মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনের অবরুদ্ধ রাজধানী কিয়েভে এক গোপন সফর করেছেন। প্রতিবেশী পোল্যান্ডের সীমান্ত থেকে সোমবার কয়েক ঘণ্টার ট্রেন যাত্রার পর দেশটিতে পৌঁছান তিনি। কিয়েভে বাইডেনের এই সফর একেবারে গোপনে সম্পন্ন হয়েছে। ওয়াশিংটন ত্যাগ থেকে কিয়েভে পৌঁছানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই সফরের ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনও তথ্যই প্রকাশ করা হয়নি। -দ্য নিউইয়র্ক টাইমস
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের বর্ষপূর্তির কয়েক দিন আগে কেন এবং কীভাবে গোপনে ইউক্রেন সফরে গেলেন জো বাইডেন; সেই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। মার্কিন এই দৈনিক বলছে, শনিবার রাতে স্ত্রী জিল বাইডেনকে নিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় বিরল নৈশভোজের পর কোনও ধরনের নোটিশ ছাড়াই ওয়াশিংটন ত্যাগ করেন বাইডেন। নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে জো বাইডেনের কিয়েভ সফরের পুরো আয়োজন একেবারে গোপনে সম্পন্ন হয়েছে।
বাইডেন দু’দিনের সফরে আগামীকাল অর্থাৎ মঙ্গলবার পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশে পৌঁছাবেন বলে সরকারি শিডিউল প্রকাশ করা হয়েছিল। পোল্যান্ড থেকে ইউক্রেনে সফরে যাওয়ার বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে, এমন পরিকল্পনার কথা বারবার অস্বীকার করেছিলেন ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা। এমনকি রোববার রাতেও হোয়াইট হাউজ সোমবারের জন্য বাইডেনের সফরের বিষয়ে সর্বজনীন একটি শিডিউল প্রকাশ করে। সেই শিডিউলে বলা হয়, এখনও ওয়াশিংটনে রয়েছেন জো বাইডেন এবং সন্ধ্যায় ওয়ারশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। কিন্তু ততক্ষণে তিনি অর্ধ-পৃথিবী দূরে পৌঁছেছিলেন। ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থনকে ইউরোপীয় জোটকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার যুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন জো বাইডেন। নিজের উপদেষ্টাদের তিনি বলেছিলেন, মিত্রদের আশ্বস্ত করার উপায় হিসাবে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রথম বর্ষপূর্তিকে তিনি স্মরণীয় করে রাখতে চান; যাতে ইউরোপীয় মিত্ররা বুঝতে পারেন, তার প্রশাসন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে।
দেশে এবং বিদেশে ইউক্রেন যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ এক মুহূর্তে দেশটির রাজধানী কিয়েভে পৌঁছান জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কট্টর মিত্র ইউক্রেনকে একটি শান্তি চুক্তির জন্য আলোচনা শুরু করতে চাপ দিচ্ছে; যাতে রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার মতো প্রস্তাবও রয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য-দায়িত্ব নেওয়া স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি ও তার কিছু সহকর্মী রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে ‘ফাঁকা চেক’ বলে অভিহিত করে শিগগিরই তা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। বাইডেনের আকস্মিক কিয়েভ সফর মঙ্গলবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্ধারিত এক বক্তৃতার ঠিক এক দিন আগে হয়েছে। বক্তৃতায় ইউক্রেনে বসন্তকালীন আক্রমণের মাঝে মস্কোর যুদ্ধ প্রচেষ্টা সম্পর্কে পুতিন কথা বলবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার সকালে পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদার সাথে বাইডেনের সাক্ষাতের কথা রয়েছে। একই দিন বিকেলে ওয়ারশ ক্যাসেল থেকে বক্তৃতা করার কথাও রয়েছে মার্কিন এই প্রেসিডেন্টের। বাইডেনের বক্তৃতাজুড়ে অনিবার্যভাবে থাকবে ইউক্রেন। আবার একই দিনে ইউক্রেন সম্পর্কে কথা বলেবেন পুতিনও। ওইদিন টেলিভিশনের পর্দা কিংবা মুঠোফোনে পর্দা ভাগাভাগি করে নেবেন এ দুই বিশ্বনেতা। এর মাঝে আকস্মিক কিয়েভ সফরের কারণে বাইডেনের শিডিউলে কোনও পরিবর্তন আসবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। বাইডেনের কিয়েভ সফর ইরাক ও আফগানিস্তানে কয়েক বছর আগের তুমুল যুদ্ধের সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও বারাক ওবামার গোপন মিশনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে নিয়োজিত মার্কিন সৈন্যদের ধন্যবাদ জানাতে দেশটিতে গোপন সফর করেছিলেন বুশ। আর এই সফর এতটাই গোপন ছিল যে, এমনকি তার সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরাও ভেবেছিলেন তিনি এখনও টেক্সাসের ক্রফোর্ডে তার খামারে রয়েছেন। ২০১০ সালে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে প্রায় একই ধরনের এক সফর করেছিলেন বারাক ওবামা। যাতে কেউই তার এই সফরের বিষয়ে বুঝতে না পারেন, সে জন্য ক্যাম্প ডেভিড থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে কাবুলে চলে যান তিনি। কিন্তু সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র ইউক্রেনে বাইডেনের সফর বিশেষ জটিল ছিল। কারণ সেখানে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতি ছিল না। ইরাক-আফগানিস্তানে বুশ ও ওবামার গোপন সফরের সময় তাদের সুরক্ষার জন্য দুই দেশেই মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি ছিল।
মার্কিন কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাও পোল্যান্ড থেকে রাতারাতি ট্রেনে চেপে ইউক্রেনে গেছেন। পোল্যান্ড থেকে ট্রেনযোগে ইউক্রেনে পৌঁছাতে সাত ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। যুদ্ধের ডামাডোলে ট্রেন যাত্রাকে বেশি নিরাপদ বলে মনে করা হয়। কিয়েভের মাটিতে কয়েক ঘণ্টা কাটানোর পর রাত্রিযাপন না করেই আবারও ট্রেনে রওয়ানা হয়েছেন তারা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে. ব্লিঙ্কেন গত সেপ্টেম্বরে এবং বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান নভেম্বরে একই ধরনের সফর করেছিলেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গত বছর বড় দিনের ঠিক আগে ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর ইউক্রেনের বাইরে এটাই ছিল তার প্রথম সফর। সেই সময় ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা নেতাদের আরও সহায়তা ও সমর্থনের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।
হোয়াইট হাউজে বাইডেনের সাথে বৈঠকে এবং কংগ্রেসে আবেগময় বক্তৃতার সময় ওই আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। বাইডেনের ইউক্রেন সফরের মতোই জেলেনস্কির ওয়াশিংটন সফর নিরাপত্তার কারণে তার পৌঁছানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছিল। জেলেনস্কির বক্তৃতার দু’দিন পর মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনে আরও ৫০ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত জরুরি তহবিলের অনুমোদন দেয়। এছাড়া ইউক্রেনকে দেওয়া বেশিরভাগ সামরিক সরঞ্জামের উদ্দেশ্য ছিল দেশটিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করা। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তার পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন