মশা নিধনে ঢাকায় দুই সিটি করপোরেশন প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। মশা নিধনে যে ওষুধ ছিটানো হয়, তাতে শুভাঙ্করের ফাঁকি থাকায় ট্যাক্সদাতাদের অর্থের অপচয় হলেও মশার হাত থেকে নগরবাসী রক্ষা পাচ্ছে না। গত ২২ বছরে মশা নিধনের পেছনে সিটি করপোরেশনের খরচ হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এ বিশাল অর্থ ব্যয়ের দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো সুফল পায়নি নগরবাসী।
আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণে অতীতেও ঢাকায় মশার উপদ্রব ছিল। সে সময়ও মশা নিয়ন্ত্রণে নগর কর্তৃপক্ষ কাজ করেছে। সেই কার্যক্রম এখন আরও জোরদার হয়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন মশা নিয়ন্ত্রণে বিপুল অর্থ খরচও হচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো সুফল মিলছে না। আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণে বাংলাদেশে মশাজাতীয় কীটপতঙ্গের উপদ্রব বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এসব কীটপতঙ্গের উপদ্রব অনেকাংশে বেড়েছে। তা নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের গবেষণা, কার্যক্রমের তত্ত¡াবধান, প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, তার অনুপস্থিতি সংকট বাড়াচ্ছে। ফেব্রæয়ারি-মার্চ মাস কিউলেক্স মশা প্রজননের সময়। মশা জন্মায় পুকুর, ডোবা, নর্দমায়। দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় অনেক ডোবা ও নর্দমা থাকায় মশার উপদ্রব অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ডোবা, নালা, নর্দামাগুলো পরিষ্কার না করায় মশার উপদ্রব বাড়ছে। মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত কিউলেক্স মশার উপদ্রব বাড়তেই থাকবে। মশা নিধনে যে ওষুধ ছিটানো হয়, সেখানে থাকে শুভঙ্করের ফাঁকি। মশা নিধনের জন্য যে ওষুধ কেনা হয়, সেখানে চলে নানা দুর্নীতি ও ভাগবাটোয়ারা। এ দুর্নীতি মশার দৌরাত্ম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। মশা নিধনে নিতে হবে সমন্বিত পদক্ষেপ। একদিকে মশা নিধনের ওষুধ ছিটাতে হবে, অন্যদিকে ডোবা, নালা, জলাশয় পরিষ্কার রাখতে হবে। মশার হাত থেকে রেহাই পেতে হলে উভয় দায়িত্ব সমভাবে করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের সততাও নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
কীটতত্ত¡বিদ ও রোগতত্ত¡ বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মশাবাহিত রোগসহ কিছু রোগব্যাধি দ্রæত ছড়াচ্ছে। ডেঙ্গু তেমনই একটি রোগ। এডিস মশা এর জীবাণু বহন করে। তাদের মতে, মৌসুমের শুরুতে যদি এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হতো তাহলে রোগটির বিস্তার এতটা খারাপ পর্যায়ে যেত না।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। সচেতনতা বাড়ানোর জন্য মশা নিধন অভিযানে নাগরিকদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন। খুব সামান্য পানিতেই এডিস মশা বংশবিস্তার করতে পারে। সাধারণত পরিষ্কার পানিতেই এই মশা বংশবিস্তার করে। মানুষ যত্রতত্র পলিথিনের ব্যাগ, ডাবের খোসা, বোতল, ক্যান, পরিত্যক্ত টায়ার বা বিভিন্ন ধরনের পাত্র ফেলে রাখে। সেগুলোতে জমা বৃষ্টির পানিতে এডিস মশা অনায়াসে বংশবিস্তার করতে পারে। ফুলের টবে কিংবা ছোটখাটো পাত্রে পানি জমে থাকলে তাতেও বংশবিস্তার হয়। নির্মীয়মাণ ভবনগুলোতে রীতিমতো মশার চাষ করা হয়। দুই বাড়ির মধ্যখানে সরু জায়গায় আবর্জনার স্তুপ জমে থাকে। অনেক বাড়ির সানসেটেও আবর্জনা জমে থাকতে দেখা যায়। এসব জায়গায় এডিস মশার বংশবিস্তার দ্রæততর হয়। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশার বংশবিস্তারের সুযোগ নষ্ট করতে হবে। সেই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ মশা ও লার্ভানাশক ওষুধও যথেষ্ট পরিমাণে ছিটাতে হবে। মশার হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে সেসব জায়গায় নিধন জোরদার করতে হবে।
বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রীষ্মমÐলীয় দেশগুলোতে মশা ও পানিবাহিত রোগব্যাধি ক্রমেই বাড়বে। গ্রীষ্মমÐলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এই স্বাস্থ্যসমস্যা ক্রমেই প্রকট হবে। এ জন্য জাতীয় নীতিকৌশল ঠিক করে সেই সমস্যা মোকাবেলায় কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু যেহেতু নগরের সমস্যা হিসেবে বিবেচিত, তাই নগর কর্তৃপক্ষকে এক্ষেত্রে সবচেয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও ড্রেনগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না থাকা মশার বংশবিস্তারের অন্যতম কারণ। সঙ্গত কারণেই সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে যত দ্রæত সম্ভব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। মনে রাখতে হবে, দেশে মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে কয়েকগুণ। এছাড়াও ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে দেশজুড়ে। প্রাণহানী হচ্ছে। ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি কোনভাবই এড়ানোর সুযোগ নেই।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বারবার কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে, কর্তৃপক্ষ যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তা কতটা পর্যাপ্ত, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্তৃপক্ষ অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি বলেই ডেঙ্গু এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এরপরই কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। এভাবে সাময়িক পদক্ষেপে যে সুফল মিলবে না, এ কথা বিশেষজ্ঞরা অতীতেও বারবার বলেছেন।
কিউলেক্স মশার গুণগুণ শব্দ আর কামড় শহর-নগর-বন্দর জুড়ে মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এডিস মশার মতো ভয়াবহ না হলেও এ মশার কামড়ে অনেক সময় গোদরোগ হয়। এটি হলে হাত-পা ফুলে শরীরের বিভিন্ন অংশ বড় হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সঙ্গত কারণেই সংশ্লিষ্টদের এটা আমলে নেওয়া জরুরি। কীটতত্ত¡বিদরা বলছেন, যেকোন উপায়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখনই মশা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে মশার ঘনত্ব বেড়ে চরমে পৌঁছাবে। ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে-এমন আশংকাও করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া দরকার। নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিমত, মশা বৃদ্ধির পেছনে আবহাওয়া ও পরিবেশের প্রভাব থাকলেও এটিই একমাত্র কারণ নয়। এর নেপথ্যে আরও বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। বিশেষ করে নালা, ডোবা, পুকুর ও পরিত্যক্ত জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার এবং মশা মারার ওষুধ কেনা সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগও উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সঠিকভাবে ডোবা, জলাধার পরিষ্কার করা হচ্ছে না। মানহীন মশার ওষুধ কেনার কারণে এই ওষুধে কাজ হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মশা নিধন কর্মীরা মানহীন ওই ওষুধও নিয়ম মেনে ছিটায় না। বাইরে এসব বিক্রি করে দেয়, এমন বিষয়ও খবরের মাধ্যমে উঠে এসেছে।
মশা নিধনে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নয়, স্থায়ী পরিকল্পনা নিতে হবে। নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে নাগরিকদেরও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি নয়, প্রয়োজন সব পক্ষের সচেতনতা। পরিচ্ছন্নতা, জনসচেতনতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আশংকা সামনে রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন