শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প : পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ভয়ংকর রাজনীতি ও হার্প প্রকল্প

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

তুরস্ক সিরিয়ায় প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প নিয়ে গত এক সপ্তাহে কনস্পিরেসি থিওরি ও ডিজইনফর্মেশন ক্যাম্পেইন ডালপালা বিস্তার করেছে। ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগও কখনো কখনো রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার হাতিয়ার হতে পারে, এই ঘটনা তারই প্রমান বহন করছে। তবে সংশ্লিষ্টরা এসব ডিজইনফর্মেশন অথবা কনস্পিরেসি থিওরির বাস্তব থিওরিটিক্যাল ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলেও সময়, পরিবেশ পরিস্থিতি এবং এ অঞ্চলে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের ধারাবাহিক তৎপরতার পাশাপাশি বিতর্কিত প্রতিরক্ষা ও সামরিক গবেষণা প্রকল্পগুলো নিয়ে এক ধরণের লুকোচুরি ও অস্বচ্ছতার কারণে এসব হাইপোথেটিক্যাল প্রচারনা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে। সিরিয়া ও তুরস্কের ভূমিকম্পের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্প প্রকল্পের ভূমিকা নিয়ে কথিত কনস্পিরেসি থিওরি বাস্তব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলেও হার্প প্রকল্পের মত অস্বচ্ছ ও বিতর্কিত সামরিক গবেষণা প্রকল্পের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। খোদ মার্কিনী ও পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকরাও গত দুই দশকে বিভিন্ন সময়ে হার্প প্রকল্প নিয়ে যে ধরণের সংশয় ও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের পর তা নিয়ে এ এলাকার মানুষের মধ্যে সংশয় বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। সিরিয়া সীমান্ত ও তুরস্কে সংঘটিত ভূমিকম্প আঞ্চলিক গৃহযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের সব মাত্রা অতিক্রম করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। দুই মিনিটের ভূমিকম্পে ৬ হাজারের বেশি ভবন ধ্বংসস্তুপে পরিনত হওয়ার মধ্য দিয়ে একেকটি বহুতল ভবন একেকটি গণকবরে পরিনত হয়েছে। তাৎক্ষণিক শক কাটিয়ে তুর্কি ও সিরীয় উদ্ধারকর্মীরা এক সপ্তাহে প্রায় ৩৭ হাজার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। আহত ও বাস্তুহারা লাখ লাখ মানুষের বোবাকান্না আর কষ্টের আর্তিতে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। প্রায় ১২ বছর ধরে চলা সিরীয় গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের সাথে সিরিয়া ও তুরস্ককে এক জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সিরীয় নেতা বাশার আল আসাদকে মেনে নিতে পারছিলনা তুর্কি নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। পরিবর্তীত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে রাশিয়া ও চীনের মেলবন্ধনে ইরানের পাশাপাশি তুরস্কের মডারেট ভূমিকা এ অঞ্চলে নতুন রাজনৈতিক-সামরিক বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করেছে। বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর একাট্টা অবস্থানের মধ্যে তুরস্কের ভিন্নমতের সুর তাদেরকে কিছুটা অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তুঙ্গ অবস্থায় এরদোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্ক যখন অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে চলছিল এবং সেখানে একটি নতুন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, তখন এমন একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পেছনে মনুষ্য প্রভাবিত প্রযুক্তিগত সম্পর্কের দূরতম আশঙ্কাও বড় হয়ে দেখা দেয়া অস্বাভাবিক নয়।

চীনের ওহান শহরের কথিত বায়োলজিক্যাল ল্যাব থেকে প্রথম করোনা অতিমারী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম আক্রমণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পশ্চিমা দেশগুলো এই মহামারীর জন্য চীনকে অভিযুক্ত করে এক ধরণের উত্তেজক পরিস্থিতি তৈরীর প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বায়োলজিক্যাল ল্যাব ও প্রকল্পগুলোর অস্বচ্ছ ইতিহাস ও বিতর্কিত তৎপরতার পাল্টা চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করলে তাদের সেই প্রয়াস অনেকটা চুপসে যায়। তাছাড়া চীনে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার অস্তিত্ব প্রমাণের কিছু আলামত ধরা পড়েছিল। তুরস্ক ও সিরিয়া ভূমিকম্পের প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসাত্মক ও মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র দেখে তাৎক্ষণিকভাবেই এর পেছনে ইসরাইলসহ পশ্চিমা দেশগুলোর স্ট্র্যাটেজিক এডভান্স ওয়েপন্স অব মাস ডেস্ট্রাকশনের প্রসঙ্গক্রমে হার্প প্রকল্পের কথা উঠে আসে। প্রায় দেড় দশক আগে ইনকিলাবে প্রকাশিত এ প্রসঙ্গে আমার লেখা একটি নিবন্ধে (ক্লাইমেটিক ওয়ারফেয়ার) হার্প প্রকল্পের কিছু তথ্য তুলে ধরেছিলাম। নিবন্ধটি ২০০৯ সালের ফেব্রæয়ারীতে প্রকাশিত আমার লেখা ‘বিশ্বায়ন ও মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পের পর হার্প (HAARP- High frequency active aural research programme) প্রকল্প নিয়ে যখন সারাবিশ্বে শোরগোল চলছে, তখন পশ্চিমা এস্টাবলিশমেন্ট থেকে বলা হচ্ছে, হার্প শুধুমাত্র একটি গবেষণা প্রকল্প-এর কোনো আবাহাওয়া পরিবর্তনের সক্ষমতা নেই। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই ভবিষ্যতে যুদ্ধজয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ বিজ্ঞানী ভন নিওম্যানের তত্ত¡াবধানে ‘ওয়েদার মডিফিকেশন টেকনিক’ গ্রহণ করে। প্রায় দুই দশক গবেষণার পর ভিয়েতনাম যুদ্ধে ‘ক্লাউড সিডিং’ টেকনিক ব্যবহার করে মৌসুমী বৃষ্টিপাত দীর্ঘস্থায়ী করে তোলার মধ্য দিয়ে ভিয়েত কংদের হো-চিমিন এর সামরিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে বিঘিœত করার পন্থা গ্রহণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। এর দুই দশক পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড রিগ্যানের স্টার ওয়ার প্রকল্পের আওতায় হার্প প্রকল্প আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। আন্তর্জাতিক সামরিক বিশেষজ্ঞদের কাছে এই প্রকল্পের তৎপরতাকে ‘ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন’ এর খেতাব লাভ করে। কানাডিয়ান অর্থনীতিবিদ, লেখক-গবেষক মাইকেল চুসোদভস্কি বরাবরই এই প্রকল্পের বিপজ্জনকব দিকগুলো নিয়ে সরব আছেন। হার্প প্রকল্পের মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠের কোনো বিশেষ স্থানে খরা, বন্যা, হারিকেন ও ভূমিকম্প সৃষ্টির অভিযোগসহ ইরান, তুর্কি, গ্রিস, পাকিস্তান, হাইতি ও ফিলিপাইনের মত দেশগুলোতে ক্রমবর্ধমান বজ্রপাত, বিদ্যুত বিভ্রাটের মত সমস্যার পেছনে হার্প প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ থাকার বিষয় আলোচনায় এসেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশেও যত্রতত্র বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানীর ঘটনা বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশও হয়তো এই তালিকাভুক্ত হতে পারে। যদিও এসব অভিযোগের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমান না থাকায় বিষয়গুলো এখনো কনস্পিরেসি থিওরি বলে উড়িয়ে দেয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে। কিন্তু পশ্চিমাদের যুদ্ধবাদী নীতি ও ধারাবাহিক অপতৎপরতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আনা কোনো ভিত্তিহীন অভিযোগও মানুষের কাছে বিশ্ববসযোগ্য মনে হতে পারে। হার্প প্রকল্পের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো যে একেবারে ভিত্তিহীন এমন দাবীর স্বপক্ষেও তেমন কোনো তথ্যপ্রমান দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু হার্প প্রকল্পের মূল কেন্দ্র আলাস্কার সাবেক সিনেটর টম বেগিসের মত লোক অনেক আগেই আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও ভূমিকম্প সৃষ্টির মত সুবিশাল কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি এই প্রকল্পের মাধ্যমে মনস্তাত্তি¡ক পরিবর্তনের কৌশল সম্পর্কেও লিখেছেন। এ সম্পর্কে তাঁর লেখা একটি গ্রন্থের নাম- এঞ্জেল্স ডোন্ট প্লে দিস হার্প।

বিশ্বব্যবস্থার উপর পশ্চিমা পুঁজিবাদের একচ্ছত্র নিয়য়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখতে প্রযুক্তি ও মানুষের পক্ষে সম্ভাব্য সবকিছুই ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষা ও প্রয়োগ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নয়া বিশ্বব্যবস্থার লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিশ্বের খাদ্য, জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্তিক বিষয়গুলোর উপর নিয়স্ত্রনের সর্বাত্মক কসরত অব্যাহত রয়েছে। দেশে দেশে ডি-স্ট্যাবিলাইজেশন, বলকানাইজেশন, ইসলামোফোবিয়া, ওয়ার অন টেররিজম এবং গাল্ফ ওয়ার সিন্ড্রোম থেকে কথিত ডিপপুলেশন এজেন্ডা পর্যন্ত কোনো প্রকল্পকেই শ্রেফ কনস্পিরেসি থিওরি বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে কোনো সাধারণ বোধবুদ্ধি বা সাধারণ মানবিক দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যায়নি। মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আব্রাহাম লিঙ্কন, জন এফ কেনেডি বা মার্টিন লুথার কিংদের মত নেতাদের সেখানে বেঁচে থাকতে দেয়া হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাজনীতিতে জায়নবাদী থিঙ্কট্যাঙ্ক ও কর্পোরেট মিডিয়া ও গোপণ রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিচালিত কিছু সংগঠনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এখন আর আগের মত মুক্তচিন্তার স্বাধীন মতের নেতাদের হত্যা করার প্রয়োজন হয় না। পঞ্চাশের দশক থেকে বিল্ডারবার্গ গ্রæপ বিশ্বের উপর পশ্চিমা পুঁজিবাদী নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখতে কাজ করলেও এই গ্রæপের কোনো তথ্য বা মিটিংয়ের খবরাখবর কখনো কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়না। সত্তুর বছর ধরে পশ্চিমা বিশ্বের ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলা এমন একটি সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে বিশ্বকে অন্ধকারে রাখার কারণ কি? একইভাবে পশ্চিমা বেশকিছু গোপণ বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরি কিংবা হার্প প্রকল্পের মত আনকনভেশনাল প্রতিরক্ষা প্রকল্পের আসল কার্যক্রম ও দূরভিসন্ধি সম্পর্কেও বিশ্ববাসী জানে না। আগ্রাসী প্রতিরক্ষা প্রকল্পের নামে বিশ্বের মানব সম্প্রদায়কে বড় ধরণের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়ার এসব তৎপরতার বিপরীতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে বহু আগেই আইএইএ’র মত জবাবদিহিতামূলক সংস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল। পশ্চিম থেকে নিয়ন্ত্রিত মেইনস্ট্রিম মিডিয়া আউটলেটগুলো এসব বিষয়ে কর্পোরেট সাম্রজ্যবাদের প্রপাগান্ডা এজেন্ডা হিসেবে সুকৌশলে একটি ডিজইনফরমেশন ক্যাম্পেইন চালু রেখেছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়নের হাত ধরে এখন প্রকৃত সত্যানুসন্ধানি রিপোর্ট এবং কাউন্টার ইনফরমেশনও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর চীনের উপর দোষ চাপিয়ে তার অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক অগ্রযাত্রা রুখে দেয়ার পশ্চিমা অভিসন্ধি যেভাবে ব্যর্থ হয়ে গেছে, এখন তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকল্পের পর এর পশ্চাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্প প্রকল্পের দায় এবং এ এলাকার ভূরাজনীতিতে ন্যাটো, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সম্মিলিত তৎপরতার ঐতিহাসিক পরম্পরা সম্পর্কে এখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটাতে পারে। সিরিয়ায় গত একযুগের গৃহযুদ্ধ, ইউক্রেনযুদ্ধে তুরস্কের ভূমিকা এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ভাগ্য এবং ইসরাইলের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নেতানিয়াহুর জোট সরকারের নড়বড়ে অবস্থান এবং আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ট্রাজিক ভূমিকম্পের ফলাফল, ত্রাণ-পুনর্বাসন ও বিশাল পুনর্গঠন কার্যক্রমে সরাসরি প্রভাবক হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভুমিকম্পের ভয়াবহ চিত্র আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। ভূমিকম্প ট্রাজেডির ৬ষ্ঠ দিনে মৃতের সংখ্যা ৩৮ হাজার ছাড়িয়েছে। টেকটনিক প্লেটসমুহের অবস্থান, পর্বত ও সমুদ্রের যোগসূত্র এবং ভূপ্রাকৃতিক বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশ-ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বৈশ্বিক সিসমিক জোন হিসেবে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের অতীত ইতিহাস এবং টেকটনিক প্লেটের বাউন্ডারি বিবেচনায় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও সিলেট, চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারকে ধরা হয়। গত দুই শতাব্দীর মধ্যে এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। স্বাধীনতাত্তোর অর্ধ শতাব্দীতে মৃদু ও মধ্য মাত্রার যতগুলো ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই এ অঞ্চলের। ভূমিকম্পের সাধারণ কারণ হিসেবে যে বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, তা হচ্ছে টেকটনিক প্লেটগুলোর ঘর্ষণ ও স্থানচ্যুতির ফলে যে শক্তি জমা হয় শতবছরে ভূমিকম্প আকারে তার বহি:প্রকাশ ঘটে থাকে। সিসমিক জোন হিসেবে সিলেট বা পাবর্ত্য অঞ্চলের চেয়ে ঢাকাকে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ধরা হলেও পরিবেশ দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জনসংখ্যার অতিঘণত্বের কারণে ঢাকা ক্রমেই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় সংঘটিত ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের কম্পন মহাদেশ পেরিয়ে সুদুর গ্রীনল্যান্ডে পর্যন্ত অনুভূত হয়েছে বলে জানা যায়। তুরস্কের ১০ শহর ও প্রদেশে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে এর ভয়ঙ্কর রূপ বোঝা যায়। একই মাত্রার ভূমিকম্প সিলেট বা মেঘালয়ে সৃষ্টি হলে মাত্র দু’তিনশ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঢাকার অবস্থা কি হবে তা ভাবলেও আতঙ্কিত হতে হয়। তুরস্কের বেশকিছু এলাকার বহুতল ভবনগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিনত হওয়ার পেছনে বিল্ডিংকোড না মেনে ভবন নির্মানকে দায়ী করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু ইঞ্জিনিয়ারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আটক করেছে তুর্কি পুলিশ। পরিকল্পিত আবাসন, নগরায়ণ ও বিল্ডিংকোড ও নিরাপত্তার সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা সামগ্রিকভাবে সরকারের দায়িত্ব। বড় ধরণের দুর্ঘটনার পর জানা যায়, স্থাপনাটি নির্মাণে কোড অমান্য করা হয়েছিল, এর নকশা ত্রæটিপূর্ণ ছিল ইত্যাদি। পুরনো ঢাকার নিমতলিতে রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর অপ্রশ্বস্ত রাস্তার কারণে সেখানে ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি দ্রুত পৌঁছতে না পারায় শত শত মানুষ আগুনে পুড়ে ছাইভস্মে পরিনত হওয়ার স্মৃতি কখনো ভুলবার নয়। ভূমিকম্পে ঢাকায় এমন দুই-চার হাজার বহুতল ভবন ধসে গেলে ধ্বংসস্তুপের নিচে লাখ লাখ মানুষের কবর রচিত হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকবে না। এ ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় তেমন কোনো প্রস্তুতিই আমাদের নেই। গত দশকে রানাপ্লাজা দুর্ঘটনায় সহশ্রাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা থেকেই তা প্রমাণিত হয়েছে। নগর পরিকল্পনা, বিল্ডিং কোড ও পরিবেশগত বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য করার ফল ভোগ করছে পুরো জাতি। চলমান একিউআই ইনডেক্স রিপোর্ট অনুসারে টানা দেড়মাস ধরে ঢাকার মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাস গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পরিবেশগত নিরাপত্তাহীনতার কারণে ঢাকাসহ দেশের কোটি কোটি মানুষ চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির শিকার। ভূমিকম্প বা বড় ধরণের প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ঘটনা-দুর্যোগে লাখো মানুষের ট্রাজিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।

bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md Mahfuj Alom ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১০:৩৫ এএম says : 0
সব মিলিয়ে বলা যায় আমাদের সচেতনতার অভাব আমরা সব প্রকৃতির উপর ছেরে দেই।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন