বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, নদী, বিল খাল দখল ও ভরাট এবং নদী ভাঙনের কারণে কমছে বনাঞ্চল । ফলে কমছে পাখির সংখ্যা বিলীনের হুমকিতে বন, বনজ প্রাণী। রূপসী বাংলার চিরায়ত রূপের অনুসঙ্গ লাল শিমুল ও পলাশ গাছের সংখ্যাও কমছে। ফুলের ঋতুর সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই দু’টি গাছ আর গ্রামাঞ্চলে তেমন একটা চোখে পড়েনা। এই অঞ্চলে সম্পুর্ণ বিনা চাষে এবং বিনা পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা উঁচু লম্বা শিমুল গাছের উৎপন্ন তুলায় এক সময় এদেশের মানুষের লেপ তোষকের চাহিদা মেটাতো। এখন কার্পাস এবং গার্মেন্টস-এর ছাঁট কাপড়ের প্রসেস তুলায় মেটানো হচ্ছে সেই চাহিদা।
রক্তলাল শিমুলের পাশাপাশি বট পাকুড় জাতীয় গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাতাসে অক্সিজেনের পরিমানও কমে যাচ্ছে দিনদিন বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
ঢাকা রংপুর মহাসড়ক দিয়ে পরিবহনযোগে বগুড়া থেকে রংপুর যাওয়ার পথে রংপুর বেতারের সাবেক সঙ্গিত শিল্পী (বর্তমানে বিটিভিতে নিবন্ধিত) জাহাঙ্গীর মাহমুদ বারবার জানালা দিয়ে তাকিয়ে রাস্তার পার্শ্বস্থ গ্রামগুলোর দিকে কি যেন খুঁজছিলেন। হঠাৎ একটা টকটকে লাল ফুলে ছাওয়া শিমুল গাছের দেখা পেয়ে চলন্ত যানবাহনে বসেই মোবাইল ফোনে ছবি ধারণ করে বিড়বিড় করে পাশের যাত্রীকে বললেন, সুন্দর না ?
কথা প্রসঙ্গে জানালেন, তিনি বগুড়ায় সেটেলড হলেও রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জে তার জন্ম। রংপুরে পুলিশের একাউন্টস বিভাগের হেড এসিসটেন্ট হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করায় এইপথে বহুবার তাকে যেতে আসতে হয়েছে। আগে ডানে বাঁয়ে তাকালে অনেক শিমুল গাছের দেখা মিলতো। শিমুল গাছ ভর্তি লালফুলের সমাহার হলে গাছে শতশত শালিক প্রজাতির পাখিরা উড়ে উড়ে মধু খেত আর কিচিরমচির রব তুলে চারদিক মুখরিত করে রাখতো। তার কথার রেশ ধরে কয়েকজন যাত্রী বললেন, এই রাস্তা ফোরলেন করতে গিয়েও শিমুলসহ বহু গাছ কাটা পড়েছে। সবুজ আন্দোলন নামের একটি পরিবেশ সংগঠনের গবেষণা জরিপে জানা যায়, সারাদেশেই ৮০ এর দশকে দ্রুত বনায়নের বিদেশি প্রেসক্রিপসনে সরকারিভাবে বন বিভাগের মাধ্যমে ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি ও পাইন জাতীয় গাছ রোপনের ব্যবস্থা করা হয় । বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত কিছু এনজিও এক্ষেত্রে মুখ্য ভুমিকা পালন করে। একই সময়ে গ্রামীণ হাটবাজারগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের সময় অনেকক্ষেত্রে প্রয়োজন না থাকলেও বড়বড় শিমুল, বট পাকুড়ের গাছগুলো কেটে ফেলা হয়। অথচ এইসব বড়বড় বট পাকুড়ের গাছগুলো ছিল হরেক প্রজাতির পশুপাখি ও সরিসৃপ প্রাণীদের নির্ভয় আবাসস্থল।
পরিবেশ বিষয়ে পর্যবেক্ষকরা জানান, এই এলাকায় নদী ভাঙনের কারণেও বিলীন হওয়া জনপদগুলোর অনেক গাছপালা চিরতরে বিলীন হয়ে যায়। এছাড়াও শহর, নগর, গ্রামীণ জনপদে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও আবাসনের কারণেও কমেছে গাছপালা। চাষাবাদের জমির প্রয়োজন মেটাতেও মানুষ ছোটছোট বনভূমি কেটে সাবাড় করেছে।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে সরকারিভাবে দেশে ইউক্যালিপটাস প্রজাতির গাছের চারা উৎপাদন ও বিপনন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে তারপরও বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাাদেশের পরিবেশ অনুপযোগি ইউক্যালিপটাস ও এর সমগোত্রীয় গাছের চারা উৎপাদন ও বিপনন চালু আছে বলে জানালেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী জিয়াউর রহমান জিয়া। তিনি এ বিষয়ে আরো বলেন , এখন থেকেই দেশীয় শিমুল, পলাশ, বট পাকুড় জাতীয় গাছের চারা উৎপাদন বপনের ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং বহু প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর স্থায়ী বিলুপ্তি ঘটবে।
রংপুর সামাজিক বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. মতলুবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, রংপুর ও নীলফামারী অঞ্চলে এখন মাত্র ৭ হাজার ২৫০ দশমিক ৫ একর বনভূমির অস্তিত্ব আছে। এটা যাতে আর বিলুপ্তির দিকে না যায় সেদিকে সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও সচেতন ভূুমিকা পালন করতে হবে। দেশের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকে আরও সক্রিয় ও প্রচারমুখি হয়ে সাধারণ মানুষদের সচেতন করতে হবে।
একই বিভাগের ‘বন্যপ্রাণী ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ কর্মকর্তা স্মৃতি সিংহ রায় বলেন, শিমুল, পলাশ, বট পাকুড় জাতীয় বৃক্ষরাজি, জলাভুমির বক জাতীয় পাখি, কাঠ বিড়ালি , বাঘ ডাসা, বন বেড়াল, বন মোরগ জাতীয় পাখি ও প্রাণী এবং কয়েক প্রজাতির সরিসৃপ এদেশের আবাহমান কালের ঐতিহ্য, সৈন্দর্য ও সম্পদ। কিন্তু উন্নয়ন, নগরায়ন অপরিকল্পিতভাবে করায় এসব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। লোভী ও বিবেকহীন মানুষেরা জলাভুমি ভরাট করে, বনভুমি সাবাড় করে , নদী নালা খাল বিল দখল করে পরিবেশকে দীর্ঘস্থায়ী ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটা রোধ করতে না পারলে খেসারত দিতে হবে আমাদেরই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন