেলা কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়েছে। কোন অধিকারে, কোন এখতিয়ারে ঢাকার বইমেলা কর্তৃপক্ষ কলকাতার বইমেলা কর্তৃপক্ষকে এমন চিঠি দিল? আমরা তো জানি, নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে অনেক লাইব্রেরি আছে যেখানে বাংলাদেশের সব ধরনের বই পাওয়া যায়। নিউইয়র্কে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি বাস করেন। বাস করেন ভারতীয় বাঙালিরাও। নিউইয়র্কের পুঁথিঘর নামক লাইব্রেরিটি বাংলাদেশিদের কাছে বহুল পরিচিত একটি নাম। নিউইয়র্ক, লন্ডন, টরোন্টো, মন্ট্রিয়েল, সিডনি, ক্যানবেরা প্রভৃতি বিশ^বিখ্যাত স্থানেও এখন বাংলাদেশের গল্প উপন্যাস এবং প্রবন্ধের বই কিনতে পাওয়া যায়। তো এইসব জায়গার লাইব্রেরিতে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ কি ঐ তিনটি বই বিক্রি ঠেকাতে পারবে? আর এখন কে না জানে যে ইচ্ছা করলে কোনো বই পিডিএফ কপি করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
আসলে আদর্শ প্রকাশনীকে এবারের বইমেলায় স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার উদ্গাতা করা? কোন গুপ্ত স্থান এই ধরনের মতামত প্রকাশের কণ্ঠরোধকারী সিদ্ধান্তের উৎসস্থল? পত্রপত্রিকায় সেই খবর এসেছে এবং মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছেন এটা জেনে যে, একটি মুখচেনা মহল যাদেরকে সাধারণত মানুষ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বা ঘাদানিকের হোমরা চোমরা বলে মনে করেন, তারাই নাকি বাংলা একাডেমিকে বলেছে, ঐ তিনটি বইকে মেলায় বিক্রি করতে দেওয়া যাবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আওয়ামী লীগ পলিটিক্যাল পার্টি হিসাবে প্রবীণ হলেও ইন্টেলেকচ্যুয়ালি অত্যন্ত নবীন এবং শিশু। তাই এরা ঘাদানিক তথা মস্কোপন্থী বামদের নিকট থেকে বুদ্ধি ধার নেয়। আর আদর্শ প্রকাশনীর এই বইগুলো মেলায় বিক্রি না করার সিদ্ধান্তও ঐ ঘাদানিকেরই ব্রেন চাইল্ড। এটি ঘাদানিকের অতি উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত।
আমার ধারণা, এই সিদ্ধান্তটি অযৌক্তিক। তারপরেও আদর্শ প্রকাশনীকে সিদ্ধান্তটি মানতে হয়েছে ব্যবসায়িক স্বার্থে। ঐ তিনটি বইয়ের কারণে তাদের অবশিষ্ট বইগুলো মেলায় বিক্রি হতে পারবে না, ব্যবসায়ী হিসেবে যেকোনো মানুষের পক্ষেই সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া কঠিন। তারপরেও তারা মানতে বাধ্য হয়েছে।
তবে এসব ক্ষেত্রে যা হয়, অর্থাৎ কোনো বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে বা তার বাজারজাতকরণে বাধা দিলে চোরাগুপ্তা পথে তার বিক্রি নাকি আরো বেড়ে যায়। আদর্শ প্রকাশনীর ঐ তিনটি বইয়ের ক্ষেত্রেও নাকি একই ঘটনা ঘটেছে। আমার মনে হয়, ব্যাপারটি এখানেই থেমে থাকবে না। বইমেলা শেষ হলে এর একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। কারণ ড. আলী রিয়াজের মতো মানুষও বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত বাক স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং লেখালেখির স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ। এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন এর সম্পর্কে আরো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয়। তবে যারা বছরের পর বছর মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে উচ্চকণ্ঠে শ্লোগান দিয়ে গলা ফাটিয়েছেন তারাই আজ সেই স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করার জন্য তলোয়ার নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন