শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত?

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০২ এএম

দেশের প্রায় সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকা। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোটি কোটি মানুষ। কোনো কোনো পত্রিকায় বলা হয়েছে, এ জাতীয় ভূমিকম্পে ৬ থেকে ২০ ফুট উপরে উঠে যাবে মাটি। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট, অর্থাৎ, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। কয়েক হাজার ভবন ধসে পড়বে। কারণ, আমাদের ভবনগুলো এখনও নিরাপদভাবে তৈরি হচ্ছে না। বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়েও উঁচু। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এখনই ভূমিকম্প হবে তা বলা যাবে না। তা পাঁচশ’ বছর পরেও হতে পারে। দেশে কোথায় কবে কত মাত্রার ভূমিকম্প হবে কেউ আগে-ভাগে তা বলতে পারে না। সবই ধারণাপ্রসূত। হতেও পারে, নাও হতে পারে। ভূমিকম্প কখন হবে, কবে হবে তা আগে থেকে বলা যায় না এবং ভূমিকম্প যেহেতু প্রতিরোধ করা যাবে না তাই এ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে মানুষকে অসুস্থ করে দেয়ার কোনো মানে হয় না। তবে ভূমিকম্পের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে উদ্ধারে প্রস্তুতি থাকতে হবে। জনমনে আতঙ্ক তৈরি না করে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। জাপানে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। জাপান ভয়কে জয় করেছে। তাই তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই কম। আমাদের সরকার ও জনগণ ভূমিকম্পের ব্যাপারে সচেতন নয়। ঢাকা শহরে যতগুলো স্থাপনা থাকা দরকার তার চেয়ে ৫০ গুণ স্থাপনা তৈরি হলেও সরকারের এ ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই। এখনও এ শহরে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়, বাণিজ্যিক কার্যালয়, সচিবালয়সহ অন্যান্য অফিস শহরের বাইরে করার পরিকল্পনা সেই বহু আগে নেয়া হয়েছে, কিন্তু তার বাস্তবায়নের কোনোই লক্ষণ নেই। অফিস-আদালত, স্থাপনা শহরের বাইরে হলে ঢাকার চাপ অর্ধেক কমে যাবে। মানুষ আর ঢাকামুখী হবে না। ঢাকা শহরে লোকজনের বসবাস কমে যাবে। তাতে ঢাকার উপর চাপ কমবে। তখন ভূমিকম্প হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে।

সরকারের তরফ থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়ার ন্যূনতম প্রস্তুতিও যে আমাদের নেই, তা স্পষ্ট। ব্যাপক অভাব রয়েছে জনসচেতনতারও। ভূমিকম্পের ব্যাপারে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কোনোটাই সরকারের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক মূল্যবান সময় অপচয় হয়েছে। আর বিলম্ব করা সমীচীন হবে না। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের প্রকৃত সময় এখনই। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সর্বদা আমাদের নিজেদেরই প্রস্তুত থাকতে হবে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দু’টি। প্রথমত ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নতম পর্যায়ে রাখা এবং দ্বিতীয়ত ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেওয়া।

বাংলাদেশ একটি আরও বড় মাত্রার ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্কবাণীর পর এ বিপদাশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না কিছুতেই। এ অবস্থায় কখন যে ভূমিকম্প আঘাত হানবে বলা যায় না। তাই ভয়ে সবার বুক দুরু দুরু। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ভূমিকম্পই নয়, দেশের উপকূলীয় এলাকা ঘিরে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টির জন্য সাইসমিক গ্যাপ বিরাজমান রয়েছে। এ গ্যাপ থেকে যে কোনো সময় সুনামিও হতে পারে। তাদের মতে, বঙ্গোপসাগরের উত্তরে আন্দামান থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাবডাকশন জোন বরাবর ৬শ’ কিলোমিটারের একটি সাইসমিক গ্যাপ রয়েছে। শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি এই সাইসমিক গ্যাপে জমা হয়ে আছে। এই সাইসমিক গ্যাপ আমাদের জন্য অশনি সঙ্কেত। এখান থেকে ৮ মাত্রার মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা যদি সাগরতলে হয় তাহলে সেই ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টি করতে পারে।

ভূমিকম্পে বিল্ডিং সাধারণত দুমড়েমুচড়ে গায়ে পড়ে না। হেলে পড়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এ সময় আত্মরক্ষা করতে হবে। ভিম কিংবা কলামের পাশে শক্ত কোনো কিছুর পাশে থাকতে হবে। বিশেষ করে, খাট কিংবা শক্ত ডাইনিং টেবিল হলে ভালো হয়। আগে থেকেই আশ্রয়ের জায়গা ঠিক করে নিতে হবে। ঘরে রাখতে হবে শাবল এবং হাতুড়ি জাতীয় কিছু দেশীয় যন্ত্র। ভূমিকম্প হলে অনেকেই তড়িঘড়ি করে নিচে ছোটে। তাঁরা জানে না ভূমিকম্পে যত ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় অস্থির লোকদের ছোটাছুটিতে। ভূমিকম্প খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়। প্রলয় যা হবার তা হয় কয়েক সেকেন্ড কিংবা মিনিট সময়ের মধ্যে। এ সময়ে কেউ কি নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারবে? রাস্তায় গিয়ে তো আরও বিপদে পড়তে হবে। বাড়িঘর হেলে গিয়ে তো রাস্তার উপরই পড়বে। যারা একতলা কিংবা দোতলায় থাকে পাশে খালি মাঠ থাকলে দ্রুত দৌড়ে যেতে পারে। সেখানে যেতে যদি সমস্যা থাকে তা হলে সৃষ্টিকর্তাকেই ভরসা করে শক্ত কোনো কিছুর আড়ালে অবস্থান নেয়াই শ্রেয়। রাজধানী ঢাকায় যারা বসবাস করে, যারা উঁচু বিল্ডিংয়ে থাকে তাদের ভয়টা যেন একটু বেশি। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, দেশে ৬ তলার উপরে নির্মিত বিল্ডিংগুলো সাধারণত বিল্ডিং কোড মেনেই হয়। বড় বিল্ডিং তৈরির ক্ষেত্রে অনেকেই ঝুঁকি নিতে চায় না। একটু দেখভাল করেই নির্মাণ করে। আর এসব বিল্ডিং পাইলিং হয় অনেক গভীর থেকে এবং বেজ ডালাই দেয়া হয় পুরো বিল্ডিংয়ের নিচ জুড়ে। তাই শুধু কলামে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিং থেকে হাইরাইজ বিল্ডিং কিছুটা হলেও নিরাপদ বলা যায়।

ভূমিকম্প নিয়ে কমবেশি আতঙ্ক সবার মধ্যেই আছে। ছবির মতো সুন্দর তুরস্কে ভূমিকম্পে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশেও অনেকে আতঙ্কে ভুগতে পারেন। আতংকিত হলে চলবে না। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকেই এ বিষয়ে মুখ্য দায়িত্ব পালন করতে হবে, যাতে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে থাকে। একটি ভবন নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সব নিয়ম মেনে করছে কি না, তা কঠোরভাবে তদারক করতে হবে। ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন