বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

| প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্রের দাবি ঊর্ধ্বে তুলে ধরার ঐতিহাসিক দিন। মাতৃভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ জাগ্রত তারুণ্যের প্রতিনিধিরা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে শাসকদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের গুলিতে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তাদের সেই আত্মত্যাগের বিনিময়ে শাসকরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদিকে ভাষার জন্য জীবন দেয়ার বিরল ইতিহাস রচনার সুবাদে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। হাজার বছরের লালিত স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মমর্যাদার দাবিকে অগ্রাহ্য করার বিরুদ্ধে বায়ান্নতে রুখে দাঁড়ানোর শাণিত চেতনার পথ বেয়ে দেশের মানুষ পরবর্তী প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, স্বাধিকার সংগ্রাম এবং একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনার মধ্যে মহান ভাষাশহীদদের আত্মদান এবং এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফল্গুধারার মতো প্রবাহমান ছিল। আজকের এইদিনে আমরা মহান ভাষাশহীদদের অমলিন স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

ব্রিটিশভারতে বাংলা ভাষাভাষীরা শুধু সংখ্যার দিক দিয়েই নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার দিক দিয়েও অগ্রগণ্য ছিল। ব্রিটিশমুক্ত ভারতে লিংগুয়াফ্রাংকা কী হবে, তা নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে তখন উর্দু ও হিন্দির পাশে বাংলার দাবিও উঠে আসে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ওই দাবি পেশ করেন এবং বলেন, বাংলার লিংগুয়াফ্রাংকা হওয়ার যোগ্যতা অন্য দুই ভাষার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই অভিমত অনেকেরই পছন্দ হয়নি। তারা বাংলার পক্ষে দাঁড়াতে দ্বিধাপ্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বাংলার দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সে সময়ের প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত আছেন। তিনি হিন্দির পক্ষে রায় দেন। অথচ, তিনিই উপমহাদেশ ও বাংলাভাষার প্রথম কবি, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এখানে সংক্ষেপে স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলা সর্বভারতীয় ভাষাসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভাষা হিসেবে গণ্য হলেও বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যকার একটি শ্রেণি-বিভিন্ন সময়ে এ ভাষাকে যথাযথ মূল্য দিতে চায়নি। এই ভাষায় প্রথম সাহিত্যচর্চা করেছেন বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকরা। শেষ পর্যন্ত তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকের অত্যাচার-নির্যাতনে দেশছাড়া হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে নেপালের রাজদরবারে। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বাংলা ভাষায় ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদ করতে দেয়নি। বলেছে, যারা এটা করবে, তারা রৌরব নরকে যাবে। মধ্যযুগেও বাংলাভাষা বিদ্বেষ লক্ষ করা গেছে। বিদ্বেষীদের উদ্দেশ্যে তাই কবি আবদুল হাকিমকে বলতে হয়েছে, ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ উপমহাদেশ ও বাংলাভাগের পর পাকিস্তানের শাসকরা বাংলার মর্যাদা দিতে রাজি হয়নি। তাদের নারাজির প্রতিবাদেই সংগঠিত হয় ভাষা আন্দোলন। ভাষাশহীদরা বুকের রক্ত ঢেলে বাংলার মর্যাদা সুরক্ষা করেন। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, এ দেশের মানুষ ভাষাপরিচয়ে বাঙালি। ধর্মীয় পরিচয়ে অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। এই দুই পরিচয়ের কোনোটিই পরিত্যাগযোগ্য নয়। এই দু’য়ের মেলবন্ধনেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই দুই পরিচয়ের একটি অস্বীকার করার অর্থ হলো, জাতীয় স্বাতন্ত্রকে অস্বীকার করা। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটা অতুল্য গৌরবের বিষয় যে, ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। কিন্তু যে ভাষার মর্যাদার জন্য বায়ান্নর প্রজন্ম সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে দাবি আদায় করেছিল, তার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। এখনো প্রশাসন, আদালতসহ সর্বত্র বাংলাকে মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। আমাদের ব্যর্থতা এই যে, এতদিনেও আমরা মাতৃভাষার মর্যাদা যথাযথ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারিনি। এখন তো ভাষা ওপর নানা অনাচার, অত্যাচার, যথেচ্ছাচার চলছে, নানাভাবে ভাষার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, অবমাননা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বেসরকারি রেডিও, সংবাদপত্র, বই-পুস্তক ইত্যাদিতে ভাষার চরম বিকৃতির জোয়ার চলছে। শব্দ ব্যবহার, বানান ও উচ্চারণে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। অবশ্য ভাষা, ব্যকরণ, বানান ইত্যাদি নিয়ে কিছু কাজও হচ্ছে, যা আশাব্যঞ্জক। এসব কাজের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। ভাষার বিকৃতি ও যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে সর্বজনগ্রাহ্য একটি রীতি-পদ্ধতি প্রবর্তন করা না গেলে ভাষাকে সুরক্ষা করা যাবে না। স্বীকার করতে হবে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থায় অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। এর মূলে রয়েছে বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন। বিশ্ব দরবারে বাংলাকে এবং বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে বাংলা ভাষার ব্যাপক বিস্তারে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের অশেষ ভূমিকা রয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এই দেশে তারা ইসলাম সম্পর্কে যা কিছু জেনেছে ও শিখেছে, বাংলা ভাষার মাধ্যমেই শিখেছে। ইসলামবেত্তারা পবিত্র কোরআন ও হাদিস অনুবাদ থেকে শুরু করে ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর নিরলসভাবে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং করছেন। এসব গ্রন্থাদি অন্য যেকোনো গ্রন্থ থেকে সর্বাধিক পঠিত। মসজিদে জুমা পূর্ব খুৎবাও বাংলায় দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ইমামরাও বাংলা ভাষার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারে ভূমিকা রাখছেন। এ প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বাংলা ভাষার বিস্তার ও পরিচর্যায় আলেম-ওলামা ভূমিকা পালন করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। অথচ, তাদের এই বিশেষ কর্মের স্বীকৃতি রাষ্ট্রীয়ভাবে দেয়া হয় না। আমরা মনে করি, ইসলামী গ্রন্থ রচিয়তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা পদক দিয়ে উৎসাহিত করা উচিত।

বাংলাদেশের যে পরিচয়, স্বাতন্ত্র্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস তা সংরক্ষণ ও অব্যাহত চর্চা, অনুসরণ, অনুশীলনের মধ্যেই জাতীয় প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ নির্ভরশীল। এর ব্যত্যয় ও বৈপরীত্য দেখা গেলে দেশ ও জাতির জন্য সেটা হুমকি স্বরূপ। রাজনীতি নিয়ন্ত্রক শক্তি হলেও ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা তার সহায়ক না হলে ওই রাজনীতি তার সক্ষমতা হারাতে বাধ্য। এ জন্যই জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাশাপাশি ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা ইত্যাদির চর্চা, বিকাশ, প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, রাজনীতি এখন যথাযথ অবস্থানে নেই। সেখানে বিভেদ-বিভ্রান্তি ব্যাপক। অন্যদিকে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর বহিরাগত আগ্রাসন মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে চেতনা ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে, সে চেতনা তুল্যমূল্যে অনুসরণ হচ্ছে না। জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য এটা এক অশনিসঙ্কেত। ভাষা আন্দোলন বলি কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধ বলি, সবকিছুর মূলে লক্ষ্য ছিল, জাতিগত স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। রাজনৈতিক অধিকার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা এ আকাক্সক্ষার অন্তর্গত অপরিহার্য বিষয়। এমতাবস্থায়, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিনাশী চেতনাই আমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন